সিঁড়িতে আজও শুকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ

তিনতলা একটা বাড়ি। দেওয়ালে যত্রতত্র গুলির চিহ্ন। কোথাও গুলির ঘষা লেগে চটা উঠে গিয়েছে দেওয়ালের, কোথাও বা গর্ত হয়ে আছে। ঘরে, বারান্দায়, সিঁড়িতে – সর্বত্র। গিয়ে দাঁড়ালে চমকে উঠতে হয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের নির্মমতার দৃশ্য। চোখ ভিজে আসে নিজে থেকেই।

হ্যাঁ, আমি ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকার ৩২ নং বাড়ির কথা বলছি। যে বাড়িতে থাকতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাঙালিই সম্ভবত জানেন না যে, ১৫ আগস্ট যেমন ভারতে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়, তেমনি বাংলাদেশে এই দিনটি শোক দিবস। তা বলে ভারতের সঙ্গে কোনো শত্রুতার কথা ভেবে বসবেন না যেন! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান-কে।

বঙ্গবন্ধুর সাফল্যের কথা এপারে যতটা না এসে পৌঁছেছে, মৃত্যুর খবরে ততটাই ধোঁয়াশা বেশিরভাগ পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনে। এখনও। তার কারণটা হয়তো এই যে, খোদ বাংলাদেশেই বহুদিন চেপে রাখা হয়েছিল এই ঘটনা। সৌজন্যে পরবর্তী সামরিক শাসন। এমনকি, বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পরের দিন ওদেশের খবরের কাগজগুলিও এ নিয়ে টুঁ-শব্দটি করেনি।

কেউ বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয়ে পড়তে চাইলে বিস্তৃত অনেক রেফারেন্স পাবেন ইন্টারনেটেই। সংক্ষেপে বলি এখানে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরবেলা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী মিলিটারি অফিসাররা সেনা নিয়ে আক্রমণ করে তাঁর বাড়ি। এই সেনা অভ্যুত্থান তথা আক্রমণের ফলে মারা যান বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের, বঙ্গবন্ধুর তিন ছেলে – শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল এবং দুই পুত্রবধূ। অন্যত্র অভিযান চালিয়ে হত্যা করা হয় তাঁর ভাগ্নে, ভগ্নীপতি ও তাঁদের পরিবারকেও। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে-সময় পশ্চিম জার্মানি-তে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

আরও পড়ুন
বঙ্গবন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘোষণা ইউনেস্কোর

প্রসঙ্গত, সেই সেনা অভ্যুত্থানের পরেই আটক করা হয় বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, সাবেক উপ-রাষ্টপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আ হ ম কামারুজ্জামানকে। তিন মাস পর, ৩ নভেম্বর তাঁদের হত্যা করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

আরও পড়ুন
কলকাতা বইমেলার প্রবেশদ্বারে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নকশা, চত্বরজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি!

বঙ্গবন্ধু-কে হত্যার পর, তাঁর বাড়ি সিল করে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন পর, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে স্বজনহারা শেখ হাসিনা ওই বাড়িতে প্রবেশ করেন। পরবর্তীকালে, ১৯৯৪ সালে শেখ হাসিনার উদ্যোগেই ধানমণ্ডির বাড়িটিকে ‘বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম’-এর রূপ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প

প্রত্যেকবছর ১৫ আগস্ট শোকদিবস পালন করা হয় বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয় ধানমণ্ডির ওই বাড়িতে। সেবার দুদিন আগেই হয়ে গেছে সেই শোক দিবস পালন। ১৭ আগস্ট, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে থাকাকালীন আমি যাই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও মিউজিয়াম দেখতে।

বাইরের রাস্তায় তখনও অনুষ্ঠানের ম্যারাপ খোলা হয়নি। কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে, অবশেষে বাড়ির চত্বরে প্রবেশ। মূল বাড়ির পিছনে তৈরি হয়েছে বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম। সেখানে তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা ও ছবি। আর মূল বাড়িটির কথা আগেই বলেছি। গুলির দাগ। সর্বত্র। তার মধ্যেই সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের ঘর, ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইত্যাদি। দর্শকরা চাইলে ঘুরে-ঘুরে দেখতে পারেন পুরোটাই। ছবি তোলার অনুমতি নেই। দেখতে পারেন বঙ্গবন্ধুর অফিসঘর, তাঁর ব্যবহৃত চশমা, পোশাক, বইপত্র, চুরুট, মুজিব-কোট – সবই।

আমার মস্তিষ্কে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছিল ও-বাড়ির দোতলা থেকে একতলায় যাওয়ার সিঁড়ি। শুনেছি, সেনারা তাঁর বাড়ি আক্রমণ করেছে শুনে বঙ্গবন্ধু নাকি বিশ্বাস করতে পারেননি। তাঁরই দেশের কয়েকজন তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে – কল্পনাতেও ভাবতে পারেননি। নিচ থেকে গুলির শব্দ শুনে, সেনাদের আটকানোর জন্য দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে যান তিনি। তখনই সেনাদের ছোঁড়া গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় তাঁকে। লুটিয়ে পড়েন সিঁড়িতে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালির কী করুণ সমাপ্তি!

দেখেছি, ওই সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে দেওয়া হয় না কাউকে। কাচ দিয়ে সযত্নে মুড়ে রাখা হয়েছে সিঁড়িটি। ছড়িয়ে আছে দু-দিন আগেকার গোলাপের পাঁপড়ি। সামনে, সিঁড়ির দেওয়ালে একটা বিশাল ছবি – গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সিঁড়িতে লুটিয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু। আর, যদি মন দিয়ে দেখেন, আপনিও দেখতে পাবেন, কাচের ভিতর দিয়ে – সিঁড়ির মধ্যে এখনও কালচে হয়ে আছে কয়েকটা দাগ। রক্তের। হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর রক্ত।

সেদিনের আর কোনো কথা বা অভিজ্ঞতা আমার মনে নেই। ১৫ আগস্টের কথা ভাবলে, ভারতের স্বাধীনতার পাশাপাশি আমার শুধু মনে পড়ে ওই সিঁড়িটার কথাও। নির্মম এক মৃত্যুর কথা। গোলাপের পাঁপড়িগুলোও যেন কাচ ভেদ করে ছায়া ফেলতে পারছে না সিঁড়িতে। উজ্জ্বল আলো, শ্রদ্ধার্ঘ্য – সমস্তকিছু ছাপিয়ে ফুটে আছে কালচে দাগ।

বঙ্গবন্ধু ভাই মনে করতেন গোটা জাতিকে। ১৫ আগস্ট, গুলিবিদ্ধ হওয়ার মুহূর্তে কি তাঁর সেই ধারণা বদলে গিয়েছিল? হত্যাকারীদের পাঁচজনের ফাঁসি হয়েছে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর পর, ২০১০ সালে। বাকি এখনও ১২ জন, যাদের মধ্যে ছ’জন পালিয়ে আছে বিদেশে। তারা কি এ-জীবনে আর শাস্তি পাবে? কী ভাবছে বাংলাদেশের আজকের প্রজন্ম?

Powered by Froala Editor