ঈর্ষাক্ষাৎকার: শুভদীপ চক্রবর্ত্তী — দ্বিতীয় পর্ব

শুভদীপ চক্রবর্ত্তীর জন্ম ১৯৮৭ সালে, বাটানগরে। বর্তমানে একটি বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। এই ঈর্ষাক্ষাৎকারটি আবর্তিত হয়েছে তাঁর ‘একটি শিশির বিন্দু: বজবজ ও বাটানগর অঞ্চলের ছুঁয়ে দেখা গল্প-কথা-রাজনীতি-ইতিহাস’ (প্রকাশসাল ২০২২) বইটিকে কেন্দ্র করে। কথোপকথনে শুভদীপের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব...

(প্রথম পর্বের পর...)

তন্ময়— বাটানগর এমন এক জায়গা, যেটা তৈরিই হল জুতো কারখানাকে কেন্দ্র করে। দিনে দিনে সেই কারখানাকে কেন্দ্র করেই সমৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি। বিশ শতকের মধ্যভাগে বাটানগরের যে-খ্যাতি ছিল, একুশ শতকে পৌঁছে সেটা কতটা ধরে রেখেছে বাটানগর? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ে এই যে-নামিদামি ব্র্যান্ডের এত আস্ফালন, তার প্রেক্ষিতে বাটার জুতো কতটা প্রাসঙ্গিক জনসাধারণের কাছে?

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— প্রথম প্রশ্নটা থেকে শুরু করি। ছোটো করে উত্তর দেওয়া যায় যে, বাটানগরের যে-ঐতিহ্য ছিল—ঐতিহ্য তো অনেক দূর, বাটানগরের যে-সৌন্দর্য ছিল, সেই সৌন্দর্য বলুন বা ঐতিহ্য—তার বিন্দুমাত্রও নেই! যদি আমি কোননগরের বাটা ফ্যাক্টরির কথা বাদ দিই— সেটা তো বাটার পুরদস্তুর কারখানা ছিল না! গোটা এশিয়াতে বাটার—এবং বাটা কোম্পানি নিজেও স্বীকার করে, গোটা এশিয়াতে বাটার মেজর মাদার ফ্যাক্টরি বাটানগরে। এবং এই বাটানগরের ফ্যাক্টরির সৌজন্যেই বাটা যে-পরিমাণ লাভ করে, তাতে সে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পারে পরবর্তীকালে। এই বাটা কোম্পানির সুবাদেই বাটানগরে নেহেরু এসেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছেন, মাদার টেরেসা এসেছেন এবং দলাই লামা এসেছেন। ভাবতে খুব আশ্চর্য লাগে সেই জায়গাটার ঐতিহাসিক ভ্যালুর কথা এখন আর কেউ মনে রাখে না। যেখানে নেহেরু বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেই বাটার মাঠ, বাটার স্টেডিয়াম এখন আর নেই। যে-স্টেডিয়ামে একদিন জামশেদ নাসিরি খেলে গিয়েছেন, কৃশানু দে, মানস ভট্টাচার্য খেলে গিয়েছেন। একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ কলকাতা ফুটবল লিগের খেলা এই মাঠে হয়েছে, কপিল দেব এই মাঠে খেলে গিয়েছেন, লতা মঙ্গেশকর গান গেয়েছেন। এই বাটার মাঠটা এখন আর নেই। সেখানে হাউসিং হচ্ছে। এবং গোটা বাটানগর-জুড়ে এখন খালি হাউসিং হচ্ছে। এবং বাটানগরের যে-স্থানিক বৈশিষ্ট্য সেগুলো আর কিছু নেই। স্থানিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাওয়া মানেই ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া। সৌন্দর্য তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে বাটানগরের, বাটানগরের ঐতিহ্যও এখন আর কিছু নেই। কেউ বলতে পারবে না আগে কী ছিল আর এখন কী আছে।

এবার দু-নম্বর প্রসঙ্গে আসি, বাটার জুতোর ব্যবসায়িক অবস্থা। বাটা একটা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। যদি আমি বিভিন্ন লোককে বলতে শুনি কলকাতার বা বিভিন্ন জায়গার—আমি নাম ধরেই বলছি—অনেকেই বলে শ্রীলেদার্স বা খাদিমস আসার পর বাটার ব্যবসা কমে গেছে। এটা খুবই অর্বাচীনের মতো কথা আরকি। কারণ, বাটার কাছে শ্রীলেদার্স বা খাদিমস ধোপেই টেকে না। বাটা পাত্তাই দেয় না এদেরকে। বাটার কম্পিটিটর ইভেন নাইকি বা অ্যাডিডাসও নয়। বাটা যে-ব্র্যান্ড তৈরি করে বা জুতো তৈরি করে সেটা খুবই কোয়ালিটি-সম্পন্ন জুতো কিন্তু সেটা মধ্যবিত্তদের সাধ্যের নাগালে। ফলে বাটার টার্গেট কাস্টোমার সম্পূর্ণ আলাদা। এবং বাটার কোম্পানি এমন এমন দেশে আছে বা এমন এমন জায়গায় আছে যেখানে বহুজাতিকরা ভাবতেও পারে না কোম্পানি খোলার কথা। বাংলাদেশে, পাকিস্তানে… ভারতে বাটার পাঁচটা ফ্যাক্টরি আছে, ফলে বাটার প্রোডাকশনটাই অন্যরকম। অন্যরকম টার্গেট কনসিউমারের জন্য। বাটা শুধু হাওয়াই চটিই নয়, হাওয়াই চটির ফিতেও তৈরি করে। শুধু বুট জুতো নয়, বুট জুতোর ফিতে তৈরি করে। ফলে এটা একটা সম্পূর্ণ অন্যধরনের ব্যবসায়িক পরিকাঠামো। এবং অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মতভাবে তৈরি হয় বলে বাটার জুতোর ক্ষয় কম। আমাদের ছোটোবেলাতে আমরা যেটা দেখেছি— আমার বড়দা, মানে আমার দাদাভাই যে-জুতো পরেছে, যে আমার থেকে চার বছরের বড়ো— তার জুতো ছোটো হয়ে গেলে সেই জুতো আমি পরেছি। আমার জুতো ছোটো হয়ে গেলে আমার ভাই পরেছে। তারপর জুতোটাকে সাজিয়ে রেখে দেওয়া হত যে, পরবর্তীকালে কারোর পায়ে সেট হলে তাকে দেওয়া হবে। পালিশ করলে একইরকম নতুনের মতো দেখতে লাগত। এটাই হচ্ছে বাটার ব্র্যান্ড ভ্যালু। সেটার সঙ্গে কমপিট করার মতো এখনও কেউ আসেনি।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— প্রথম পর্ব

তন্ময়— বাটানগরে বাটার ব্যবসার যেরকম রমরমা ছিল, এখনও তেমন আছে?

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— না, বাটার ব্যবসা আমি বাটানগর হিসাবে কেন দেখব?


তন্ময়— তাহলে বাটানগরের প্রেক্ষিতে তাদের অবস্থা কেমন?

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— বাটানগরে কিন্তু কোনোদিনই বাটা সেভাবে ব্যবসা করতে চায়নি। বাটানগর তৈরিই করেছে বাটা কোম্পানি। আমরা যেটা দেখেছি, এখন দেখছি বলব না— বাটানগর একটা ইউরোপিয়ান শহরের ট্যুইন সিটি, নামটা এক্ষুনি মনে পড়ছে না। যদি আমি আনুভূমিকভাবে দেখি, তবে এটা সম্পূর্ণভাবে পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা একটি শহর। এইটা আবার একটা বিতর্কিত ব্যাপার আরকি। তিন-চারটে নাম উঠে আসে। কিন্তু ঠিক কোন শহরটার আদলে তৈরি, সেটা কেউ বলতে পারে না। যদিও আমার বিশ্বাস—হয়তো কোনো শহরের কথা মাথায় রেখে প্ল্যান করা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ে বাটানগরের যে-ভৌগোলিক পরিস্থিতি ছিল—যে-কোনো জায়গায় পা মাটিতে বসে যাচ্ছে, এত নরম জায়গা। তো সেই জায়গাগুলো বুজিয়ে বুজিয়ে ওদের কাজ করতে শুরু করতে হয়। আমার মনে হয় না, আদৌ কোনো শহরের নকল ওরা করতে পেরেছিল বলে। নিজের মতো একটা শহর তৈরি হয়েছিল আরকি। উপর থেকে তোলা কিছু ছবি আমি পরবর্তীকালে দেখেছি— ছবি মতো সাজানো শহর। এবং যেভাবে বাটার কোয়ার্টারগুলো প্যারালালি একে-অন্যের সঙ্গে সাজানো, যেভাবে বাটার মাঠের ঘাস কাটা হত রেগুলার, যেখানে রীতিমতো এনকারেজ করা হত মানুষকে যে তোমরা বাইরে বেরোও… চারশো, পাঁচশো বছরের পুরনো গাছ— সেই গাছগুলো বাটা কোম্পানি রেখে দিয়েছিল, কয়েক বছর আগে পর্যন্তও ছিল। এই হাউসিং কমপ্লেক্স শুরু হওয়ার পর থেকে ওই প্রাচীন গাছগুলো আর দেখা যায় না। আমি বন্ধুদের মহলে দুঃখ করে বলতাম, যশোর রোডে গাছ কাটার জন্য এত প্রতিবাদ হচ্ছে, আন্দোলন হচ্ছে, আমাদের বাটানগরের এই সুপ্রাচীন পাঁচ-ছশো বছরের গাছগুলো কেটে ফেলা হল, কিন্তু কেউ কথাই বলল না এটা নিয়ে। আমরা একটা মৃতপ্রায় অঞ্চলে থাকি। গাছ মরে যাওয়া মানে, একটা অঞ্চলের বা সভ্যতার একটা সময় মরে যাওয়া। এবং সেটা নিয়ে কেউ প্রতিবাদও করল না।

বাটানগরে বাটার প্রোডাকশনের কথা যদি বলা হয়, তবে সেটা অনেকাংশে কমে গেছে। আমি যদি ২০০০ সাল ধরি, তাহলে তখন দশ হাজারের বেশি লোক কাজ করত। আমরা তখন স্কুলে পড়ি— বাটার কোম্পানি থেকে পিলপিল করে লোক বেরোচ্ছে, বেরিয়ে তারা কীভাবে অটো ধরে, বাস ধরে ফিরছে— এটা একটা দেখার মতো জিনিস ছিল আমাদের কাছে। এখন সেখানে সাকুল্যে বাটা কোম্পানিতে কাজ করে দেড় থেকে দু-হাজার লোক। এইটা একটা চূড়ান্ত বদল। পুঁজিবাদ ঘিরে ধরলে যেমন অবস্থা হয় একটা অঞ্চলের, উপর থেকে দেখলে সেটাই মনে হয়। আসলে সেটা নয়। ট্যাকটিক্যালি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রোডাকশন। এত বেশি ইউনিয়নের বায়না—আমার বাবা যেহেতু বাটায় চাকরি করতেন, এটা আমার সেই সূত্রে জানা। ওরা বিভিন্ন কারণে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে প্রোডাকশন সরিয়ে নিচ্ছে। বাটাগঞ্জ, বাটাপুর—এইসমস্ত জায়গায়। বাটানগরে বিশেষ কিছু জিনিস ছাড়া অন্যান্য প্রোডাকশন হয় না। তবুও বাটার যে-সোল, জুতোর সোল, বাটার যে-লেদার কাটা হয়— যে-লেদার দিয়ে জুতো তৈরি হয়— সেগুলো কিন্তু বাটানগরেই তৈরি হয়। সবথেকে বেসিক কোর যে-কাজগুলো সেগুলো কিন্তু এখনও বাটানগরেই হয়। প্রোডাকশনটা হয়তো অন্য জায়গা সরে গেছে, কিন্তু একদম প্রাথমিক কাজগুলো যেটা না-থাকলে পরবর্তী কাজটাই হবে না, সেটা কিন্তু বাটানগরেই হয়।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সোমা মুখোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব

তন্ময়— বজবজের শ্রমিক আন্দোলন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়-ও দীর্ঘদিন ছিলেন এই এলাকায়। ফলে ওই শ্রমিক আন্দোলনকে ঘিরে যে বামমনস্কতার পরিবেশ এককালে বজবজে গড়ে উঠেছিল, এখন তার কী হাল? শুধু তো বাটা নয়, ওই অঞ্চলে একাধিক কারখানাও গড়ে উঠেছিল— প্রশ্নটা এমন হতে পারে, বজবজ এককালে শিল্পনগরী ছিল এবং সেখানে বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলন একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। বর্তমানে বজবজের সেই শিল্পগুলো কী হাল এবং বাম-মনস্কতার কী অবস্থা সার্বিকভাবে?

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— কষ্টেরই প্রশ্ন আরকি। কষ্টের প্রশ্ন এই কারণে যে, বামমনস্কতার কথা উঠলেই এখন খারাপ লাগে। আমি প্রথম থেকে শুরু করি। আছু সাহেব মানে চিনারা বিভিন্ন সমস্যার কারণে যদি কলকাতার দিকে না-যেত, তাহলে হয়তো বজবজের আগে আছিপুরই একটা শিল্পাঞ্চল হিসাবে পরিচিতি পেত। মোটামুটি আমি যদি উনিশশো সালের পরবর্তী সময়কালটা ধরি—মানে আমি অছু সাহেবের সময়টা বাদ দিচ্ছি, তখন তো আর বাম-মানসিকতা ব্যাপারগুলো ছিল না। তখন ব্রিটিশরা ভারতে এসে গেছে এবং ব্রিটিশদের বিরোধী দল হচ্ছে জাতীয় কংগ্রেস। এবং জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ হচ্ছে। এবং ব্রিটিশরা এসে শিল্পও শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। শিল্পেতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করছে ভারতীয়রাই। ভারতীয় শ্রমিকরা, তাদের যে-দাবিদাওয়া থাকতে পারে, কথাগুলো থাকতে পারে, সেগুলো তখন থেকেই আস্তে আস্তে শুরু হচ্ছে। আমি যদি খুব ভুল না হই, তবে ১৮৯৫ সালেই প্রথম ধর্মঘট হয়ে যায় বজবজে। শ্রমিক ধর্মঘট। সেটা একদমই শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে। পরবর্তীতে সেই ধর্মঘটের আকার বাড়তে থাকে, প্রাবল্যও বাড়তে থাকে। এবং এই শ্রমিক ধর্মঘটের কারণেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র থেকে শুরু করে নজরুল ইসলাম—এঁদের সবার পদার্পণ ঘটেছিল বজবজে। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর—যিনি ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারিগর, যাঁকে পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে এক্সপেল করা হয়, তিনিও বজবজে আসতেন। এবং খুব ইন্টারেস্টিং একটা ফ্যাক্ট হচ্ছে, অনেক পরে বাটানগরের যে-জুতো কোম্পানি, তার যে-শ্রমিক ইউনিয়ন তৈরি হয়েছিল, সেই ইউনিয়নের অন্যতম নেতা ছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বজবজ নিয়ে লিখিত যে দু-চারটে বই এসেছে আমার নাগালে বা যে-লেখাগুলো নজরে এসেছে, সেই লেখাগুলোয় একটিতেও সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো রেফারেন্স নেই। নাম অবধি নেই। যাই হোক, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর বজবজের বা ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বড়ো নাম তো বটেই, উল্লেখযোগ্য একটি নাম। যাই হোক ১৯২৮ সালে সুভাষচন্দ্র প্রথম আসেন এখানে। তার আগে-পরে নজরুল। তখন নজরুল যে একের পর এক পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, কমিউনিস্ট-মনোভাবাপন্ন পত্রিকা, সেগুলো বজবজের শ্রমিকদের মধ্যে বিলি করা হচ্ছে। পরবর্তীকালে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো আসছেনই। এবং প্রবল সরকার বিরোধিতা—প্রথমে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধিতা এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধিতা—কেন তারা বলছে ‘এই স্বাধীনতা মিথ্যে’? কারণ তারা যুক্তি দিচ্ছে এই স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম, যেখানে স্বাধীনতার পরেও লোক না-খেতে পেয়ে মরবে, যে-স্বাধীনতার পরেও শ্রমিকদের আন্দোলন করতে হবে দুনিয়ার যত দাবির জন্য। আগে তো ইংরেজ সরকারের কাছে এইধরনের দাবিদাওয়া পেশ করতে হত। তবে এটা কীসের স্বাধীনতা? এটা মিথ্যে স্বাধীনতা। এখন বিভিন্ন আলোচনায় একটা দাবি ওঠে যে, বামপন্থীরা তো ভারতেরই বিপক্ষে, জাতীয়তাবাদেরই বিপক্ষে, ওরা তো বলবে স্বাধীনতা মিথ্যে। আমি যদি ওভারঅল কন্টেক্সটে না যাই, তাহলে… এই আঞ্চলিক কন্টেক্সটে ওদের যথেষ্ট যুক্তি ছিল এই স্বাধীনতাকে মিথ্যে বলার। সেটা ক্ষোভের কারণ। তাদের নিজস্ব যুক্তির কারণে…

যাই হোক, এই শ্রমিক আন্দোলনের জোরেই ১৯৫০ সালের পরবর্তীতে যে-নির্বাচন হয় সেখানে এই অঞ্চল থেকে বামপন্থী প্রার্থী জয়লাভ করেন। বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়। পর পর দুটো টার্মে উনি বজবজ থেকে জয়লাভ করেছিলেন। সেটা শুধুমাত্র কিন্তু বামমনস্কতার জন্য নয়। ধারাবাহিক আন্দোলনের জন্য। যেটা স্বাধীনতার ইমিডিয়েট আগে থেকে নয়, প্রায় ৩০-৪০ বছরের ধারাবাহিক বাম-আন্দোলন চলার পর জায়গাটা প্রায় লালদুর্গে পরিণত হয়। তার পিছনে একটা দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস ছিল, দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস ছিল। যে-আঙ্গিকে প্রচার করা হত, যেভাবে শ্রমিকদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলা হত—শুধুমাত্র চটকলের শ্রমিক নয়, বজবজে তখন রেল একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, সেই রেল শ্রমিকদের মধ্যে আন্দোলন, চটকলের শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন, চাষি—এখানে তখন পাট চাষ হয়, তাদের নিয়ে আন্দোলন—এই একাধিক আন্দোলনের সঙ্গে তখন বজবজ জড়িত। এবং ভারতের যে লাল বিপ্লব বা কমিউনিস্ট পার্টিকে নিয়ে যত বই লেখা হোক না-কেন বা প্রাচীনকালে যে বই লেখা হয়েছে, সেখানে বজবজের এই প্রাথমিক আন্দোলনের সময়টুকু বাদ দিয়ে কোনো বই লেখা যায়ও না। তাই বজবজের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কথা সব বইতেই লেখা আছে।

আরেকটা জায়গা আমি মিস করে গেলাম। পেট্রোলিয়াম শিল্প। যেটা মূল শিল্প বজবজের। মানে যার সুবাদে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর এখানে পা রাখা, পেট্রোলিয়াম শিল্পের শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার কারণে। এতরকম শিল্প একটা জায়গায়, এতরকম শ্রমিক একটা জায়গায়, ফলে তাদের দাবিদাওয়া বা অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে, সেখানে হয়তো বামপন্থী আন্দোলন গড়ে ওঠা অবশ্যম্ভাবী ছিল।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সোমা মুখোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— বর্তমানে সেই ধারাটা কি বজায় রয়েছে এখনও?

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— বর্তমানে বামপন্থী আন্দোলন এখানে প্রায় কিছু নেই। নজরুলের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে একটি জায়গায়। নজরুলের মূর্তিটা কোথায়, সেটা খুঁজতে আমাদের চারদিন ঘোরাঘুরি করতে হয়েছিল। সেই মূর্তিটা একটা পার্টি অফিসের পিছনে ঢাকা পড়ে আছে। যেটা প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। আন্দাজ পাওয়া যায় যে, নজরুল ওই জায়গাতেই বা ওর আশেপাশেই বসবাস করতেন। সেই বাড়িটা আর নেই নিশ্চয়ই কিন্তু জায়গাটাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কোথায় থাকতেন, সেটা সিপিআইএম পার্টি অফিস থেকেও বলতে পারেনি। খুব বেশিদিন আগের কথা কিন্তু নয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিন্তু আধুনিক ইতিহাস। তিনি বজবজের কোন বাড়িটায় থেকে গেছেন, দীর্ঘদিন কাব্যচর্চা করেছেন—সিপিআইএম পার্টি অফিস থেকে কেউ বলতে পারছে না। আমরা অনেক খুঁজে, অনেক পরে সেই বাড়িটা পেয়েছি। অদ্ভুতভাবে যাঁরা এই খোঁজটা দিয়েছেন, তাঁরা কিন্তু একদমই স্কুলের গণ্ডিতে পা না-দেওয়া লোক। ‘সুভাষকাকা?’—এভাবে বলছেন বয়স্ক একটা লোক। মানে ওইরকম আত্মীয় সম্পর্ক। কিন্তু পার্টি অফিস থেকে বলতে পারছে না। ফলত, বাম-মনস্কতা এখানে নেই। আমি জানি না এটা বলা উচিত হবে কিনা, বামপন্থার প্রভাব অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তার একটা কারণ সিপিআইএম বা বামদলের নিজস্ব ভুলভ্রান্তি। আরেকটা কারণ হচ্ছে বামদলের নিজস্ব ইতিহাস চেতনার অভাব।


তন্ময়— বহির্বিশ্বে বা বহির্বঙ্গেও বজবজের অন্যতম পরিচয় তো শিল্পনগরী হিসাবে। সেই শিল্পের কী অবস্থা বর্তমানে? সেই সমস্ত কল-কারখানাগুলোর কী অবস্থা বর্তমানে?

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— প্রাচীন চটকল শিল্পের মধ্যে এখন একটা-দুটো খুঁজে পাওয়া যায়। তাও খুব কষ্ট করে খুঁজে পেতে হয়। কারণ বহুবার মালিকানা বদলেছে, নাম বদলেছে। নিউ সেন্ট্রাল জুট মিল—সেটার আকার বা আয়তন দেখলে আশ্চর্য হতে হয়! অন্ততপক্ষে দু-কিলোমিটার জায়গা জুড়ে একটা জুটমিল ছিল, আন্দাজ পাওয়া যায় এখনকার চেহারা দেখলে। সেই জুটমিলটার ভিতরেও এখন হাউসিং কমপ্লেক্স হচ্ছে। একটা গোটা এলাকাজুড়ে শুধু এখন হাউসিং কমপ্লেক্স হচ্ছে। সেখানে, হাউসিং কমপ্লেক্সের আগে বিশাল বড়ো বড়ো করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি আটকানো, সাংসদের। একদম গঙ্গা-ফেসিং। প্রচণ্ড দামি হাউসিং কমপ্লেক্স। কিন্তু সেই চটকলগুলো নেই। সেই চটকলের ইতিহাস আমি এখন আর বলছি না। মানে সেই চটকলগুলো ’১৩, ’১৪, ’১৫ সাল অবধিও— ২০১১ সালেও ১৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল রিভাইভালের জন্য। কিন্তু সেই টাকা কোথায় গেল, কেন সেই রিভাইভাল হল না—সেগুলো অন্য প্রশ্ন। সেই আলোচনার জায়গা নেই এখানে। কিন্তু শিল্পের অবস্থা খারাপ। দু-একটি চটকল খুঁজে পাওয়া যায়। তাও সেগুলোর নাম আগের নাম নেই, নতুন নামে। খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে এখানে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার স্টোরেজ আছে। এফসিআই-এর। ওই স্টোরেজের জন্যই এখনও ট্রেন চলে। যাত্রীবাহী ট্রেন নয়, মালবাহী ট্রেন। ওগুলো করে ফুড গ্রেইন আসে। কয়লাও নির্বিচারে চুরি হয়—সিইএসসি-র কয়লা। সব জানে পুলিশ বা প্রশাসন। কিন্তু সেগুলোর কেউ কিছু দায় নেয় না। ফলে এফসিআই-ও চাইছে এখান থেকে স্টোরেজ কমাতে। কারণ, তারা লোকসান কেনই বা সহ্য করবে? ফলে যত শিল্পবান্ধব পরিস্থিতি তৈরির অনুকূলতা কমছে, তত বেশি শিল্প এখান থেকে সরছে। এখন প্রায় এই এলাকায় কোনো শিল্প নেই। পেট্রোলিয়াম শিল্প অবশ্যই আছে। তবে সেটা প্রোডাকশন নয়, স্টোরেজের জন্য। যেহেতু প্রাচীনকাল থেকেই এখানে লোকেশনগুলো তৈরি, ফলে হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়াম হোক, ইন্ডিয়ান অয়েল হোক— এদের সবচেয়ে বড়ো বড়ো স্টোরেজগুলো এইসমস্ত এলাকায়। হালে হয়তো কিছু রেলের প্রোজেক্ট এখানে হচ্ছে। কিন্তু শিল্প প্রোডাকশন হচ্ছে না। আমি তো বাড়ি তৈরি করাটাকে বা হাউসিং কমপ্লেক্সটাকে ইন্ডাস্ট্রি বলব না। 

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব

তন্ময়— আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে আমরা যে-সমস্ত বই দেখি, সেগুলোয় মূলত দুটো ধারা দেখা যায়। এক, তথ্য সংগ্রহ এবং সেই তথ্য বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনা। আরেকটা হচ্ছে, যেহেতু আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অধিকাংশ জায়গাতেই যাঁরা লেখক তাঁরা সেই জায়গার অধিবাসী হন, ফলে অতিরিক্ত আবেগ জড়িয়ে যায় লেখায়। এবং তথ্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথন, দর্শন ইত্যাদি মিশে লেখাগুলো খুব একটা সুপাঠ্য হয়ে ওঠে না। না-হয় আঞ্চলিক ইতিহাস, না-হয় সুন্দর গদ্য। কিন্তু এই বইটার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আঞ্চলিক ইতিহাস লেখার যে-পথ বেছে নেওয়া হয়েছে, সেখানে ইতিহাস তো বলা হচ্ছেই, তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও আসছে। আপনার মতে আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অ্যানেকডোটের আশ্রয় নেওয়া কতটা প্রাসঙ্গিক?

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— দেখো, এই অ্যাপ্রোচে আঞ্চলিক ইতিহাস লেখা উচিত কিনা, আমি সেটা বলার কেউ নই। এবার এখানে অস্বীকারের কোনো জায়গা নেই, আমি তো নিছক ইতিহাস লিখতে চাইনি। আমি নিজের জন্য ইতিহাসটা জানতে চেয়েছিলাম। আমার কোনো দায় ছিল না অন্য কাউকে জানানোর। এবং আমি এটা ভাবতেই পারিনি যে আমাকে এটা লিখতে হবে। এটা প্রথম কারণ। আমি ভাবতেই পারিনি যে এতগুলো কথা এখানে আর কেউ জানে না, যেটা আমিই হয়তো প্রথমবার বলব। যেমন, অনুরূপচন্দ্র সেনের কথা বা রবীন্দ্রনাথের বই যিনি প্রকাশ করছেন—এমন একজন লোক বজবজের, যাঁর বাড়িতে প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশের মতো লোকেরা আসছেন আড্ডা মারতে। এঁদের কথা যে আর কেউ বলবে না, সেটা বুঝতে পারা তো একটু মুশকিলের। আমি ইতিহাসের বই লিখতে চাইনি। যখন খোঁজটা করা শুরু হল, তখন আমি দেখলাম এগুলো কোথাও পাচ্ছি না, ফলে আমাকেই ডকুমেন্ট করতে হবে। নিজের মতো। শুধু ইতিহাসগুলো একের পর এক লিখতে থাকি এইটা মনে করে যে যখন সেখানে কমপ্লিট এভিডেন্স বা সবকিছু সেখানে জোগাড় হয়ে যাবে তখন সেগুলোকে আমি ব্লগ পেজে প্রকাশ করব। এবার যেটা হয়, বেশ কিছুটা লিখে ফেলার পর যখন আমি কয়েকজনকে পড়াই, বিশেষ করে আমার মাস্টারমশাইদের বা অন্যদের কাউকে— তখন তাঁরা বলেন যে তুই আরও একটু লেখ, আরও একটু ভেতরে ঢোক। এবং প্রাথমিক ইতিহাসের কাজটুকু একটা জায়গায় পৌঁছানোর পর—মানে আমি যদি একদম প্রাচীনকাল থেকে শুরু করি, যদি বজবজের নামকরণের গোড়ার দিকে, ১৭৫৫-৫৬ সাল থেকে ধরি, আমি হয়তো সেখান থেকে উনিশ শতকের গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি। তখন আমার মনে হয় যে, এই যে আমি ঘুরছি, আমি প্রায় প্রতিদিন ঘুরছি, ঘুরে এসে যেটুকু পাচ্ছি… এই যে জার্নিটা, এই যে খোঁজটা হচ্ছে—যদিও আমার বলতে অসুবিধা নেই যে আমার খুব বেশি পাঠক নেই, খুব বেশি লোকজন পড়ে না বা জানে না, কিন্তু তাদের কেন আমি আমার এই জার্নির মধ্যে আনব না?

আমি তখন একটা অ্যাপ্রোচ নিলাম। যখন কোনো হেরিটেজ ওয়াক হয়, সেখানে যে অ্যাপ্রোচটা নেওয়া হয়, সেইরকমভাবে কথা বলে বলে দেখানোর মতো—মানে ব্যাপারটা আমি আসলে ভিস্যুয়ালাইজ করাতে চেষ্টা করলাম। শুকনো ইতিহাস নয়। আমি অ্যাকাডেমিক্সের মতো করে রাখতে চাইলাম না। সেটা আমার একটু বোরিং মনে হয়েছিল। যে-ইতিহাসটা যদি অন্যভাবে বলা যায়। তখন আমি অন্য আঙ্গিকে লিখতে শুরু করলাম পুরো জিনিসটাকে। এবং এই বইয়ের প্রত্যেকটা ঘটনা, প্রত্যেকটা চরিত্র সত্য। এবং দেখলাম শুধু ইতিহাস কেন, যেহেতু এটা একটা প্রায় অজানা অঞ্চল— বিশেষ করে এখনকার সময়ে শিল্পসমৃদ্ধিটা আর আগের মতো নেই—তাই এমন একটা ভুলতে বসা অঞ্চলের, যেখানের লোকজনদের ইতিহাস চেতনা নেই, স্থানিক চেতনা নেই, সেই জায়গাটার বর্তমানটা কেন তুলে ধরব না? তাই ইতিহাস ও বর্তমানের মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরির চেষ্টা করা হল। এবং ইন দ্য মিন টাইম, আমার ব্যক্তিগত জীবনে যে-সব ঘটনা ঘটে— আমার মা মারা যান। ওই সময়ে আমি বেশি লিখতে পারিনি। তারপর যখন আমি নতুন করে বইটা লিখতে বসি একদম অন্য একটা পরিবেশে, মনস্তাত্ত্বিক অবস্থায়, তখন একদম প্রথম থেকে বইটা আমি লিখি। এবং তখন লেখাটা সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। লেখাটা অন্য কিছু একটা হয়ে যায়। সেটা ব্যক্তিগত লেখা হয় নাকি ইতিহাসচর্চা হয়ে দাঁড়ায়, সেটা আমি আর বুঝতে পারিনি। কিন্তু ওই সময়ে আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করিনি। ওই সময়টায় আমি একটানা লিখেছি দেড়-দু-মাস। আর আমি যেটা চেষ্টা করেছি সেটা হচ্ছে, পুরোটা বইটা লেখা হয়ে যাওয়ার পর একটা ভাষা তৈরি করার।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— শুধু আঞ্চলিক ইতিহাসের উপস্থাপনা নয়, এটা একটা প্যারালালি গদ্যগ্রন্থ গড়ে ওঠার দিকেও এগিয়েছে।

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— অ্যাকচুয়ালি তাই। আমি চেষ্টা করেছি যে, শুধু ইতিহাসটা নয়, ইতিহাস অনুসন্ধানটা লোকে জানুক। এবং একজন থার্ড পার্সন হয়ে নিজেকে দেখা… মানে তিনটে টাইমলাইন মেনটেইন করা—একটা আগেকার টাইমলাইন, একটা এখনকার টাইমলাইন এবং আরেকজন যে পুরো বিষয়টাকে দেখছে তৃতীয় পুরুষ হয়ে।


তন্ময়— তবে নিঃসন্দেহে এই জাতীয় লেখার ধাঁচ ইতিহাস কেন্দ্রিক উপন্যাসে হয়তো হয়। কিন্তু এটাকে যখন উপন্যাস হিসাবেও দাবি করা হচ্ছে না, ভেতরের কনটেক্সট হচ্ছে মূলত আঞ্চলিক ইতিহাসই, কিন্তু সেখানে এরকম ব্যক্তিগত গদ্যের মোড়কে ব্যাপারটাকে উপস্থাপিত করা দুর্লভ, সমস্ত জায়গার ক্ষেত্রেই।

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— আমি কিন্তু খুব সচেতনভাবেই এটা করিনি। আমি সেটা দাবি করব না যে আমি এটা জেনে-বুঝে এমনটা করেছি। কিন্তু আমার যেটা হয়েছিল—যদি দুটো উদাহরণ দিই, তাহলে বোঝা যাবে। আমরা কিছুতেই বজবজ দুর্গটা লোকেট করতে পারছিলাম না। বজবজ দুর্গ তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়—বজবজ দুর্গ না-হলে পলাশির যুদ্ধ হয় না, পলাশির যুদ্ধ না-হলে হয়তো বাংলার ইতিহাসটাকেই অন্যভাবে লিখতে হত। ওইটাই ছিল ট্রিগার পয়েন্ট যে, ইতিহাস বদলে দেওয়ার মতো একটা ঘটনা এখানে ঘটেছিল কিন্তু সেই ঘটনাটার কোনো রেফারেন্স থাকবে না? এখনকার কেউ সেটা জানবে না? দুর্গটাই বা কোথায় ছিল? তার কিছু-না-কিছু তো থাকবেই। দুর্গটাকে লোকেট করার প্রথম চেষ্টা হয়। এবং তিন-চারদিন ঘোরার পর আমরা মোটামুটি বুঝতে পারি যে দুর্গটা এই জায়গায় ছিল। তারপর মূল রাস্তায়—এখন যেটা বজবজ ট্রাঙ্ক রোড, কলকাতা থেকে যে-রাস্তাটা আছিপুর বা বজবজের দিকে যাচ্ছে—ওই রাস্তা দিয়ে ক্লাইভ ঘোড়ার পিঠে বা হাতির পিঠে চেপে ফেরত গিয়েছিলেন কলকাতায়। ওইখানে দাঁড়িয়ে, এখন যেটাকে প্যায়েস্টার মোড় বলে, আমার একটা ট্রান্সের মতো হয় ওখানে। মানে বজবজ দুর্গ থেকে দাঁড়িয়ে প্যায়েস্টার মোড় পর্যন্ত পৌঁছেছি আমি, অটো ধরব বা ট্রেন ধরব, একটা ট্রান্সের মতো হয়ে আমার কাছে প্রেজেন্ট টাইমটা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আমি মনে হচ্ছে, আমি চোখের সামনে দেখছি এখান দিয়ে ক্লাইভ ফিরছে। যদিও তখন সন্ধেবেলা কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বিকেলবেলা, রোদটা পড়ব পড়ব করছে, শীতের কাল। এবং ওই যে প্রত্যেকটা হাতি বা ঘোড়া চলে যাচ্ছে, তাদের পায়ের সঙ্গে সঙ্গে ধুলোটা উড়ছে, ওই ধুলোটা আসলে দিগন্তের আকাশে সূর্যটাকে আরও ধূলিধূসরিত করে দিচ্ছে। বা আমাদের ইতিহাসটা ধূলিধূসরিত হয়ে যাচ্ছে, আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে।

এই ট্রান্সটা আমার প্রথমদিনই হয়। তারপর থেকেই বর্তমান-অতীত, বর্তমান-অতীত— এই জার্নিটা ওইখান থেকেই শুরু হয় আরকি। সুভাষ উদ্যানে দাঁড়িয়ে একই ব্যাপার হয় আমার। এটাই সুভাষ উদ্যান? এখানেই সুভাষচন্দ্র বসু দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন? এবং সেখানে কংগ্রেসের সঙ্গে ওঁর অসুবিধা চলছে বলে লোকাল কংগ্রেসের যে-নেতা, তিনি নাকি ওই ভিড়ের মধ্যে ষাঁড় ছেড়ে দিয়েছিলেন। যেন ওই মিটিংটা ভেস্তে যায়। তখন আমার আরেকটা ট্রান্স হয়। আমি যেন, চোখের সামনে দেখছি সুভাষচন্দ্র বসু বক্তৃতা দিচ্ছেন আমার সামনে। আমি তখন লোকাল লোকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি যে, এই মাঠে কী হয়েছিল? সেটা বইতেও কিছু আছে। যেকোনো বয়সি লোকের সঙ্গে কথা বলি। আমি আদতেই বোঝার চেষ্টা করি আদতে এই ইতিহাসটার কতটা ভ্যালু আছে এখনকার লোকের কাছে। বা আদৌ কোনো ভ্যালু আছে কিনা। একটা বাচ্চাও আমার মুখের ওপর বলে যে, এই বাড়িতে কেন থাকত? এখান থেকে ভবানীপুর কতটুকু আর? বাড়ি চলে গেলেই পারত। মানে সুভাষচন্দ্র বসুর বাড়ি ভবানীপুরে, তিনি কেন বজবজে থাকতে যেতেন খামোকা? ওর কাছে এটার কোনো ভ্যালুই নেই। আমি জোর করে তাকে এটা গেলাতে পারব না। ও জানেই না নজরুল কে। এটাও একটা চেষ্টা ছিল…

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কমল চৌধুরী

তন্ময়— বুঝেছি। তার মানে সামগ্রিকভাবে এটাই যে ব্যক্তিগত জার্নিটাকেও ইতিহাসের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া। যাতে পাঠকও লেখাটার সঙ্গে সঙ্গে এলাকাটায় ঘুরে বেড়াতে পারে।

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— হেরিটেজ ওয়াক একটা আইডিয়া ছিল আমার মাথায়। সেটা যেরকম হয়। হেরিটেজ ওয়াক আমার খুব পছন্দের জিনিস একটা। আমি কিছুটা সেটাকে আনতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পরবর্তীকালে অন্য একভাবে এখানে এসে যায়।

(সমাপ্ত)

অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor