ঈর্ষাক্ষাৎকার: কমল চৌধুরী

কমল চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৭ সালে, খুলনায়। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে আগমন। অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে বারাসতের বাসিন্দা। পেশাদার জীবনে ছিলেন সাংবাদিক। বর্তমান ‘ঈর্ষাক্ষাৎকার’-টি তাঁর প্রথম দুটি বই—‘উত্তর চব্বিশ পরগণার ইতিবৃত্ত ও ‘দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ইতিবৃত্ত’-কে (দুটি বইয়েরই প্রকাশকাল ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ তিনি, স্মৃতিতেও থাবা বসিয়েছে সময়। তারপরও, উদ্ধার করা গেল অমূল্য কিছু অভিজ্ঞতা। কথোপকথনে কমলের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য।


তন্ময়— বিশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যেই আশেপাশের অনেকগুলো জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস লেখা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চব্বিশ পরগনার ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রথম উল্লেখযোগ্য বই আপনারই, ’৮৭ সালে প্রকাশিত। এর আগে চব্বিশ পরগনা নিয়ে (অখণ্ড) কেউ সেভাবে উৎসাহী হননি কেন?

কমল চৌধুরী— উৎসাহী হননি কেন, সেটা আমি বলতে পারব না ঠিক। সেরকম কৌতূহলী কোনো লোকই সে-আমলে দেখিনি আমি। হয়তো অখণ্ড চব্বিশ পরগনা এত বিস্তৃত ও বৈচিত্রসম্পন্ন জেলা যে, কাজটা করা মুশকিলই ছিল।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — প্রথম পর্ব

তন্ময়— আপনার চব্বিশ পরগনার ইতিহাস লেখার প্রস্তুতি কীরকম ছিল? কীভাবেই-বা মাথায় এল এই পরিকল্পনা?

কমল চৌধুরী— যেহেতু আমি উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসতে থাকতাম, স্বাভাবিকভাবেই নিজের জেলার ইতিহাসের প্রতি কৌতূহল বাড়তে থাকে। ষাটের শেষ বা সত্তরের দশকের শুরু থেকে খোঁজ শুরু হয় আমার। নিজের উদ্যোগেই যা-কিছু করা। খুব বেশি মানুষ সাহায্য করেননি। আমিই ঘুরে-ঘুরে জোগাড় করেছিলাম অনেক তথ্য। মাঝে অবশ্য বিভিন্ন সমস্যায় এই কাজ থেমে ছিল বেশ-কিছু বছর। অবশেষে, ১৯৮৬ সালে অখণ্ড ২৪ পরগনা দুই ভাগে ভাগ হওয়ার পর, দুটি পৃথক জেলা নিয়ে দুটি বই প্রকাশের চিন্তা মাথায় আসে। এমন চিন্তার একটাই কারণ ছিল, যে, চব্বিশ পরগনার ইতিহাসের কোনো উল্লেখযোগ্য বই-ই নেই তখনো পর্যন্ত। যেহেতু আমি নিজে এখানে থাকি, ফলে, এর ইতিহাস লেখার তাগিদ বেড়ে ওঠে ক্রমশ।


তন্ময়— পাঠকরা আপনার বই পড়ে থাকলেও, আপনার অর্থাৎ ব্যক্তি কমল চৌধুরী সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানে না। আপনার জীবনরেখা যদি একটু বলেন…

কমল চৌধুরী— আমার জন্ম ১৯৩৭ সালে, খুলনায়। দেশভাগের আগের দিন, বাবা এপারে চলে আসেন। কলকাতায় আমার পিসির বাড়ি ছিল, সেখানেই উঠি আমরা। স্কুল ফাইনাল কলকাতা থেকেই। বঙ্গবাসী কলেজে পড়াশোনা। ততদিনে অবশ্য বারাসতে চলে এসেছি আমরা। তারপর সাপ্তাহিক 'অমৃত' পত্রিকা ও দৈনিক ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কর্মজীবন। সেই থেকে যুগান্তর উঠে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সে-পত্রিকাতেই ছিলাম। যুগান্তর উঠে গেলে, কয়েক বছর পর ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ যোগ দিই। শেষে, ২০০৩ সালে সেখান থেকেই অবসরগ্রহণ। ইতিমধ্যে একের পর এক বইয়ের কাজ তো চলেইছে! তবে আমার প্রথম বই ওই ’৮৭ সালেই, চব্বিশ পরগনা নিয়ে। ওই কাজই আমাকে পরবর্তী কাজগুলোর দিকে এগিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— আপনি নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়া, হুগলি এমনকি ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট—অনেক জেলার ইতিহাসের বই সম্পাদনা করেছেন। এই বইগুলো সম্পাদনার পিছনে কোন ভাবনা কাজ করেছিল?

কমল চৌধুরী— আমার সম্পাদিত বইয়ের ভেতরে একাধিক বই ও প্রবন্ধ সংকলিত আছে। সেই বইগুলো পূর্বপ্রকাশিত হলেও, এইসব বই আর পাওয়া যেত না। দুষ্প্রাপ্যই বলা চলে। অন্যদিকে দেশভাগ হয়ে যাওয়ার পরে, ওপারের বাঙালিরাও আর পুরনো বইগুলো ঘাটত না। সেইসব বই খুঁজে বের করে—বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, অন্যান্য লাইব্রেরি কিংবা আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে— সেগুলো উদ্ধার করে আমি প্রকাশ করার চেষ্টা করলাম। মূলত আঞ্চলিক ইতিহাসের হারিয়ে-যাওয়া নথিগুলোকেই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা।


তন্ময়— একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জনপদের ইতিহাস লেখা একরকম। আর একটা সম্পূর্ণ জেলার ইতিহাস লেখা অনেকটাই আলাদা। দ্বিতীয়টি কতটা শ্রমসাপেক্ষ বলে আপনার মনে হয়?

কমল চৌধুরী— শ্রমসাপেক্ষ তো বটেই! তবে অসম্ভব কিছুই না। আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করলে বোঝা যায়, জানা যায়। ঘুরতে হয়, দেখতে হয়, লোকের সঙ্গে মিশতে হয়। এভাবেই আস্তে আস্তে সমস্ত অজানা হাতের মুঠোয় চলে আসে। এই যেমন আমি, এককালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর ঘুরেছি। উত্তরেও তাই। পরিমাণে কম, কেন-না এখানে নিজেই থাকতাম, আগে থাকতেই জানা-বোঝা ছিল। কিন্তু দক্ষিণ আমার একেবারে দেখা ছিল না। সেটা আমি পুরোটা ঘুরেছি সত্তর-আশির দশকে।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — প্রথম পর্ব

তন্ময়— আপনার কি মনে হয়, যে, দুই চব্বিশ পরগনার মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র বা ইতিহাসের দিক থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা অধিক সমৃদ্ধ?

কমল চৌধুরী— হ্যাঁ, অধিক সমৃদ্ধ। এটা ঠিক। দক্ষিণে যে বৈচিত্রের সমাবেশ—সুন্দরবন অঞ্চল সহ, উত্তরে তা অপেক্ষাকৃত কম।


তন্ময়— আপনার এই কাজে নদীর ভূমিকা অপরিসীম। আপনি বইয়ে উত্তর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার নদনদী, খালবিল, নদীর গতিপথ, নদীগুলি বর্তমানে কেমন আছে ইত্যাদি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। এই নদী অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল?

কমল চৌধুরী— নদী আমাকে ছেলেবেলা থেকে আকর্ষণ করত। খুলনায় আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল একদম নদীর পাড়েই। নদীটির নাম—চিত্রা। এমনকি, মামার বাড়িতেও যেতাম নদীপথেই। বিস্তৃত ও বিরাট এক নদী। সেখান থেকেই নদীর প্রতি ভালোবাসা শুরু। তা ছড়িয়ে যায় এপারে এসেও। এখানকার নদীগুলি বেশ-খানিকটা ঘুরে-ঘুরে দেখেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি। সেইসঙ্গে বই পড়েও অনেক তথ্য পাওয়া। সব মিলিয়েই হয়ে গিয়েছিল কাজটা।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— আপনার বইয়ের ভূমিকায় আপনি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছিলেন—’৪৭ সাল অর্থাৎ দেশভাগের পরে উদ্বাস্তুরা আসায় চব্বিশ পরগনা যেন একটা ‘নতুন’ জেলা হয়ে গেল। উদ্বাস্তু আগমন চব্বিশ পরগনাকে কতটা বদলে দিল?

কমল চৌধুরী— আমূল বদলে দিল। চারদিকে ঘরবাড়ি তৈরি হল নতুন নতুন। বসতি তৈরি হল। মানুষজন বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ীভাবে থাকার চেষ্টা করল। ফলে, জেলার মৌলিক চরিত্রটা বদলে তো গেলই, অন্য জায়গার মানুষ এসে বাসিন্দা হওয়ায়, জেলাটাও যেন নতুন পরিচয়ে সেজে উঠল। এ-ও এক ইতিহাস; হয়তো লেখা হয়েছে বা হবে কখনো।


তন্ময়— ’৮৬ সালে এই যে চব্বিশ পরগনার বিভাজন হল—সেই বিভাজনটা কতটা প্রাসঙ্গিক ছিল? আদৌ কি দরকার ছিল বিভাজন হওয়ার?

কমল চৌধুরী— হ্যাঁ, দরকার ছিল। কারণ, প্রশাসনিক এলাকা বিরাট হয়ে গিয়েছিল। সেই বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে উত্তরের এই সীমানা পর্যন্ত—এটাকে ভাগ না-করে কোনো উপায়ও ছিল না।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় — প্রথম পর্ব

তন্ময়— আপনি এত বছর ধরে, এত জেলার ইতিহাস নিয়ে কাজ করলেন। কমল চৌধুরীর বই অনেকেই পড়েছে। কিন্তু ব্যক্তি কমল চৌধুরীকে খুব কম মানুষ চেনে। এতে কি আপনার কোনো আফসোস হয়? বা এমন মনে হয়, যে, আপনার কাজের যথাযথ মূল্যায়ন হল না?

কমল চৌধুরী— না, আমার তেমনটা মনে হয় না। আমি কোনোদিন চিন্তা করিনি। ফলে কোনো ক্ষোভও নেই। তবে এই যে বাংলাদেশের জেলাগুলো নিয়ে আমার সম্পাদিত বই, সেগুলো পড়ে ওখানকার মানুষজন যোগাযোগ করেছে অনেকবার। ওদিকের লোকেরা এসব নিয়ে অনেক বেশি অনেক বেশি আগ্রহী দেখলাম। আর চব্বিশ পরগনা নিয়ে আমার কাজগুলোতে জেলার লোকের কোনো আগ্রহ আছে বলে তো মনে হয় না। কেউ আসেও না। কেউ খবরও নেয় না। কিছুই না।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— ভবিষ্যতে যারা আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে চায়, তাদের আপনি একজন অগ্রজ ইতিহাসকার হিসাবে কী পরামর্শ দিতে চান?

কমল চৌধুরী— নতুন করে ও ভালোভাবে লিখতে হবে। পড়তে হবে। জানতে হবে। এই যে একটা জেলার বিভিন্ন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিক, সেগুলো নিয়েও বিস্তৃত আলোচনা ও কাজের দরকার। পরিশ্রম ছাড়া হবে না কিছুই।


তন্ময়— আপনি তো এখনো নিয়মিত লেখালিখি করছেন। এখনকার বিষয়ও কি ইতিহাস নিয়েই? আপনার সার্বিক কাজকর্ম কি ইতিহাসকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে?

কমল চৌধুরী— হ্যাঁ। সামনে যে তিন-চারটে বই বেরোবে, সবগুলোই কলকাতার ইতিহাস নিয়ে। ‘কলকাতার বণিক সমাজ’—একটা বইয়ের নাম দিয়েছি। তারপরে আরেকটা বই লিখেছি ‘স্মৃতির শহর কলকাতা’। এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু-কিছু ব্যাপার আসছে চব্বিশ পরগনারও। চব্বিশ পরগনাকে বাদ দিয়ে কিন্তু কলকাতা চলেনি কোনোদিনই। এ-কথাটাও মনে রাখতে হবে সবাইকে।

(সমাপ্ত)

অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor