উদ্ভট আবিষ্কারের জন্য পাওয়া যায় ‘নোবেল’, জোগাবে চিন্তার রসদও

বিজ্ঞান গবেষণায় সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার কোনটি? কেন, নোবেল পুরস্কার! বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিত্যনতুন উদ্ভাবন ও অবদানের জন্য প্রতিবছর নোবেল কমিটি বেছে নেন কৃতী বিজ্ঞানীদের। সাহিত্য, শান্তি-সহ বিভিন্ন শাখার যোগ্যরাও পান এই পুরস্কার। কিন্তু আরেকটি নোবেল পুরস্কারও আছে, যা পেতে হয়তো বিজ্ঞানীরা খুব একটা উৎসাহিত হবেন না। যার নাম— ‘ইগ নোবেল’ (Ig Nobel)। সম্মান দেওয়া হয় এখানেও, তবে খানিক মজার ছলে। যতরকম হাস্যকর ও উদ্ভট আবিষ্কারকে ঘটা করে স্বীকৃতি দেয় ‘ইগ নোবেল’। যেমন ধরা যাক, মানুষ কেন কলার খোসায় পা পিছলে পড়ে, এর কারণ আবিষ্কারের জন্য বরাদ্দ ছিল এই পুরস্কার।

শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্যি ঘটনা। ১৯৯১ সাল থেকে আমেরিকার একটি ব্যঙ্গাত্মক বিজ্ঞানপত্রিকা ‘অ্যানালস অফ ইমপ্রোবেবল রিসার্চ’  (Annals of Improbable Research) প্রতিবছর ‘ইগ নোবেল’-এর সম্মান দেয় বিজ্ঞানীদের। এক অর্থে বলা যায় এটি নোবেল-এর প্যারোডি। ইংরেজি ‘ইগনোবেল’ শব্দের অর্থ ‘অর্থহীন’ বা ‘অবজ্ঞাজনক’। তাকেই ‘পান’-এর মতো ব্যবহার করে নামকরণ করা হয়েছে পুরস্কারটির। যাদের আপ্তবাক্য হল- “Honor achievements that first make people laugh, then make them think.”

এই বাণীকে মাথায় রাখলে বোঝা যায় ‘ইগ নোবেল’-এর আসল উদ্দেশ্য। বিজ্ঞানীদের অপমান করা বা তাঁদের উদ্ভাবনকে ছোটো করা এদের লক্ষ্য নয়। বরং যে আবিষ্কারগুলি রোজকার জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে, তবে মানবসভ্যতার বৃহত্তর কল্যাণে হয়তো ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাদের জন্যই বরাদ্দ থাকে এই পুরস্কার। সত্যিকারের নোবেল পুরস্কারপ্রাপকরাই বিজয়ীর হাতে তুলে দেন 'ইগ নোবেল’ সম্মান। প্রথমে আমেরিকার এমআইটি-তে, পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত হত এই অনুষ্ঠান। অতিমারির জন্য অবশ্য অনলাইনে হয়েছে শেষ দু’বছর। 

এদের পুরস্কারপ্রাপকের তালিকাটিও নেহাত সামান্য নয়। ২০০০ সালে আন্দ্রে গেইম ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সাহায্যে ব্যাঙ সরানোর অসাধারণ আবিষ্কারের জন্য পেয়েছিলেন এই পুরস্কার। তিনিই কিন্তু ২০১০-এ গ্রাফিনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের উপর গবেষণায় পান সত্যিকারের নোবেল। গ্রেইম একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি নোবেল ও ইগ নোবেল দুটিই পেয়েছেন। আবার আরেক বিজ্ঞানী রয় জে গ্লবার প্রতি বছর অনুষ্ঠানে আসতেন শুধুমাত্র মঞ্চ পরিষ্কার করার জন্য। ২০০৫-এ তিনি ‘ইগ নোবেল’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেবার তাঁর নাম ছিল সত্যি নোবেলপ্রাপকদের তালিকায়। আমেরিকা না এসে তিনি উড়ে যান স্টকহোম। আর তারই ‘শাস্তি’স্বরূপ তিনি পরিষ্কার করতেন ‘ইগ নোবেল’-এর মঞ্চ।

আরও পড়ুন
মাত্র ৫ মাসের দূরত্বে ছিল নোবেল, মৃত্যুই ‘ব্রাত্য’ করে রাখল স্টিফেন হকিং-কে?

এরকমই একজন প্রাপকের নাম কিয়োশি মাবুচি (Kiyoshi Mabuchi)। ২০১৪ সালে জাপানের এই বিজ্ঞানী কলার খোসায় মানুষের পা পিছলে যাওয়ার কারণ ও তার সমাধান বিষয়ে গবেষণা করে জিতে নেন ‘ইগ নোবেল’। সেবছর নিউরোসাইন্সে পুরস্কার পান কানাডার বিজ্ঞানী ক্যাং লি। পোড়া পাউরুটির মধ্যে যারা যিশুখ্রিস্টের মুখের আদল দেখতে পায়, তাদের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তিনি। শুনতে হয়তো হাস্যকর। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায়, প্রাত্যহিক জীবনের ছোটো ছোটো বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই গবেষণাগুলি। তাদেরই সম্মান দেয় ‘ইগ নোবেল’।

আরও পড়ুন
‘মেসন’ কণার ধারণা দিয়েও নোবেল পাননি বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসু

কিয়োশি মাবুচির উদাহরণটাই ধরা যাক। রাস্তাঘাটে কলার খোসায় আছড়ে পড়া তো আকছার ঘটে। কারোর হাসি পায়, কেউ সমবেদনা দেখান। আর যিনি পড়েন, তাঁর অবস্থা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অথচ আপেল বা কমলালেবুর খোসায় এই সমস্যা হয় না। কিয়োশির গবেষণা এর সমাধানে নতুন পথ দেখায়। আসলে কিয়োশি ও তাঁর দল গবেষণা শুরু করছিলেন ‘উইপিং লুব্রিকেশন’ নিয়ে। যেখানে আরটিকুলার কার্টিলেজ থেকে একধরনের ফ্লুইড নিঃসৃত হয়। যার ফলে মানুষের শরীর ঘর্ষণের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে। আর সেই প্রসঙ্গে তিনি বারবার নিয়ে আসতেন কলার খোসায় মানুষের পা পিছলে যাওয়ার প্রসঙ্গ। গবেষণাগারে তাঁরা পরীক্ষা করেন কলার খোসা, মেঝে ও জুতোর পারস্পরিক ঘর্ষণের গুণাঙ্ক নিয়ে। দেখেন তার মধ্যেকার তারতম্য। তাঁদের বিস্তারিত আলোচনায় উঠে আসে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ।

‘ইগ নোবেল’ পাওয়া অধিকাংশ গবেষণাই মজার জন্য শুরু হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাওয়া ফলাফলটি ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফোটায়। সব গবেষণাই যে নোবেলের মঞ্চে উঠবে তার তো নিশ্চয়তা নেই। অথচ, বিজ্ঞানের ভাঁড়ারের অন্তহীন উপাদান প্রতি মুহূর্তে বিস্মিত করে মানুষকে। চলতে থাকে গবেষণা। উদ্ভট হতে পারে ফলাফল। আর তাঁদের জন্য রইল ‘ইগ নোবেল’।

চিত্রঋণ : Kiyoshi Mabuchi and JAST, tribology.jp, improbable.com

Powered by Froala Editor