নোবেলজয়ের দিনেই দেশের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগ রাশিয়ার

সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আর আদর্শ সংবাদমাধ্যমের কাজই হল মানবাধিকারের কথা তুলে ধরা, সরব হওয়া রাষ্ট্রের অন্ধকার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। বিগত তিন দশক ধরে সেই কাজটাই করে এসেছেন রাশিয়ান পত্রিকা ‘নভায়া গেজেতা’-র সম্পাদক দিমিত্রি মুরাতভ। হ্যাঁ, গতকাল তিনিই নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন বাকস্বাধীনতা আদায়ের অক্লান্ত লড়াইয়ের জন্য। এদিন ক্রেমলিন থেকেও শুভেচ্ছাবার্তা ভেসে আসে তাঁর কাছে। কিন্তু তারপর? তার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যেন ১৮০ ডিগ্রি মোড় নিল রাশিয়ান সরকার। ঐতিহাসিক এই ‘বিজয়-দিবস’-এই বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করল পুতিনের প্রশাসন।

গতকাল মুরাতভের নোবেলপ্রাপ্তির মাত্র চার ঘণ্টা পরেই বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এবং একদল সাংবাদিককে ‘ফরেন এজেন্ট’ হিসাবে চিহ্নিত করেন রাশিয়ার বিচার মন্ত্রালয়। যে তালিকায় রয়েছে বিশ্বের খ্যাতনামা অনুসন্ধানকারী সংবাদসংস্থা ‘লিবার্টি রেডিও’, ‘বেলিংক্যাট’-ও। রয়েছেন বিবিসির মতো প্রথম সারির আন্তর্জাতিক পত্রিকার একাধিক সাংবাদিক। 

কিন্তু এই ‘বৈদেশিক প্রতিনিধি’ বা ‘ফরেন এজেন্ট’ আদতে কী? অবিভক্ত সোভিয়েতই হোক কিংবা রাশিয়া— বহু বছর ধরেই ‘ফরেন এজেন্ট’ শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’-র প্রতিশব্দ হিসাবে। মূলত রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বীদেরই এহেন আখ্যায় ‘ভূষিত’ করে রুশ প্রশাসন। বৈদেশিক তহবিল গ্রহণ করে রাশিয়ার ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছেন তালিকাভুক্ত সাংবাদিকরা এবং সংবাদসংস্থাগুলি, এমনটাই অভিযোগ ক্রেমলিনের।

প্রশ্ন থেকে যায়, সত্যিই কি রাশিয়ার ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে তালিকাভুক্ত রুশ সংবাদমাধ্যমগুলি? ঠিক কী সংবাদও প্রকাশের জন্যই বা তারা চক্ষুশূল হয়ে উঠল রুশ প্রশাসনের? শুধু ‘বেলিংক্যাট’-এর উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে বিষয়টা। বিগত কয়েক বছরে রাশিয়ার একাধিক স্পাই অপারেশনের তথ্য প্রকাশ করেছিল এই গণমাধ্যমটি। পুতিনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যালেক্সি নাভালনিকে বিষক্রিয়ায় হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, তাও প্রথম উঠে এসেছিল তাঁদের তদন্তেই। পরবর্তীতে জার্মানির হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে যার প্রমাণও মিলেছিল হাতে-নাতে। বলার অপেক্ষা থাকে না, বেলিংক্যাটের এই প্রতিবেদন যথেষ্ট অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছিল ক্রেমলিন সরকারকে। আর সেই কারণেই এককথায় তাঁদের ‘নিষিদ্ধ’ করল রুশ প্রশাসন। রাশিয়ার এই পদক্ষেপ আদতেই গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ।

তবে এই প্রথম নয়। সংবাদমাধ্যমের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপে সিদ্ধহস্ত রাশিয়া। সোভিয়েতের সময় থেকে দেখলেই ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে তার। এ-বিষয়ে রুশ ইন্টেলিজেন্স সংস্থা কেজিবি’র দুর্নামও খুব একটা কম নয়। গণহত্যা হোক কিংবা সরকারের অনৈতিক কার্যকলাপ ধামাচাপা দিতে নৃশংস হয়ে উঠতেও বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না রাশিয়ার প্রতিরক্ষাবিভাগ।

এমনকি বছর কয়েক আগে সদ্য নোবেলজয়ী সাংবাদিক দিমিত্রিকেও ‘ফরেন এজেন্ট’-এর তকমা দিয়েছিল রাশিয়া। বিতর্কিত এবং সরকার-বিরোধী সংবাদ প্রকাশের জন্য বিগত দুই দশকে প্রাণও দিতে হয়েছে তাঁর সংস্থার ৬ সাংবাদিককে। 

সাম্প্রতিক সময়ে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে যেন আরও কঠোর হয়ে উঠেছিল রুশ প্রশাসন। ২০১৭ সমস্ত বৈদেশিক সংবাদ সংস্থাকেই আইন করে ‘ফরেন এজেন্ট’-এর তকমা দেয় ক্রেমলিন। গত আগস্ট মাসে বিবিসি, সিএনএন-সহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিনিধিদের ভিসাও নবীকরণ করতে অস্বীকার করেছিল রাশিয়া। এক কথায় বলতে গেলে, রাষ্ট্রের গোপনীয়তা রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিল পুতিনের সরকার। দিমিত্রি-র নোবেলপ্রাপ্তি এবং বিশ্বজুড়ে তাঁর সাহসী সাংবাদিকতার প্রশংসাই যেন নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছিল ক্রেমলিনকে। তাই পরবর্তী ‘নভায়া গেজেতা’ তৈরি হওয়ার আগেই নড়েচড়ে বসল রাশিয়া। কেড়ে নিল বাকস্বাধীনতার অধিকার। কিন্তু এভাবেই কি কণ্ঠরোধ করা সম্ভব সত্যের? জানা নেই। তবুও নৈরাজ্যের দেশে ফিনিক্স পাখি হয়ে দিমিত্রি-র মতো সাংবাদিকরা জেগে উঠবেন আগামীতেও, সে ব্যাপারে আশাবাদী আন্তর্জাতিক কূটনীতিবিদরা… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More