দুর্গা-আরাধনার সঙ্গে যেভাবে মিশে গেল নবপত্রিকা-পুজোও

মহাষষ্ঠীতে দেবীর বোধন, কিন্তু পুজো শুরু হয় সপ্তমীর দিন থেকেই। আর তার শুরুতেই সকালে কাছাকাছি নদী বা কোনো জলাশয়ে কলাবউকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই কলাবউয়ের নাম আসলে নবপত্রিকা, এটাও সবাই জানি। আর তিনি যে গণেশের বউ নন, এটাও বোধ করি অনেকেরই জানা এখন।

পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে নবপত্রিকা নিয়ে যান। তাঁর পিছন পিছন ঢাকিরা ঢাক বাজাতে বাজাতে এবং মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি করতে করতে যান। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে নবপত্রিকাকে দেবীর ডান দিকে একটি কাষ্ঠসিংহাসনে স্থাপন করা হয়। পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকেন। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়।

প্রশ্ন হল, কী এই নবপত্রিকা? আর তার চেয়েও বড় কথা, কেন এই নবপত্রিকা? একে একে বলি।

নবপত্রিকা নয়টি গাছের পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ। এগুলি হল-কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মান ও ধান। একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা অথবা হলুদ শাড়ি পড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে সপরিবারে দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়।

আরও পড়ুন
দুর্গাপুজো করে দ্বিগুণ মুনাফা, আমৃত্যু দেবী-আরাধনা ‘বিধর্মী’ চিকবাহাদুরের

এখানেই প্রশ্ন আসবে কেন নয়টা? দশ বা এগারো না কেন? নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়—

আরও পড়ুন
পা ভেঙেছে দুর্গার বাহনের, সিংহ পরিবারের কর্তাকে ঘিরে ধরল সবাই

১. কদলী বা রম্ভা - কদলি গাছ এর অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী।
২. কচু - কচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা।
৩. হরিদ্রা - হরিদ্রা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা।
৪. জয়ন্তী - জয়ন্তী গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী।
৫. বিল্ব - বিল্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা।
৬. দাড়িম্ব - দাড়িম্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা।
৭. অশোক - অশোক গাছের অধিষ্টাত্রীদেবী শোকরহিতা।
৮. মান - মান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা।
৯. ধান - ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী

আরও পড়ুন
‘কচু ঘেঁচু’ জোটে দুর্গার কপালে! কবিতা ফাঁদলেন বঙ্কিম

মানে এই নবপত্রিকা পুজোর মাধ্যমে দেবীর সকল রূপের পুজো একসঙ্গে করা হয়। ড. শশীভূষণ দাসগুপ্ত লিখছেন, ‘শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। ...বলাবাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে।’

প্রাচীনকালে, দুর্গাপুজো বা যে-কোনো পুজো শুরুর আগেই মানুষ প্রকৃতির পুজো করে তাঁকে তুষ্ট করার চেষ্টা করত। কৃষিজীবী আর্যরা ভারতে আসার আগে থেকেই শস্যভিত্তিক ধর্মাচরণের শুরু হয়। অনেক পরে যখন দুর্গাপুজো এল, মানুষ আগের শস্যপুজোকে রাতারাতি ত্যাগ করে নতুন দেবীকে পুজো শুরু করেনি। বরং সেই ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ মেনে তাঁদের শস্যদেবীকে মিলিয়ে দিলেন দেবী দুর্গার সঙ্গে।

জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘দেবীপুরাণে নবদুর্গা আছে, কিন্তু নবপত্রিকা নাই।... নবপত্রিকা দুর্গাপূজার এক আগন্তুক অঙ্গ হইয়াছে।... বোধ হয় কোনও প্রদেশে শবরাদি জাতি নয়টি গাছের পাতা সম্মুখে রাখিয়া নবরাত্রি উৎসব করিত। তাহাদের নবপত্রী দুর্গা-প্রতিমার পার্শ্বে স্থাপিত হইতেছে। পত্রিকাস্থ অপর কোনো দেবীকে পৃথকভাবে পূজা করা হয় না।’

উল্লেখ্য, মার্কণ্ডেয় পুরাণে নবপত্রিকার কোনো কথা উল্লেখ নেই। কালিকাপুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ না থাকলেও, সপ্তমী তিথিতে পত্রিকাপূজার নির্দেশ রয়েছে। নবপত্রিকার উল্লেখ সেই ভাবে প্রথম পাই কৃত্তিবাস ওঝা বিরচিত রামায়ণে। সেখানে রামচন্দ্র কর্তৃক নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ রয়েছে – ‘বাঁধিলা পত্রিকা নববৃক্ষের বিলাস’।

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? প্যাগান বা পৌত্তলিক ধর্মের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাব, মানুষ একেবারে শুরুতে পাথর, জল, গাছ, শস্য ইত্যাদির পুজো করে তাঁদের আদিমতম ধর্মাচরণ শুরু করে। মূর্তির কনসেপ্ট এসেছে অনেক পরে। কিন্তু প্রকৃতিভীরু মানুষ ভয়ে ভয়ে কাউকেই ত্যাগ করতে পারেনি। আজকের দিনে তাই আমরা ফিরে যাই আমাদের সেই প্রাচীনতম দিনগুলোতে, আর তার সঙ্গে মিশে যায় অধুনার ধর্মাচরণ। রবি ঠাকুরের ভাষায় আর্য-অনার্য ‘এক দেহে হল লীন।’

Powered by Froala Editor