জোফানির আঁকা ‘দ্য লাস্ট সাপার’ লুকিয়ে আছে কলকাতাতেই, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের আদলে শিষ্যদের মুখ

লাস্ট সাপার, তাও আবার খোদ কলকাতার বুকে? আর তা নিয়ে মামলা, মোকদ্দমা, কেচ্ছা? আজ্ঞে হ্যাঁ, তাও হয়েছিল এককালে। প্রভু যিশু তাঁর বারোজন শিষ্যকে নিয়ে শেষবারের মতন বসেছেন ভোজসভায়। পরিবেশ থমথমে। প্রভু ভবিষ্যতবাণী করলেন, উপস্থিত শিষ্যদের মধ্যেই একজন তাঁকে তুলে দেবেন মৃত্যুদূতের হাতে। রুটি ও মদ দিয়ে ভোজন করতে করতে যিশু জানালেন এই রুটি তাঁর দেহ আর মদ তাঁর রক্ত। ভবিষ্যতবাণী মিল। তিরিশটা রুপোর মুদ্রার বদলে জুডাস ইস্কারিওট তাঁকে চিনিয়ে দিল শত্রুপক্ষের কাছে। বাইবেলের এমন নাটকীয় দৃশ্য এঁকেছেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি থেকে তিনতোরেত্তো - অনেকেই। তবে কলকাতায় বসে আঁকা জন জোফানি সাহেবের ছবির বিতর্কের পাশে এরা কেউ আসে না।

রয়্যাল আকাদেমির প্রথম দিকের সদস্য যোহান জফালির জন্ম ১৭৩৩ সালের ১৩ মার্চ জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে। ১৭৬০ সালে ইংল্যান্ডে পাকাপাকিভাবে চলে আসার সময় অন্য অনেককিছুর সঙ্গে নিজের নাম পদবি বদলে জন জোফানি করে নিলেন তিনি নিজেই। রোমে ছবি আঁকা শিখেছিলেন। ভেবেছিলেন ইংল্যান্ডে এসে ভাগ্য খুলবে। কিন্তু বিধি বাম। কাজ মিলল না। আলাপ হল স্টিফেন রিম্বস্ট নামে এক ঘড়িওয়ালার সঙ্গে, জুটল ঘড়ির ডায়ালে নকশা আঁকার কাজ। কিন্তু তাতে মন ভরে কই? সব ছেড়েছুড়ে টটেনহ্যাম কোর্ট রোডে নিজের স্টুডিও খুলে বসলেন। দরজার সামনে বউয়ের দুখানা পোর্টেট। ওই দুটোই তাঁর বিজ্ঞাপন। কীভাবে যেন সে দুটো চোখে পড়ে গেল বিখ্যাত থিয়েটার প্রযোজক ডেভিড গ্যারিকের। তিনি জোফানিকে বরাত দিলেন থিয়েটারের অভিনেতাদের অঙ্গভঙ্গি, প্রতিকৃতি আঁকতে। সেগুলোই হবে নাটকের বিজ্ঞাপন। জোফানির ভাগ্য ফিরল। এমন সময় আর এক কাণ্ড। ‘লাইফ স্কুল’ নামে একটা ছবিতে তিনি রাণীর তরুণী অবস্থার ছবি আঁকলেন আর সঙ্গে তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকের ছবি। ব্যাস! আর যায় কোথায়? রাজা দ্বিতীয় জর্জ তো খেপে বোম। ছবি আঁকা নিয়ে এই ধরনের বিতর্ক চিরকাল তাঁর সঙ্গী ছিল। সেই গল্পই বলব। 

ধীরে ধীরে তাঁর ছবির নামডাক ছড়াতে লাগল। ১৭৮৩ নাগাদ চল্লিশ বছর বয়সি জোফানি ঠিক করলেন ভারতে আসবেন। ভারতে এসেই জোফানি প্রথমে দেখা করলেন তাঁর শিল্পী বন্ধু হজেসের সঙ্গে। এই হজেস ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছের লোক। তিনিই জোফানিকে হোয়াইট টাউনে একটা বাড়ির ঘরদোর গুছিয়ে দিলেন। দিন পনেরো পর থেকেই কলকাতার অভিজাতদের ভিড় লেগে গেল জোফানির স্টুডিওতে ছবি আঁকানোর জন্য। পত্রিকায় তাঁকে ‘এ পেন্টার অফ দ্য ফার্স্ট ক্লাস’ বলে উল্লেখ করা হল। খুব দ্রুত ছবি আঁকতে পারতেন জোফানি। একের পর এঁকে গেলেন ইংরেজ রাজপুরুষদের ছবি, যাদের মধ্যে চিফ জাস্টিস এলিজা ইম্পে আর স্বয়ং গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-ও আছেন। হেস্টিংস-এর সঙ্গে ভারতের নানা জায়গা ঘুরলেন জোফানি। আঁকলেন চুঁচড়াতে বাঘ শিকারের ছবি, লখনৌতে আসফউদ্দৌলার রাজত্বের অজস্র ছবি। রোজগার হল অনেক। ফিরে এলেন কলকাতায়। তখন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস। যাবার আগে হেস্টিংস এক গুরুতর কাজ চাপিয়ে দিয়েছেন জোফানির উপরে। সেন্ট জন গির্জার জন্য একটা অল্টারপিস আঁকতে হবে যার বিষয় হবে ‘ দ্য লাস্ট সাপার’। জোফানি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। মাত্র ছয় সপ্তাহে শেষ করলেন সেই ছবি। ১৭৮৭ সালের ৯ এপ্রিল চার্চকে ছবিটা উপহার দিলেন জোফানি। 

জুন মাসে ছবিটা টাঙানো হতেই শুরু হল বিতর্ক আর হাসি সমালোচনার ঝড়। প্রথমে তো ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে সমালোচনা। গাদিন হ্যামিল্টন লিখলেন “পটভূমিকায় দেখা যাচ্ছে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারছে পূর্ণিমার চাঁদ, এদিকে চরিত্ররা বসে আছেন এক বারান্দায় যেখানে দিনের আলোর মত উজ্জ্বল। পেটারের তলোয়ারটা ঝুলছে একটা পেরেকের থেকে, যেন এক সাধারণ পিওনের তলোয়ার। টেবিলের সামনের পানপাত্রটা পিকদানির মতো দেখতে…” ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এসসব ছাপিয়ে বিতর্ক শুরু হল অন্য জায়গায়। ছবির প্রতিটা মানুষই সেদিনের কলকাতার বড়ো চেনা আর বিখ্যাত মানুষ। জীবন্ত আর বাস্তব। প্রভু যিশু যেন অবিকল কলকাতার গ্রিক যাজক পার্থেনিও, প্রভুর কাঁধে মেয়েলি কায়দায় হেলান দেওয়া সেন্ট জন হলেন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট মি. ব্ল্যাকোয়ার (যিনি খৃষ্টধর্মকে পাত্তাও দিতেন না, আর চরিত্র রক্ষার দিকেও বেশ উদাসীন ছিলেন)। বাকিরাও সেই সব অভিজাতদের মধ্যে যারা একসময় জোফানিকে পয়সা দিয়ে নিজেদের ছবি আঁকিয়েছিলেন। শুরু হয়ে গেল ছবি নিয়ে হাসি ঠাট্টা। কিন্তু হাসতে পারলেন না একজন। তাঁর নাম উইলিয়াম টুলো। কলকাতার নামজাদা নিলামকারী। বিশ্বাসঘাতক জুডাসের মুখের জায়গায় টুলোর মুখ বসিয়ে দিয়েছেন জোফানি। কেউ কেউ বলেন এই টুলো সাহেবের থেকে নাকি জোফানি কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। কান মুচড়ে সে টাকা আদায় করেন টুলো। এই ছবি তাঁরই প্রতিদান। টুলো ছেড়ে দেবার মানুষ না। তিনি সোজা মানহানির মামলা করলেন জোফানির নামে। জোফানির ভাগ্য ভালো। সরকার তাঁর পক্ষে ছিল। মামলার জল বেশিদূর গড়ায়নি। তবে বেশ কিছুদিন ক্যালকাটা গেজেটের পাতা ভরেছিল এই ছবি আর তা নিয়ে বিতর্কের খবরে। 

১৭৮৯-এ দেশে ফিরে গেলেন জোফানি। শরীর ভেঙে গেছে। অনেকদিন পরে আবার আসতে চেয়েওছিলেন প্রাণের শহর কলকাতায়। তখন তিনি বৃদ্ধ। পারেননি। এখনও কিরণ শঙ্কর রায় রোডের ওপর সেন্ট জন চার্চে ঢুকলেই আপনার মনে হবে বাইরের কোলাহল, যানবাহনের আওয়াজ সব যেন এক নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ঘুরতে ঘুরতে গির্জা প্রাঙ্গনে দেখতে পাবেন জোব চার্নকের সমাধি, বেগম জনসনের সমাধি, রোহিলা যুদ্ধের স্মারক। চার্চের দরজা খুলে ঢুকে পড়ুন। সামনে তাকালেই চোখে পড়বে সেই ছবি। শিষ্য পরিবৃত প্রভু যিশু। সামনেই বসে আছেন জুডাস, নাকি টুলো সাহেব? তাঁর মুখে অদ্ভুত এক মানসিক টানাপোড়েনের আভাস। খাস কলকাতার সবার চোখের আড়ালে প্রায় অজ্ঞাত অবস্থায় পড়ে আছে জোফানির সবচেয়ে বিতর্কিত ছবি লাস্ট সাপার।  লিওনার্দোর লাস্ট সাপারের চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে নেই সে। এককালে একাহাতে কলকাতার গোটা ইংরেজ সমাজকে সে সমূলে  নাড়িয়ে দিতে পেরেছিল।

Powered by Froala Editor