বাংলার বুকে যখন দাপিয়ে বেড়াত ‘রায়-বাঘে’র দল

লীলা মজুমদার একবার লিখেছিলেন, গপ্পো হিসেবে নাকি তিনটি বিষয় একেবারে অব্যর্থ। এদের নিয়ে গল্প বাঁধলে সে-গল্প জমতে বাধ্য। এক, ভূত; দুই, চোর; আর তিন, বাঘ। একেবারে আচমকা এই মন্তব্য করেননি লীলা দেবী। বাংলায় সাহিত্যের ধারাকে নিবিড় ভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রায় প্রথম থেকেই যে-পশুটি প্রায় একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে রয়েছে, সে কিন্তু পশুরাজ সিংহ নয়— বাঘ। এর অবশ্য কারণও অনুমান করা স্বাভাবিক। আফ্রিকার রাজা সিংহকে দেখার জায়গা দুটি— চিড়িয়াখানা অথবা দুর্গা ঠাকুরের বাহন হিসেবে। কিন্তু বাঘের বেলায় সে অসুবিধা নেই। জল জংলার দেশ এ বাংলায় রাত-বিরেতে দু-একটা বাঘ দেখতে পাওয়া তখন খুব একটা আশ্চর্য ঘটনা ছিল না। রাতে বন্ধ দরজার ওপারে কতবার শোনা যেত বাঘের গর্জন। মাঝরাতে প্রকৃতির টানে বাইরে বেরিয়ে আর ঘরে ফিরত না কত নারী পুরুষ। আর তাই অচেনা পশুর চেয়ে চেনা বাঘই লোককথা-উপকথার অংশ হয়ে উঠতে থাকে। বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির সময়ও তাই বাঘকে নিয়ে রচিত হতে লাগল নানা সত্যি-মিথ্যে গল্প।

কাহিনিতে এলেও বাংলা বইতে অলংকৃত প্রথম বন্য পশু কিন্তু বাঘ নয়— সিংহ। তখন বাংলায় সবে ছাপাখানা এসেছে। ১৮১৬-তে কলকাতার ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানি-র ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়েছে বাংলার প্রথম সচিত্র গ্রন্থ অন্নদামঙ্গল। সেই বছরই বিলেত থেকে কাঠখোদাই ও ধাতুখোদাই বিশেষজ্ঞ জন লসন কলকাতায় আসেন ও ধাতব ব্লক এবং অক্ষর নির্মাণে মন দেন। ১৮১৯-এ সাহেবদের বাংলা শেখানোর জন্য তাঁর খোদাই করা সিংহের ছবিসহ ‘সিংহের বিবরণ’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’। লেখার ম্যাটার জোগাড় করেছিলেন লসন, আর তার অনুবাদ করেছিলেন পিয়ার্সসাহেব। এই সিংহের ছবিটি ছাত্রমহলে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। ছাত্রদের অনেকের বিশ্বাস ছিল যে জগতে সিংহ মাত্র একটিই। ছাপানো ছবি দেখে তাঁদের ধারণা হয়েছিল সেই সিংহটিই সশরীরে এখানে উপস্থিত হয়েছে। তাঁরা নাকি এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত স্কুল ফাঁকা হয়ে যায়। এর জনপ্রিয়তায় উৎসাহিত হয়ে স্কুল বুক সোসাইটি ১৮২২-এর ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিমাসে কোনো একটি প্রাণীর সচিত্র বিবরণ পুস্তিকা আকারে ‘পশ্বাবলী’ নামে প্রকাশ করতে থাকেন। এই সিরিজেই একে-একে শৃগাল, ভালুক, হাতি, গণ্ডার, হিপ্পপটমস্‌ ও শৃগালের পর প্রকাশিত হয় ‘ব্যাঘ্রের বিবরণ’ (সচিত্র, ১০১-১২২)। অন্য সংখ্যাগুলোর মতো এতেও শুরুতেই লসনকৃত একটি বাঘের চমৎকার খোদাইচিত্র রয়েছে। বাংলা বইতে এই বাঘটিই খুব সম্ভব প্রথম বাঘের ছবি।

তারপরই অবশ্য বেশ কয়েক বছর বাংলা সাহিত্যের অলংকরণ থেকে বাঘেরা হারিয়ে গেল। আসলে ক্রমাগত সচিত্র ধর্মগ্রন্থের চাপে বাঘ পালাবার পথ পেল না। বাংলা অলংকরণে আবার বাঘের আমদানি হয় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। ১৮৯২-এ তাঁর রচিত ‘কঙ্কাবতী’ বইতে সিংহ, ভালুক, কুকুরসহ বাঘকে নিয়েও কাহিনি বর্ণিত আছে। এর প্রথম সংস্করণে প্রচুর কাঠখোদাই ছবি আছে। এঁকেছেন হরিদাস সেন। এতেই আছে সেই বিখ্যাত দৃশ্য যেখানে বাঘের পিঠে চেপে বনের মধ্যে দিয়ে কঙ্কাবতী চলেছে অট্টালিকার উদ্দেশে। তবে বাংলা সাহিত্যে একেবারে হুড়মুড়িয়ে যিনি বাঘকে নিয়ে এলেন, তিনি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। ১৯১০ সালে কান্তিক প্রেস থেকে মুদ্রিত হল তাঁর রচিত ‘টুনটুনির বই’। ‘সুকুমার পাঠক-পাঠিকাদের’ জন্য রচিত এই বইটির ‘২৭টি গল্প, ৩০ খানি ছোটো ছবি’-র অনেকগুলিই ছিল ‘বাঘের ছবি আর বাঘের গল্প’। বইটির চতুর্থ গল্প ‘নরহরি দাস’-এই প্রথম বাঘের প্রবেশ। গল্পের শেষে লেজে বাঁধা শিয়ালকে নিয়ে বাঘের সেই ‘পঁচিশ হাত লম্বা এক এক লাফ দিয়ে পালাবার’ দৃশ্য বাংলাসাহিত্যে অমর হয়ে আছে। পরের গল্পই ‘বাঘ মামা আর শিয়াল ভাগ্নে’— যার দুটি ছবি, ‘বাঘ কুয়োর ভিতর পড়ে যাচ্ছে’ ও ‘কুমির বাঘকে কামড়ে ধরেছে’। এরপর ‘চড়াই আর বাঘের কথা’-তেও তিনটি ছবির দুটিতে বাঘ উপস্থিত, ‘বাঘ পিঠে গড়বার জিনিষ নিয়ে আসছে’ ও ‘হাঁড়ি ভাঙার শব্দে বাঘ পালাচ্ছে’। পরের গল্প ‘দুষ্টু বাঘ’-এ প্রথমে বাঘ ও বামুনের ছবি এবং তার পরে শিয়ালের বাঘকে খাঁচায় বন্ধ করে দেবার দৃশ্য। ঠিক পরের গল্প ‘বাঘ বর’ যাতে বোকা বাঘকে কুয়োতে ফেলে গরম তেল ঢেলে মেরে ফেলা হয়।

আরও পড়ুন
শিকারি হয়েও ব্যাঘ্র-সংরক্ষণের পক্ষে সওয়াল! জীবদ্দশাতেই বিতর্কে জিম করবেট

আরও পড়ুন
বাঘের চোখে কর্নিয়াল সার্জারি, তৈরি হল ইতিহাস

এ গল্পে পায়ে নাগড়াই, গায়ে জোব্বা, মাথায় টুপি পরা বরবেশী বাঘের চেহারা যে বেশ খোলতাই হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। ‘বাঘের উপর টাগ’ গল্পে চোখ-বাঁধা বাঘের পিঠে বসা জেলের ছবি কিংবা বুদ্ধুর বাপের মুগুর দিয়ে ধাঁই ধাঁই করে বাঘ মারা কিংবা খ্যাঁচ করে বাঘের লেজ কাটার দৃশ্য এখনও ছেলেবেলার নস্টালজিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে সব ছবির মধ্যে আমার ব্যক্তিগতভাবে প্রিয় ‘বোকা বাঘ’ গল্পের খোঁটায় বাঁধা বাঘটি। বাঘটির বিবাহের ইচ্ছা আর গ্রামের লোক মারতে আসাতেও হাসিহাসি মুখ এক অদ্ভুত কৌতুককর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। সঙ্গে ক্যাপশানটিও খাসা ‘বাঘ বললে, হীঃ হীঃ, হিহি, হিহি।’

আরও পড়ুন
ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি – হুজুগ, নিষ্ঠা ও কিছু বিপন্ন বন্যপ্রাণের গপ্পো

এ হেন উপেন্দ্রকিশোর যখন সন্দেশ-এর মতো পত্রিকা প্রকাশ করেন, তাতে বাঘ থাকবে না, তা-কি হয়! সন্দেশ প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা (আষাঢ়, ১৩২০)-তেই ছিল ‘বাঘের গল্প’— যদিও সঙ্গে কোনো ছবি ছিল না। পরের সংখ্যা থেকেই শুরু হল প্রমদারঞ্জন রায়ের লেখা বনের খবর— যার প্রথম কিস্তিতেই বাঘের তাড়া খেয়ে সুচিৎ নামে চাকরটির প্রাণপণ দৌড়ের কাহিনি, আর সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের আঁকা ছবি। বাঘের লাফ আর সুচিৎ-এর খাড়া টিকি এক অদ্ভুত স্ল্যাপস্টিক কমেডির ভাব সৃষ্টি করেছে। উপেন্দ্রকিশোরের পুত্র সুকুমার অবশ্য তাঁর সাহিত্যজীবনে বাঘকে খুব বেশি গুরুত্ব দেননি। কে জানে, বাবা এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলেই হয়তো! তাঁর লেখায় বরং বাঘের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে কম। একমাত্র তাঁর ‘গল্প’ নামের গল্পে দেখি লেখা আছে— 

“বড়মামা একটা গল্প বল না”
“গল্প? এক ছিল গ, এক ছিল ল, আর এক ছিল প—”
“না- ও গল্পটা না। ওটা বিচ্ছিরি গল্প— একটা বাঘের গল্প বল”
“আচ্ছা। যেখানে মস্ত নদী থাকে আর তার ধারে প্রকান্ড জঙ্গল থাকে— সেইখানে একটা মস্ত বাঘ ছিল আর ছিল একটা শেয়াল।”
“না— শেয়াল তো বলি নি— বাঘের গল্প।”
“আচ্ছা, বাঘ ছিল, শেয়াল টেয়াল কিছু ছিল না। একদিন সেই বাঘ করেছে কি একটা ছোট্ট হরিণের ছানার ঘাড়ে হাল্লুম করে কামড়ে ধরেছে—”

পরে একমাত্র ‘সেকালের বাঘ’ প্রবন্ধে খড়্গদন্ত বাঘ নিয়ে তাঁর ছোট একটা প্রবন্ধ পড়তে পাই।“এবার যে জানোয়ারের কথা বলছি ইংরাজিতে তাকে বলে Sabre-toothed Tiger (অর্থাৎ খড়্গদন্ত বাঘ)। এর কঙ্কাল ইউরোপে, আমেরিকায়, আমাদের দেশে এবং আরও নানা জায়গায় পাওয়া গিয়াছে। এই খড়্গের মতো দাঁত দুটিতে তার কি কাজ হত, সে কথা বলা বড় শক্ত। অত লম্বা দাঁত দিয়ে কামড়াবার সুবিধা হয় না; তাছাড়া, এই বাঘের চোয়ালের হাড় আজকালকার বাঘের মতো মজবুত নয়, সুতরাং তার কামড়ের জোরও কম ছিল। দাঁত দুটি প্রায় ছয় ইঞ্চি করে লম্বা, তার গায়ে ছুরির মতো ধার—হয়ত তা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শিকারের মাংস ছাড়াবার সুবিধা হত।” ব্যাস এইটুকুই। 

নাতি সত্যজিৎ অবশ্য বাঘের ব্যাপারে ঠাকুরদাদারই অনুগামী। অবশ্য তাঁর ছোটোবেলার স্মৃতির সঙ্গেও এক বাঘের ছবি জড়িয়ে আছে। ছেলেবেলায় শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসু একবার তাঁকে একটা ডোরাকাটা বাঘ এঁকে দিয়েছিলেন। বাঘের লেজে একটা কালো ছোপ। কারণ জিজ্ঞেস করায় নন্দলাল নাকি বলেছিলেন বাঘটা এক বাড়ির রান্নাঘরে মাংস চুরি করে খেতে ঢুকেছিল, তখনই ল্যাজের ডগাটা ঢুকে যায় জ্বলন্ত উনুনের ভেতর। সন্দেশ পত্রিকা যখন নবরূপে প্রকাশিত হল সত্যজিতের হাত ধরে (মে ১৯৬১) তার প্রথম সংখ্যার ফ্রন্টিসপিসেই ছাপা হয়েছিল নন্দলাল অঙ্কিত সেই বাঘের রঙিন ছবি। সেই শুরু। তারপর বহুবার বাঘ এসেছে সত্যজিতের লেখায়-রেখায়। আর এই নন্দলালই তো বাঙালি শিশুর চিরকালীন প্রাইমার সহজ পাঠ-এ এঁকেছিলেন জলের ধারে বনের মাঝে সেই বাঘের ছবি। সঙ্গে রবি ঠাকুরের লেখা, ‘বনে থাকে বাঘ / গাছে থাকে পাখি / জলে থাকে মাছ / জলে থাকে ফল...’। সত্যজিতের সিগনেট-দিনের প্রচ্ছদে বার তিনেক বাঘের আবির্ভাব ঘটেছে। ১৯৫৫ সালে টুনটুনির বই-এর মলাটে পেপার কাটিং স্টাইলে বাঘকে আঁকা হয়েছে। পরের বছরই প্রমদারঞ্জন রায়ের ‘বনের খবর’ সিগনেট থেকে প্রকাশিত হলে তার প্রচ্ছদে কালো পশ্চাদপটে তীব্র জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে বাঘের মুখ। উপরে সবুজ রঙে হাতে লেখা বনের খবর। তবে বাঘ নিয়ে সত্যজিতের সেরা মলাট ১৯৫৩-এ প্রকাশিত ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ’-এর প্রচ্ছদ। এমন প্রচ্ছদ বাংলা তথা ভারতীয় কোনো বইতে এর আগে করা হয়েছে কিনা সন্দেহ। দু’-মলাট জোড়া কালো আর হলদে বাঘের ছাল যেন ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। নিচের দিকে গুলির গর্ত যা পিছনের দিকে ফুঁড়ে চলে গেছে। গুলি ঢোকার সময় ফুটো ছোটো হয়। ফুঁড়ে বেরোবার সময় চ্যাপ্টা ও বড়ো হয়। সেটাও প্রচ্ছদ তৈরির সময় মাথায় রেখেছেন সত্যজিত। বাঘছাল অবশ্য অনেক আগেও এঁকেছেন তিনি। ডি. জে. কিমারের যুগে প্যালুড্রিনের বিজ্ঞাপনের একটিতে মেঝেতে পাতা একটি বাঘছাল ঘরের গাম্ভীর্য ও বনেদিয়ানাকে ফুটিয়ে তুলেছে। এই বাঘছাল আবার আগে ‘সোনার কেল্লা’ ছবির জন্য প্যাস্টেলে আঁকা সেট ডিজাইনে কিংবা শঙ্কুর অভিযান আশ্চর্য জন্তু-র ইন্টেরিয়র ডেকরেশন। ‘সন্দেশ’-এর জন্য ধাঁধা-র এর বাড়াবাড়ি, কিংবা ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ কাহিনিতে মেঝেতে থেবড়ে বসা পুতুল হাতে বিবির আসন হিসেবে ব্যবহৃত বাঘছাল সত্যজিতের অলংকরণকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

১৯৮১ এবং ১৯৮২--পরপর এই দুই বছর প্রকাশিত হয় দুটি ফেলুদা-কাহিনি। যথাক্রমে—‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ ও ‘রয়াল বেঙ্গল রহস্য’। প্রথমটিতে সবুজ জমিনে গ্রেট ম্যাজেস্টিক সার্কাসের পালানো বাঘ সুলতান গোঁফ উচিয়ে দাঁড়িয়ে রিং মাস্টারের সামনে। তার দ্বিতীয়টির খয়েরি জমিনের প্রায় গোটা অংশ জুড়ে সবুজ রঙে বাঘের চোখমুখ আর অরণ্যের গাছপালা। নামলিপিতেও যেন বাঘের গায়ের রঙের ছোঁয়া। ১৯৮৭-তে প্রকাশিত ‘ব্রাজিলের কালো বাঘ ও অন্যান্য’-র প্রচ্ছদে গাঢ় হলুদের উপর নিকষ কালোতে ছাপা ব্রাজিলিয়ান ক্যাটের ভয়াবহ মুখ। তাঁর মুখে রক্তের দাগ। ১৯৬১-তে প্রকাশিত হয় অদ্ভুত এক ত্রিমাত্রিক ছবির বই, নাম ‘The zoo springs to the life’। ভিতরের ছবি তুলেছিলেন নিমাই ঘোষ ও প্রচ্ছদশিল্পী সত্যজিত রায়। প্রচ্ছদেই ছিল খাঁচার ভিতর থেকে বাঘ লাফিয়ে বেরিয়ে আসছে। বাঘের কিছু অংশ গরাদের ভিতর, কিছু অংশ বাইরে।

সন্দেশ পত্রিকার মলাটেও বাঘ এসেছে বহুবার। প্রথমবার অবশ্য সুকুমার রায়ের হাত ধরে। গাছের তলায় টাক মাথা টিকিওয়ালা এক ছেলে সন্দেশ পড়ছে আর পিছনে হাসিমুখ এক বাঘ আর বাঘের পিঠে বক, এমনই ছিল সেই অদ্ভুত প্রচ্ছদ। সত্যজিতের আমলে ১৯৬৯-এর নবম বর্ষের সন্দেশ পত্রিকার প্রচ্ছদে ছোটো-ছোটো চৌকো খোপের মধ্যে অনেক কিছুর মধ্যে বাঘও ছিল। তবে বাঘই প্রধান চরিত্রের রূপ নিল ১৯৮২-র শ্রাবণ সংখ্যার প্রচ্ছদে। গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে বাঘের সন্দেশ পড়ার দারুণ আগ্রহ এখনও পাঠক-পাঠিকাদের মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত আছে।

সন্দেশ-এ অলংকরণে বহুবার বাঘ আঁকলেও দু’-মলাটের ভিতরে সব থেকে বেশি সংখ্যক বিভিন্ন ধরণের বাঘ সত্যজিত এঁকেছেন সেরা সন্দেশ বইতে। কী নেই তাতে? মিষ্টি বাঘ, মজার বাঘ, রাগি বাঘ, শিকারি বাঘ। সদানন্দ স্বদেশলাল গল্পে হাসিহাসি মুখের ঘুমন্ত বাঘিনির পায়ে আলতা পরানোর দৃশ্য, গাছের নাম বাঘশাল-এর মিষ্টি বাঘ কিংবা এই বাঘটাই সেই বাঘটা-র মজার বাঘের পাশেই একেবারে সিরিয়াস ঢঙে আঁকেন দুগ্যো সদ্দার কিংবা মানুষখেকোর অন্তিম অনুরোধ-এর বাঘকে। মহাশ্বেতা দেবীর বিরে ডাকাত ছিরে ডাকাত-এর বাঘের সাথে নন্দলালের বনে থাকে বাঘ-এর আশ্চর্য মিল। সত্যজিতের হেডপিসেও বাঘ ফিরে ফিরে আসে। শুটিং-এর গল্প বাঘের খেলা-য় হেডপিস বাঘের গায়ের ডোরাকাটা ফিতে দিয়ে। বাণী রায়ের বিপ্রদাস বা গৌরী ধর্মপালের বাঘা-তে একটানে আঁকা বাঘের কথা কে ভুলতে পেরেছে! সুখেন্দু দত্তের হালুম্বা-তে শুরু বাঘের হাঁ-করা মুখ আর লেজ--মাঝে অসামান্য লেটারিং-এ গল্পের নাম যেন বাঘের গোটা দেহকেই নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।

সবমিলিয়ে তিন প্রজন্মে একটা প্রাণীরই চোখ ইজ জ্বলজ্বলিং। আর সে হল বাঘ।

Powered by Froala Editor