অতিরিক্ত পুণ্যের লোভে গুরুদেবকেই বলি দিতে উদ্যত শিষ্য!

প্রাণকৃষ্ণ দত্ত লিখছেন, যিনি দুই-আড়াই টাকার বেতনের চাকরি করেন, তাঁর বাড়িতেও নাকি মা দুর্গা আসতেন। তত আড়ম্বরের পুজো অবশ্য হত না। তবে এমন কোন ভদ্রপল্লী ছিল না, যেখানে অন্তত চার পাঁচটি দুর্গাপুজো হত না। ২০/২৫ টাকায় দুর্গাপুজো হয়ে যেত। তবে রেষারেষির পুজোও ছিল। অমুকবাবু চারটে ঢোল, দুটো ঢাক বাজাচ্ছে, আমাকেও আটটা ঢোল, চারটে ঢাক রাখতে হবে। ওখানে দুটো পাঁঠা বলি হলে আমি চারটে বলি দেব।

কুমারটুলির গোবিন্দরাম মিত্রের পূজায় এত ধূমধাম হত যে, ‘তাঁহার কয়েক অধস্তন পুরুষ পৈতৃক রীত্যানুসারে পূজার ধুমধাম করিয়াই সর্বসান্ত হইয়াছেন’। দুর্গাপুজোতে বলিদানের বাড়াবাড়ি হত। তিনদিন টানা বলি তো হতই, নবমীর দিন সেই বলির সীমা থাকত না। শোভাবাজারের জয় মিত্রের বাড়িতে সপ্তমীর দিন থেকে যত বলি হত, সেই সব ছাগল গুদামে রেখে দেওয়া হত। একাদশীর দিন সেই পরিবার থেকে যেসব ব্রাহ্মণ সিধে পেতেন, তাঁদের বলির পাঁঠা পাঠানোর নিয়ম ছিল। নবমীতে শুধু মেষ, ছাগ, কুষ্মাণ্ড, আখা না, অনেকে নাকি ‘আমোদ করিয়া গোধিকা, কপোত, মাগুরমাছ, লেবু, সুপারি এবং গোলমরিচ’ অবধি বলি দিতেন। বলিদানের আরতির পরে সেই রক্তমাখা উঠানে মোষ আর ছাগলের মুন্ডু নিয়ে মল্লযুদ্ধ, ব্যায়ামক্রীড়া হত। একজন উবু হয়ে বসে উরু আর পেটের মাঝে নারকেল ধরে চেপে রাখতেন। আট-দশজন বীর সেই নারকেলটি বার করে নেবার জন্য আছাড়ি পিছাড়ি করে রক্ত মেখে সারা হতেন। তারপর পথে মিছিল বার হত। সেই রক্তাক্ত দেহের পুরুষদের দেখে ‘মনে হইত যেন দক্ষযজ্ঞ ধবংস করিয়া শৈব সৈন্যেরা সদর্পে পৃথিবী কাঁপাইয়া চলিয়াছেন’। 

বলি নিয়ে একটা প্রাচীন গল্প না বললে গোটা ব্যাপারটা ম্যাড়মেড়ে লাগছে। এক বলির রাতে নেশায় চুর কর্তার খেয়াল হল এতগুলো পশুকে বলি দিয়ে স্বর্গে পাঠাচ্ছি, আমার কত পুণ্য হচ্ছে, যদি স্বয়ং গুরুদেবকে বলি দিই, তাহলে কতই না পুণ্য হবে। ‘গুরুকেও এই কথা বলামত্র তিনি তথাস্তু বলিয়া নাচিয়া উঠিলেন’। তাঁকে হাড়িকাঠে নিয়ে যাওয়া হল। যারা বলি দেবেন, তাঁরা শুধু মদ খাননি। কারণ মদ খেলে বলিদানের শক্তি থাকে না। মদ খাবার ভান করছিলেন মাত্র। এই ভীষণ বুদ্ধি শুনে তাঁদের তো চক্ষু চড়কগাছ। গুরুদেবও হাড়িকাঠে গলা দিয়ে হাসিহাসি মুখে বলি দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। শেষে এক কামারের মাথায় বুদ্ধি এল। সে বাবুকে বললে, “কর্তা মশাই, যে খাঁড়ায় পশুদের বলি দিই, তাতে কি গুরুদেবকে বলি দেওয়া যায়? আমি নতুন খাঁড়া নিয়ে আসছি। আপনি অপেক্ষা করুন।’ বেরিয়েই সে এক থানাদারকে ডেকে আনে। থানাদারের ধমকে বাবু এবং গুরুর এক অভিনব নরবলির ইচ্ছে পূরণ হতে পারল না।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
দুর্গাপুজো, বটতলার পুস্তিকা ও প্রথম শারদীয়া পত্রিকা