শিকারি হয়েও ব্যাঘ্র-সংরক্ষণের পক্ষে সওয়াল! জীবদ্দশাতেই বিতর্কে জিম করবেট

তখন গভীর রাত। জ্যোৎস্নায় স্নান করছে ঘন জঙ্গল। একটানা ডেকে চলেছে ঝিঁঝিঁ। আর মাঝেমধ্যে বুনো শেয়াল আর পেঁচার ডাক ভেঙে দিচ্ছে নিস্তব্ধতা। এমন এক গা ছমছমে পরিবেশে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক ব্যক্তি। পাশে চটের বস্তায় রাখা খান তিনেক রাইফেল, দুটো শটগান, হাতকুড়ুল, শাবল, ধারালো ছোরা। একে একে আগ্নেয়াস্ত্রগুলি বের করে নিলেন তিনি। সস্নেহে তাদের চুম্বন করে পুঁতে দিলেন গর্তের মধ্যে। তারপর সহকারীকে মাটি চাপা দিতে বলেই পিছনে ফিরে হাঁটা লাগালেন তিনি। প্রিয় অস্ত্রদের সমাধিস্থ করেই চিরকালের মতো ইতি টানলেন শিকারিজীবনে। 

এই ব্যক্তি আর কেউ নন, এডওয়ার্ড জেমস করবেট। অবশ্য গোটা ভারত তাঁকে চেনে জিম করবেট নামেই। আলাদা করে তাঁর পরিচয় দেওয়া এক প্রকার বাতুলতাই। ‘ম্যান আগেনস্ট ম্যানইটারস’, ‘ম্যানইটারস অফ কুমায়ন’, ‘দ্য ম্যানইটিং লেপার্ড’-সহ একাধিক জনপ্রিয় শিকার কাহিনির রচয়িতা জিম। আর এই সব কিংবদন্তি অভিযান কাহিনি নির্মিত মূলত তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেই। জীবদ্দশায় মোট ২টি চিতা এবং ১৭টি বাঘ হত্যা করেছিলেন করবেট। মতান্তরে সংখ্যাটা ৩০-৩৫-এর কাছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এমন একজন শিকারি ব্যক্তির নামেই নামকরণ হয়েছিল ভারতের প্রথম জাতীয় উদ্যানের। করবেট ন্যাশনাল পার্ক। কিন্তু একজন শিকারির নামে সংরক্ষিত অরণ্যের নামকরণের কারণ কী?

তিরিশের দশকের শুরুর দিক সেটা। ভারতে অরণ্য এবং বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাঁর হাত ধরেই। এমনকি অরণ্য সংরক্ষণের আবেদন নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের দ্বারস্থ হয়েছিল আইরিশ ‘কর্পেট’ সাহেব। আর তাঁর সৌজন্যই ১৯৩৬ সালে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের বুকে গড়ে ওঠে ভারতের প্রথম জাতীয় উদ্যান হেইলি ন্যাশনাল পার্ক। পরবর্তীকালে যার নামকরণ হয় করবেটের নামানুসারে। যদিও, করবেটের বহু আগেই ১৯১৭ সালে সংরক্ষিত অরণ্যের দাবিতে সরব হয়েছিলেন আরও দুই পরিবেশবিদ ব্রিটিশ সাহেব ই স্টিভেনস এবং ই স্মিথস। 

কিন্তু একজন জাত শিকারি হয়েও সংরক্ষণবাদী! এও কি সম্ভব? আর তা নিয়েই বিতর্ক পিছু ছাড়েনি করবেটের। দশকের পর দশক ধরে সেই বিতর্কের ধারা অব্যাহত আজও। করবেটের লেখা নথি অনুযায়ী, ১৯৩৮ সালে শেষ বাঘ হত্যা করেছিলেন তিনি। অথচ, সংরক্ষণের দাবিতে তিনি সরব হয়েছিল তিরিশের দশকের একেবারে শুরুর দিক থেকে! হিসাবে একথা স্পষ্ট যে, জাতীয় উদ্যান তৈরির পরেও শিকার অব্যাহত ছিল করবেটের। এ ঘটনা যে দ্বিচারিতা বা হিপোক্রেসি ছাড়া আর কিছুই নয়! আর বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু সেটাই। তবে আদৌ কি তিনি সংরক্ষণের সমর্থক ছিলেন? 

আরও পড়ুন
গণ্ডারের শিং কেটে নিচ্ছেন খোদ সংরক্ষণ কর্মীরাই!

এই বিতর্কে যাওয়ার আগে অবশ্যই পর্যালোচনা দরকার তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের। ১৮৭৫ সালে ভারতেই জন্ম করবেটের। কিশোরবেলাতেই বন্দুকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর। কাঁধে গাদা বন্দুক নিয়ে সেসময় তিনি একলাই ঘুরে বেড়াতেন উত্তরপ্রদেশের গভীর জঙ্গলে। স্থানীয় আদিবাসীদের থেকে শিখতেন আঞ্চলিক পাহাড়ি ভাষা। নকল করতেন পশু-পাখির ডাক। সে যেন এক দামাল কিশোরের গল্প। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, বন্দুকের সঙ্গে বড়ো হয়ে উঠলেও, তাঁর প্রথম ব্যাঘ্রশিকার কিন্তু ১৯০৭ সালে। আর তার পরের তিন দশকে প্রায় কুড়িটি হিংস্র শ্বাপদ শিকার করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন
ড্রোনের ব্যবহার এবার ডলফিন সংরক্ষণেও, দৃষ্টান্ত তৈরি নিউজিল্যান্ডের

যে সময়ের কথা হচ্ছে, তখন শিকারের রীতি জনপ্রিয় গোটা ভারত জুড়েই। আর তার সঙ্গে জড়িত মূলত ব্রিটিশ সাহেব এবং দেশের বিভিন্ন রাজপরিবার। মহাসমারোহে শিকার অভিযান একপ্রকার আভিজাত্যেরই প্রতীক হয়ে উঠেছিল সেসময়। অনেকসময় রাজন্যদের সঙ্গও দিতে হয়েছে করবেটকে। তবে পরবর্তী জীবনে এমন প্রস্তাব অনেকক্ষেত্রেই মানতে পারেননি জিম।

আরও পড়ুন
৩৭ বছর পর দেখা মিলল ক্লাউডেড লেপার্ডের, উঠছে সংরক্ষণের দাবি

করবেটের ব্যক্তিগত শিকারের মূল কারণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মূলত, জীবদ্দশায় তিনি যে কটি প্রাণীর শিকার করেছিলেন, তার সবকটিই ছিল মানুষখেকো। সহজ করে বলতে গেলে, একপ্রকার জনস্বার্থেই যেন বন্দুক তুলে নিয়েছিলেন করবেট। আর সেই কারণেই হয়তো কুমায়ূনের স্থানীয় মানুষদের কাছে ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বাঘকে ‘নিষ্ঠুর হত্যাকারী’ হিসাবে বর্ণনা করতে ঘোরতর আপত্তি তাঁর। নিজের লেখাতেই একাধিকবার করবেট স্পষ্ট করে দিয়েছেন সেই জায়গাটা। তাঁর স্পষ্ট দাবি, বয়ঃবৃদ্ধির কারণে শিকারে ক্ষমতা লোপ পেলে মানুষখেকো হয়ে ওঠে বাঘ। আর সেই কারণেই ব্যাঘ্রহত্যা।

কিন্তু মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এহেন দমননীতি কতটা যুক্তিযুক্ত? তা নিয়েই পরবর্তীতে সরব হয়েছেন ভারতের পরিবেশবিদরা। জীবদ্দশাতেও একাধিকবার তীর্যক উক্তিতে বিদ্ধ হয়েছেন করবেট। এই দোলাচলই হয়তো ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল করবেটকে। জীবনের ৮০ শতাংশ সময় ভারতে কাটালেও, শেষ বয়সে তাই ‘বিদেশযাত্রা’? স্বাধীনতার বছরেই নভেম্বর মাসে ভারত ছেড়ে নিঃশব্দেই সপরিবারে আফ্রিকায় চলে গিয়েছিলেন জিম। প্রিয় স্থানীয় মানুষগুলোকে না জানিয়েই। তার আগে দান করে গিয়েছিলেন নিজের সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা। আর চিরসঙ্গী আগ্নেয়াস্ত্ররা? তা আজও শায়িত রয়েছে নৈনিতালের গভীর জঙ্গলে। না, আফ্রিকায় গিয়ে আর বন্দুক ধরেননি জিম। বরং, শিকারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন বৃহত্তর প্রতিবাদ। সেখানেও পিছু ছাড়েনি বিতর্ক। শিকারিজীবন ছেড়ে সংরক্ষণবাদী হয়ে ওঠাতেও তাঁকে শিকার হয়ে হয়েছিল তাচ্ছিল্যের। খোদ ঔপনিবেশিক সাহেবরাই সেদিন বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর। এমনকি প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর লেখা অভিযান কাহিনিগুলির সত্যতা নিয়েও। দু’তরফা এই বিতর্ক তাঁর মৃত্যুর পর আজও আবহমান সমানভাবে। শুধু এসবের মাঝে আজও নায়কের আসনে বসিয়ে রেখেছে কালাধুঙ্গি-হলদিয়ানি-কুমায়নের ‘নেটিভ’রা। আর ‘কাল্ট’ হয়ে থেকে গেছেন জিম করবেট…

Powered by Froala Editor