দারিদ্র্য বাধা নয় মুক্তচিন্তার, পরিবেশ দিবসে প্রমাণ করল চিত্তরঞ্জনের প্রান্তিক পড়ুয়ারাই

ভিড়ে ঠাসা কুলি-কামিনে ভর্তি একটা বাস ছুটে গেল আসানসোলের দিক থেকে। তার মধ্যেই একেকটি স্টপে উঠলো কমবয়সি কয়েকটি ছেলেমেয়ে। চিত্তরঞ্জন পৌঁছে ওরা একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করবে। প্রায় দেড় কিলোমিটার হাঁটার পর পৌঁছোবে দেশবন্ধু মহাবিদ্যালয়ে। এই সরকারি কলেজটাই ওদের স্বপ্ন পূরণের ঠিকানা। ওদের কারোর কারোর পরিবারে আগে কেউ কলেজে যায়নি। কেউ কেউ তো আবার পড়াশুনাই শেখেনি একেবারে। কিন্তু দেশবন্ধু কলেজে এসে তারা নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আর সেই স্বপ্নের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে বর্তমান সময়ও।

আজকের সময়ের সবচেয়ে বড়ো সংকট প্রকৃতির সংকট। তাই প্রকৃতিকে বাঁচানোই সময়ের তাগিদ। সেই কর্মযজ্ঞে হাত মেলাল এইসব পড়ুয়ারাও। সমাজের একেবারে প্রান্তিক অবস্থান থেকে উঠে এসেও, তাদের কাছে আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবসের গুরুত্বটা অন্যদের থেকে কিছু কম নয়। তবে লকডাউনের মধ্যে তো অন্য ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়ার অবকাশ নেই। পড়ুয়ারা তাই নিজেদের আঁকা ছবি এবং গাছ লাগানো ও পরিচর্যার ছবি জুড়ে জুড়ে বানিয়েছেন একটি ভিডিও। তারপর সেগুলো পোস্ট করা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। এভাবেই যদি কিছুটা সচেতনতা তৈরি করা যায়।


আসানসোল শিল্পাঞ্চলের বুকে ছোট্ট শহর চিত্তরঞ্জন। ছোট হলেও তার নাম শুনেছেন প্রত্যেকেই। বাংলার বুকে রেল ইঞ্জিন তৈরির কারখানার জন্য সকলের কাছেই পরিচিত। তবে এই শহরের মানুষদের খোঁজ আর কতজনই বা রাখেন? অবশ্য সেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দাই আসলে অন্য কোথাও থেকে এসেছেন। কর্মসূত্রে থাকেন চিত্তরঞ্জনে, আবার একদিন ফিরে যাবেন। তবে কারোর কারোর শিকড় এই শহরেই, অথবা আশেপাশের গ্রামে। তাঁরা রেলের অফিসের চাকুরে নন, কোনোরকমে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকের কাজ করে দিন চলে। সংসারের অবস্থা মোটের উপর বেশ খারাপ। তাই একটু বড়ো হলেই মেয়েদের জন্য হয় বিয়ের চিন্তা, আর ছেলেদের খুঁজতে শুরু করতে হয় একটু উপার্জনের রাস্তা। পড়াশুনো করার সময় কোথায়? তবে এর মধ্যেও কোনোরকমে নিজেদের স্বপ্ন পূরণের লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছে সেখানকার ছেলেমেয়েরা। শহরের বুকে আছে দেশবন্ধু মহাবিদ্যালয়, সেখানেই পড়াশুনো করেন এইসব হতদরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা।

সরকারি কলেজ, ফলে বার্ষিক বেতন বেশ কম। কিন্তু সেটুকুও দেওয়ার ক্ষমতা নেই অনেকের। কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রায়ই বেতন মুকুবের জন্য আবেদন জমা পড়ে। প্রহরকে সেই কথাই জানালেন কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষিকা দেবলীনা চৌধুরী। বলছিলেন, কলেজে উপস্থিতির হার যে খুব ভালো তেমনটা নয়। কিন্তু কলেজের প্রতি একটা টান যে প্রত্যেক পড়ুয়ার মধ্যেই আছে, সেটা স্পষ্টভাবেই বোঝা গেল এই লকডাউনের সময়। একের পর এক অনুষ্ঠানে কলেজের পড়ুয়ারা মিলিত অংশগ্রহণ করেছে ইন্টারনেটে 'টিমলিংকে'র মাধ্যমে। শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের মধ্যে দিয়ে। তারপর সেখান থেকে একে একে ১৯ মে বাংলা ভাষা দিবস, নজরুলজয়ন্তী, এছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ওয়েবমিনার; এভাবেই কেটে যাচ্ছিল লকডাউনের দিনগুলি। আর তার মধ্যেই যোগ হল আরও একটি বিশেষ দিন। আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস। প্রকৃতিকে বাঁচানোর লড়াইটা যে প্রত্যেককে একসঙ্গেই লড়তে হবে। এখানে কেউই ব্রাত্য হয়ে থাকলে চলবে না। সচেতনতা তো কোনো অর্থনৈতিক শ্রেণীর একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। দেশবন্ধু কলেজের পড়ুয়ারা আর একবার সেই কথাটাই প্রমাণ করে দিল।

দেশ বা রাজ্যের প্রথম সারির কলেজগুলির নাম করলে হয়তো দেশবন্ধু মহাবিদ্যালয়ের নাম আসবে না। এখানে পড়ুয়াদের গড় ফলাফল যে খুব ভালো, তাও নয়। কিন্তু যে পরিবেশের থেকে উঠে এসেছে তারা, তাতে পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়াটাই তো একটা বিরাট সাফল্য। কিন্তু এইসব প্রান্তিক পড়ুয়াদের জন্য শিক্ষাটা বোধহয় চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখা যায় না। শিক্ষা তো একটা যাপন। যে যাপনের মধ্যে সময়ের একেকটি চাহিদা ফুটে উঠতে চায়। সেই কথাগুলোই নিজস্ব ভঙ্গিতে প্রকাশ করে পড়ুয়ারা। সেইসঙ্গে মিশে থাকে নিজেদের জীবনের সংগ্রামও। সেই কথাই বলছিলেন দেবলীনা চৌধুরী। তাছাড়াও তাঁর মতে, "প্রতিটা ক্ষেত্রে ছাত্রীরাই এগিয়ে এসেছে। ওরাই বেশি উৎসাহী।" অর্থাৎ বিয়ে, সংসার এবং ঘরকন্না বাদ দিয়েও যে এই সমাজে তাদের কোনো অস্তিত্ব আছে, সেটা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন পড়ুয়ারা। এই বিপন্ন পরিবেশকে বদলাতে গেলে তো এভাবেই বদলাতে হবে আমাদের ভাঙাচোরা সমাজকেও।

Powered by Froala Editor