নোবেল পুরস্কার পেয়েও ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির দশটা বছর পেরিয়ে গিয়েও স্প্যানিশ কবি গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের কোনো বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি। বিশ্বসাহিত্যের পাঠকদের থেকে তাঁকে বঞ্চিত করে রাখার এমন ইতিহাস মন ভারাক্রান্ত করে দেয় বারবার। তবে, উপেক্ষার নজির শুধু এটুকুই নয়। স্প্যানিশ কবিতার ইংরেজি সংকলন থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। এমনকি ইংরেজি ভাষায় স্প্যানিশ সাহিত্য নিয়ে আলোচনা গ্রন্থগুলির মধ্যেও গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের কবিতা নিয়ে সেভাবে কোনো আলোচনা পাওয়া যায় না । তাঁর মৃত্যু সংবাদ পর্যন্ত গণপাঠকসমাজে নিয়ে আসতে দ্বিধা করেছে বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যম। গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের ছদ্মনামের আড়ালে লুসিয়া গদয় আলকিয়াগাকে ঘিরে এমন উপেক্ষা আমাদের ভাবায়। অথচ তিনিই তো লিখেছেন,  “...when I am a little/ heap of silent dust, play with me, with/ the earth of my heart and of my bones!" 

'শিশুদের প্রতি' এই কবিতা পড়তে পড়তে আমি দেখতে পাচ্ছি, পনেরো বছর বয়সের একজন তরুণী চিলির এক পল্লীগ্রামের অবৈতনিক স্কুলে শিক্ষা দান করার দায়িত্ব নিচ্ছেন। বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘুরে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের পড়ানোই শুধু নয়, বেদনার সঙ্গীও হয়ে উঠছেন সেই শিক্ষিকা। শিশুরা যেন এক কবিতার পথরেখা অন্তরালে এঁকে দিচ্ছে তাদের রং-পেনসিল দিয়ে। 

হঠাৎ, আঠারো বছর বয়সের উঠোনে দাঁড়িয়ে সেই তরুণী দেখলেন তাঁর প্রেমিকের আত্মহননের দৃশ্য। প্রেম কি মরে গেল তাঁর? না, প্রেম এল লুসিয়ার কাছে মৃত্যুর প্রথম সনেট হয়ে। মৃত্যুর পরেও জীবিত থাকার কথা কবিতায় ধরলেন গ্রামের লাজুক মেয়েটি। এমন সময়, ১৯১৪ সালে চিলির লেখক সমিতি সান্তিযা়গোতে কবিতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। লুসিযা় লাজুক, গ্রামের মেয়ের কুণ্ঠায় ছদ্মনাম নিলেন গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল। তাঁর দুজন প্রিয় লেখকদের নাম থেকে ধার করলেন নতুন পরিচয়— ইতালির কবি ও নাট্যকার গ্যাব্রিয়েলা ডি'আনুনজিও এবং ফরাসি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত কবি ফ্রেডরিক মিস্ত্রাল। অথচ, প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করার পরও নিজের পরিচয় দিতে পারেননি ঠিক করে। 

এদিকে শিক্ষিকা হিসেবে তাঁর নাম আঞ্চলিক মানচিত্র ছাড়িয়ে যেতে থাকে। গ্রামের বিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারগুলি পুনর্গঠন করার জন্য আমন্ত্রণ পান মেক্সিকো থেকে। ইতিহাসের আয়না বারবার স্পষ্ট করে দেয়, সামাজিক দায়িত্ব সম্পন্ন মানুষই শিল্পীর স্তরে নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন। গজদন্ত মিনারে বসে ক্ষমতার জুতো মাথায় রেখে ছদ্মসাহিত্যিক সাজা যায় হয়তো, কিন্তু জনগণের শিল্পী হয়ে ওঠা যায় না। 

আরও পড়ুন
‘মায়াবন্দরের দিকে’ পাড়ি দিলেন কবি মৃণাল বসু চৌধুরী, ফুরলো শ্রুতি আন্দোলনের অধ্যায়

ততদিনে বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে। কবিতাপাঠের সভায় তাঁর কবিতা আবৃত্তির জন্য ভিড় করছে সেনুষজন। অথচ তাঁর কবিতার বই কেউ প্রকাশ করতে চাইছে না। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্প্যানিশ সাহিত্যের অধ্যাপক ড. দ্য ওনিস ক্লাসে মিস্ত্রালের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। ছাত্ররা পড়তে চায় তাঁর কাব্যগ্রন্থ। শেষে ছাত্ররাই চাঁদা তুলে ১৯২২ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'দেসোলেশিও' নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশ করে। ভালো সাহিত্যকে কেউ কোনোদিন চেপে রাখতে পারেনি পারবেও না; যদিও চেপে রাখার সংস্কৃতি স্পেন হোক বা ভারত— আজও বহমান। মিস্ত্রাল পরবর্তী বই ‘টেনুরা’ বা ‘টেন্ডারনেস’ লেখেন সেই সমস্ত বৈপ্লবিক তরুণদের ভালোবেসেই। সর্বশেষ বই ‘টালা’ বা ‘হ্যাভক’ লেখেন ফ্রাংকোর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে । 

আরও পড়ুন
কারাগারে বসে লেখা ভালোবাসার কবিতা, বিশ্বের ‘প্রাচীনতম’ ভ্যালেন্টাইনের নিদর্শন এটিই

এরপর মিস্ত্রালের জীবনে এলেন রবীন্দ্রনাথ। নতুন এক পথ। রবীন্দ্রনাথকে স্প্যানিশে অনুবাদ করার সময় তাঁর টীকা প্রস্তুত করছিলেন তিনি। হয়তো ভিতর থেকে নিজেকেও নতুনভাবে ভেঙে-গড়ে নিচ্ছিলেন বারবার। রবীন্দ্রনাথের জীবনের আঘাত, বিচ্ছিন্নতা তাঁকেও ছুঁয়ে গেছে। তবুও অপার মানবিক প্রেম থেকে কখনও দূরে সরে যাননি। প্রেমিকের মৃত্যুর পর আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাননি মিস্ত্রাল। তবু তো নারী, স্বপ্ন থাকে নিজস্ব ঘর-সংসার-সন্তানের। সেই আর্তির সুর অপার মাতৃত্বের ছন্দ হয়ে তাঁর কবিতার আজও বেজে চলে, একটু কান পাতলেই আমরা শুনতে পাব ঠিক— "ঘুমন্ত শিশুকে ঘিরে মায়ের বুকের যত সাধ, / ধরণী দোলাবে ওই রুগণ শরীরের আস্তরণী,/ সুখের শিহর নেবে তোমার কান্নার অবসাদ।" ( ভাবী স্বামীর আত্মহত্যার পর / অনুবাদ : অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)

আরও পড়ুন
প্রয়াত কবি প্রভাত চৌধুরী, শোকস্তব্ধ অনুরাগীরা

Powered by Froala Editor