রুশ বিপ্লবীদের গ্যোয়েতের 'ফাউস্ট' পাঠ করে শোনাচ্ছেন লেনিন

রবিবারের সকাল, উলিয়ানভ পরিবারের সকলে চার্চ থেকে ফিরে এসেছেন। ইলিয়া উইলিয়ানভের সঙ্গে আছে শিশু ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ। ইলিয়া ছিলেন স্কুল ইন্সপেক্টর ও শিক্ষাবিদ। বাড়িতে ফিরেই ছেলেদের পাঠ ও আবৃত্তি করে শোনাবেন শেক্সপিয়র, গ্যোয়েতে কিংবা পুশকিন। বাইরে তখন জারতন্ত্রের কড়া প্রহরা। ভবিষ্যতে এই জারতন্ত্রকে উৎখাত করতে, বিশ্বমানবতার জন্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের কারিগর ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ গোপন নাম নেবেন 'লেনিন'।

উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে ভ্লাদিমির ইলিচের পছন্দের বিষয় ছিল ল্যাটিন ভাষা। মাস্টারমশাই স্বপ্ন দেখছেন, হয়তো তার ছাত্র ল্যাটিন সাহিত্য ভাষাবিদ হবে। তাঁর অন্যান্য পছন্দের বিষয়ের অন্যতম ইতিহাস ও ধ্রুপদী সাহিত্য। একজন বিপ্লবীর দেশ ও পৃথিবীর প্রতি একটা দৃষ্টিভঙ্গি কোথাও না কোথাও ভিতর থেকে তৈরি হয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য। মূল ভাষা থেকে পাঠ করছেন রোমান ধ্রুপদী সাহিত্যের মধ্যে ওভিড, ভার্জিল, জুভেনাল কিংবা রোমান রাষ্ট্র নায়কদের বক্তৃতা। বিপ্লবের সফলতার পর শ্রমিকশ্রেণির মাঝখানে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করা 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' ছবিটির সামনে দাঁডা়লে কোনও অংশে রোমান কিংবা গ্রীক নায়কদের থেকে কম মনে হয় না। আস্তে আস্তে স্কুলের গণ্ডি পার হচ্ছে লেনিন। জারের রাশিয়ার ভিতর তৈরি হচ্ছে কৃষক অসন্তোষ । লেনিন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জেলে যাচ্ছেন ও সেখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন দেশ থেকে দুই দশকের জন্য । সেখানে তিনি মন দিয়ে পড়ছেন গ্যোযে়তের 'ফাউস্ট'। 

১৯১৭ সাল এপ্রিল মাস, লেনিন তার বৈপ্লবিক তত্ত্বের সাহায্যে রাশিয়ার গোঁড়া সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলকে উপড়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন সমাজতান্ত্রিক বলশেভিক সংগঠন। দামামা বেজে উঠছে অক্টোবর বিপ্লবের । এই তত্ত্বের উপর তাঁর নিজের কমরেডরাও যখন ভরসা রাখতে পারছেন না, লেনিন উচ্চারণ করছেন গ্যোয়েতের 'ফাউস্ট' থেকে মেফিস্টোফিলিসের সংলাপ “Theory, my friend, is grey, but green is the eternal tree of life.” ( তত্ত্ব, হে সাথি আমার, ধূসর, কিন্তু জীবন বৃক্ষের নামে তা বড়োই সবুজ)।

বিপ্লবের পরিকাঠামো ও জনপরিসরে বিপ্লবের দর্শনকে প্রচার করার জন্য তিনি রুশ সাহিত্যের উপর নির্ভর করেছিলেন। কারণ লেনিন মনে করতেন যে রুশ সাহিত্যে জীবন ও রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। লেনিন পুশকিন পাঠ করে দেখছেন, কীভাবে হিংস্র জার প্রথম নিকোলাসের সিংহাসন আরোহনের বিরুদ্ধে ১৮২৫এর 'ডিসেম্বরিস্ট উত্থান'এর পাশে দাঁড়াচ্ছে তাঁর লেখা। লক্ষ করছেন, নিকোলাই গোগল কিংবা ইভান তুর্গেনভের লেখা ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচারীর কর্মকাণ্ড। রাশিয়ার সর্বজ্ঞবাদী রাষ্ট্রদর্শনকে কীভাবে তলস্তয় নসাৎ করছেন, লেনিন পড়তে পড়তে অবাক হয়ে যাচ্ছেন। নিজের কমরেডদের পড়তে বলছেন পথ নির্মাণের সহায়তার জন্য। লেনিন বই লিখছেন ভবিষ্যতে "তলস্তয় : রুশ বিপ্লবের দর্পণ"।  তলস্তয়ের রচিত সমাজ ও চরিত্রের বৈপরিত্য পরবর্তীতে লেনিনের রুশ সমাজের চরিত্রের হদিস বুঝতে সাহায্য করেছে। ১৯১৮ সালে 'ইজভেস্তা' সংবাদপত্রে তাই রুশ সাহিত্যিকদের মূর্তি নির্মাণের কথা প্রকাশ পাশ যার মধ্যে অন্যতম তলস্তয় । 

আরও পড়ুন
মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সুভাষবাদ, জ্যোতিবাদ…

সবকিছুর পর যে সাহিত্যিক একজন বিপ্লবী ও রাষ্ট্রপিতার মনন তৈরি করতে সবচেয়ে সহায়তা করেছেন, তিনি হলেন সমাজতান্ত্রিক ও বস্তুবাদী দার্শনিক নিকোলাই চেরনিভেস্কি। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'What is to be Done?' থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভবিষ্যতে একই নামে তিনি একটি বক্তৃতা দেন ও পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক গ্রন্থের রূপ পায় 'কি করতে হবে?'। মার্কসকে পড়বার আগে চেরনিভেস্কিকে পাঠ করেছিলেন লেনিন, যেই চেরনিভেস্কি স্বয়ং মার্কসের সঙ্গে চিঠি বিনিময় করতেন। লেনিন আত্মগোপন করে থাকার সময় ভেরা পাভলোভনার মতো চরিত্রকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাস পাঠ করার জন্য লেনিনকে সমালোচিত হতে হয় অন্য বিপ্লবীদের কাছে। 

আরও পড়ুন
মস্কোয় হাজির ভূপেন্দ্রনাথ, দেখা করলেন লেনিনের সঙ্গেও; স্বামীজির 'কমিউনিস্ট' ভাই-এর গল্প

বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে লেনিনের 'কী করতে হবে?' বইটিকে বৈপ্লবিক বাইবেল বলে মনে করা হয়। এমনকি লেনিনের লাইব্রেরি থেকে পাওয়া যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রন্থও!

আরও পড়ুন
দেশের মোড়ল-কে দেখতে আসা, ‘সাধারণ’ লেনিনকে চিনতে পারল না চাষিরা

যারা অন্ধ পার্টি'মার্কস'বাদী, কয়েকটা কোটেশন আর পূজা পার্বণে লাল কাপড়ে স্টল বেঁধে কিছু অপাঠ্য বাংলা অনুবাদে ভরা মার্কসীয় সাহিত্যের মধ্যে লেনিনের বইয়ের পাশে অন্য বইকে বলে বুর্জোয়া সাহিত্য, তাদের জন্য বলি, লেনিন মনে করতেন না 'শ্রমিকশ্রেণির সাহিত্য ও শিল্প' বলে কিছু হয় । কারণ কোনো শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাজার বছরের বুর্জোয়া সাহিত্য ও শিল্পের পাঠ।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor