মস্কোয় হাজির ভূপেন্দ্রনাথ, দেখা করলেন লেনিনের সঙ্গেও; স্বামীজির 'কমিউনিস্ট' ভাই-এর গল্প

১৯০৮ সাল। বঙ্গভঙ্গের আগুন তখনও নিভে যায়নি; বরং আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলার মাটিতে জন্ম নিচ্ছেন বিপ্লবীরা। আপাত শান্ত বাঙালি যুবাদের হাতে উঠে আসছে পিস্তল, বোমা। কেউ ফাঁসিকাঠে, পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিচ্ছে; কেউ আবার বরণ করছে জেলখানার অন্ধকার। এরকমই জ্বলন্ত পরিবেশে বসেই চলে যাব আরও একটি জায়গার দিকে। কলকাতা থেকে বেশ কিছুটা দূরে, গঙ্গার ওপারের শান্ত বেলুড় মঠ। আমাদের গল্পের কেন্দ্রভূমি…

শান্ত বললাম বটে; কিন্তু সত্যিই কি তাই? কয়েক বছর হল প্রয়াত হয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ। শোক এখনও যায়নি মঠের মাটি থেকে। তার মধ্যেই সেখানে হাজির হয়েছেন নতুন এক সন্ন্যাসী— বসন্তকুমার ব্রহ্মচারী। বেলুড় মঠ কখনই রাজনীতির ময়দানে পা দেবে না, বিপ্লবী আন্দোলনের অংশ হবে না— এটাই ভাবতেন ব্রিটিশ সরকার। এমনটা ভাবা আশ্চর্য নয় মোটেই। ইতিমধ্যেই আন্দামানে দ্বীপান্তরে পাঠানো হবে কয়েকজন বাঙালি বিপ্লবীকে। সেই তালিকাও এসে গেছে। ব্রিটিশরা জানতেও পারল না, এই বিপ্লবীদেরই একজন গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে আছেন বেলুড় মঠে। গায়ে সন্ন্যাসীর পোশাক; কিন্তু ভেতরে তখনও জ্বলছে আগুন। কে সেই বিপ্লবী? ওই যে খানিক আগেই যে নাম বললাম। ‘বসন্তকুমার ব্রহ্মচারী’। তবে এই মানুষটির আসল নামও জানেন মঠের সবাই। ইনি যে স্বামীজিরই ছোটো ভাই, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত… 

স্বামী বিবেকানন্দ, অর্থাৎ নরেন্দ্রনাথ দত্তের থেকে বছর সতেরোর ছোটো। জন্মস্থান উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলের সেই বিখ্যাত বাড়িটি। একটু একটু করে যখন বড়ো হচ্ছেন, ততদিনে নরেন্দ্রনাথের খোলস বদলে জন্ম হয়েছে বিবেকানন্দের। শিকাগো ধর্মসভার উদ্দেশ্যে চলেও গিয়েছেন তিনি। এদিকে কলকাতার বুকে একটু একটু করে বড়ো হচ্ছেন ভাই ভূপেন্দ্রনাথ। ভগিনী নিবেদিতার আদরের ‘ভূ’। তবে কারোর ছায়ায় আটকে থাকার লোক যে তিনি নন, সেটা অনেক আগেই বোঝা গিয়েছিল। সমাজের তথাকথিত আচার-বিচার, কুসংস্কার কখনই মানেননি তিনি। যোগ দিয়েছিলেন ব্রাহ্মসমাজে। তবে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের আসল পরিচয় সেখানে নয়। 

তখন সদ্য বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করেছেন লর্ড কার্জন। গোটা বাংলা নেমে এসেছে রাস্তায়। বিপ্লবী আন্দোলনও জোরদার হচ্ছে। এমন সময়ই প্রকাশিত হল ‘যুগান্তর’ পত্রিকা। অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্তের সঙ্গে চলে এলেন ভূপেন্দ্রনাথও। ইংরেজদের না তাড়ালে দেশের মুক্তি নেই, আমাদের মুক্তি নেই— এই চিন্তা যেন চেপে বসল তাঁর মধ্যে। ১৯০৬ সালে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সম্পাদকের পদেও বসলেন ভূপেন্দ্রনাথ। মাত্র এক পয়সা দাম; খুব তাড়াতাড়িই ছড়িয়ে পড়ল এই পত্রিকা। যে করেই হোক, সবার মধ্যে স্বাধীনতার সুপ্ত চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। দাদাই তো বারবার বলে গেছেন এমন কথা! যুগান্তরের সঙ্গে ‘সোনার বাংলা’ নামেও একটি ইস্তেহার প্রকাশ করতে শুরু করলেন।

আর এখানেই নজরে পড়লেন ব্রিটিশ সরকারের। যুগান্তরের মতো বিপ্লবী পত্রিকার ওপর নজর ছিলই। যে করেই হোক, বিদ্রোহ দমন করাই লক্ষ্য ইংরেজদের। তার জন্য পত্রিকা এবং ইস্তেহার প্রকাশেও বাধা দিতে লাগল তাঁরা। তাঁদের নজর পড়ল ভূপেন্দ্রনাথের ওপর। ১৯০৭ সাল। হাতকড়া পড়ল তাঁর হাতে। এক বছরের জন্য কারাগারের পেছনে জায়গা পেলেন তিনি। তবে মনোবল ভাঙল না এতটুকুও; বরং আরও সতেজ হলেন… 

এরপরের পর্বটি অবশ্য এদেশে নয়। ভগিনী নিবেদিতা তাঁর প্রিয় ‘ভূ’-কে আমেরিকায় চলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। সেখানে গিয়েই উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ। ভাগ্যের নিয়তি দেখুন! বড়ো দাদা স্বামী বিবেকানন্দও চলে এসেছিলেন আমেরিকায়, এবং এখান থেকেই এক অন্য দিগন্ত খুলে গিয়েছিল। ভূপেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও সেই একই জিনিস হল। আমেরিকার গদর পার্টি থেকে জার্মানির বার্লিন কমিটি— সমস্ত জায়গায় তাঁর সগৌরব উপস্থিতি। বার্লিন কমিটির সম্পাদকের পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ। ততদিনে ভেতরে একটু একটু করে দানা বেঁধেছে সমাজতন্ত্র। স্বপ্ন দেখছেন কমিউনিজমের। একসময় চলে গিয়েছিলেন মস্কোতে। মনে করুন সেই সময়ের কথা। তখনও রাশিয়ায় বিরাজ করছেন ভ্লাদিমির লেনিন। খোদ লেনিনের কাছেই পৌঁছে গিয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। বাঙালি তরুণের বুদ্ধি, চিন্তায় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এক অর্থে সত্যিকারের ‘আন্তর্জাতিক’ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ…  

আরও পড়ুন
পুলিশের চোখে ধুলো দিতে সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন বিপ্লবী উধম সিং

শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা এসেছিল দেশে। নিজের চোখে সেটা দেখেওছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু এতটুকুও বাড়তি সুবিধা নেননি। শুধু মনে পড়ে যাচ্ছিল একটা কথা। ১৯০৭ সালে যখন গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি, তখন কলকাতায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল মা ভুবনেশ্বরী দেবীকে। এমন রত্নগর্ভা তিনি; তিন ছেলেই বিশ্বজয় করেছে। বিদ্যায়, বুদ্ধিতে গোটা জাতিকে পথ দেখাচ্ছেন। এমন মানুষকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে না, সেটা কি হয়! যথাসময় এই খবর পৌঁছয় ভূপেন্দ্রনাথের কানে। জেল থেকে বেরিয়ে মা-কে বলেছিলেন, বিবেকানন্দের মা হয়ে তো তুমি স্বীকৃতি পেলে না, কিন্তু আমার মা হয়ে পেলে! নিছক মজা করেই বলা, তাই নয় কি!

তথ্যসূত্র-
১) ‘ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত’, সব বাংলায়
২) ‘স্বামী বিবেকানন্দের বিপ্লবী ভাই ভূপেন্দ্রনাথ লেনিনের কাছে পৌঁছেছিলেন’, কলকাতা ২৪x৭ 

Powered by Froala Editor

More From Author See More