৬৩ দিন অনশনের পর মৃত্যু বিপ্লবী যতীন দাসের, মরদেহ কাঁধে তুলে নিলেন সুভাষচন্দ্র

১৯২৯ সালের ১৪ জুন। রোজকার মতো কলকাতার দিন শুরু হয়েছে। আপাতভাবে শান্ত দেখালেও, পরিস্থিতি কি তেমন ছিল? ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ফুটছে গোটা দেশ, ফুটছে বাংলা। দলে দলে যুবকেরা তুলে নিচ্ছে পিস্তল। সরকারের ভেতরে ক্রমশ ভয় বাড়ছে। সেইসঙ্গে চলছে ব্যাপক ধরপাকড়, অভিযান। আগের বছরেই লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে ঘাতক পুলিশ স্যান্ডার্স-কে হত্যা করে। আর জুনের প্রথম দিকেই দিল্লির অ্যাসেম্বলি হলে বোমা ফাটান বিপ্লবী ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত। এমন পরিস্থিতিতেই হাজরা রোডের একটি বাড়িতে অভিযান চালাল ব্রিটিশ পুলিশ। গোপন খবর, এখানে লুকিয়ে আছে এক বিপ্লবী। দোতলায় উঠে পেয়েও যায় তাঁকে। ২৪ বছরের এক তরুণ; নাম যতীন দাস…

জেলখানার অভিজ্ঞতা যতীনের অবশ্য নতুন নয়। তখন ১৯২১ সাল। সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে একদল যুবক কলকাতার একটি কাপড়ের দোকানের সামনে পিকেটিং আরম্ভ করলে অনেকের সঙ্গে তিনিও গ্রেফতার হন। বেশিদিন অবশ্য আটকে রাখা যায়নি। জেল থেকে বেরিয়ে আবার শুরু করেন আন্দোলন। ধীরে ধীরে মহাত্মা গান্ধীর নীতি থেকে সরে আসছিলেন বিপ্লবী ভাবধারায়। যোগাযোগ বাড়ছিল বাকিদের সঙ্গে। এমন সময় আবার কারাবরণ! তখন যতীন দাস বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র। এবার কলকাতায় নয়, পাঠিয়ে দেওয়া হল সোজা ময়মনসিংহে। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশেরা বন্দিদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করতে শুরু করে। এটা কেন হবে? তাঁরা তো রাজনৈতিক বন্দি! সেরকম মর্যাদা কেন দেওয়া হবে না? যতীন দাস শুরু করলেন অনশন। একসময় জেল সুপার নিজে এসে ক্ষমা চাইলেন যতীন দাসের কাছে। তখন ভঙ্গ হল অনশন, ছাড়াও পেলেন কিছু সময় পর… 

এহেন মানুষটি যে সহজে হার মানবে না, তা বিলক্ষণ জানতেন ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু আফসোস, যতীন দাস সম্পর্কে যতটুকু জেনেছেন বা দেখেছেন তাঁরা, তিনি এসবের থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী। সেইসঙ্গে গ্রেফতার করা হয়েছে ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরু-সহ আরও ১৭ জন বিপ্লবীকে। প্রথমত পুলিশ অফিসার স্যান্ডার্স হত্যা, দ্বিতীয়ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র— এই দুই অপরাধ সামনে এনে শুরু হল ইতিহাস বিখ্যাত লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা। সমস্ত বন্দি বিপ্লবীদের নিয়ে যাওয়া হল লাহোর সেন্ট্রাল জেলে। সেই দলে ছিলেন যতীন দাসও। তখনও কি ব্রিটিশরা জানতেন, তাঁদের জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করে আছে? 

লাহোরে এসেও বন্দিদের দুর্দশা দেখতে হয় তাঁকে। পুলিশ ও জেল কর্তৃপক্ষও দিনের পর দিন দুর্ব্যবহার করে চলেছে। এ তো সহ্য করা যায় না! তাঁরা তো রাজনৈতিক বন্দি; সমস্ত জায়গায় তাঁদের সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করা হবে? মানবিক সুযোগ সুবিধা কেন দেওয়া হবে না? এই প্রশ্নগুলো যতীন দাসের মনে ঘোরাফেরা করতে থাকে। এর আগেও এমনটা দেখেছেন তিনি। সেই সময় যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, এবার আরও জোরালোভাবে সেই পদক্ষেপটাই নিলেন। আমরণ অনশন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলেন বিপ্লবী যতীন দাস। ১৩ জুলাই লাহোর সেন্ট্রাল জেলে শুরু হল যুদ্ধ। মনে রাখতে হবে, সেই সময় স্বাধীনতার জন্য, দেশের জন্য মৃত্যুবরণের আদর্শেই দীক্ষিত হতেন বিপ্লবীরা। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে গুলিতে প্রাণ বিসর্জন, বা ফাঁসি হওয়া সেটা এক ব্যাপার; আর আমরণ অনশন ছিল অন্য ব্যাপার। এখানে মৃত্যু একটু একটু করে দেহস্পর্শ করে। আর যতীন দাস ছাড়া আর কারোর এমন অভিজ্ঞতাও ছিল না। কোনো পরোয়া করলেন না তিনি। যদি একা লড়ে যেতে হয়, তাই করবেন। শুরু হল দীর্ঘ এক যুদ্ধ… 

ব্রিটিশ সরকার কম চেষ্টা করেনি অনশন ভঙ্গ করার। বারে বারে তাঁর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু যতীন তো জানেন এই পুলিশদের। কাজেই অনশন থেকে পিছু হটলেন না। শরীর ক্রমশ দুর্বল হতে লাগল। একসময় গলা দিয়ে আওয়াজ বের করারও শক্তি ছিল না। কিন্তু ভেতরে যে ‘দধীচির আত্মা’! অনশনের খবর গোটা দেশে ছড়িয়ে গেল। পৌঁছে গেল বাংলাতেও। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে একসময়ের সঙ্গী এই তরুণটির প্রতি মুগ্ধ হয়ে গেলেন সুভাষচন্দ্র বসু। যতীন দাসের সেই তেজ ছড়িয়ে গেল প্রতিটা গ্রামে, শহরে। টানা ৬৩ দিনের যুদ্ধের পর শেষ হল প্রাণ। ১৯২৯ সালেরই ১৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন চিরযোদ্ধা যতীন্দ্রনাথ দাস… 

তাঁর মৃত্যু অনেকের মনে ছাপ ফেলে দিয়েছিল লাহোর থেকে শেষকৃত্যের জন্য দেহ চলে এল কলকাতায়। ততক্ষণে লক্ষাধিক মানুষের সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়েছেন সুভাষচন্দ্র বসু। দায়িত্ব নিয়ে কাঁধে তুলে নিলেন যতীন দাসের মরদেহ, যাকে দধীচির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে সেই বিপুল জনতার মিছিল চলে গেল কেওড়াতলা মহাশ্মশানের দিকে। ‘ভারতবর্ষ’, ‘প্রবাসী’-সহ বাংলার বহু পত্রিকা ছেয়ে গিয়েছিল তাঁর খবরে। সেই সময় শান্তিনিকেতনে চলছিল একটি নাটকের মহড়া। সেইদিকেই মন দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যতীন দাসের মৃত্যুর খবর পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে যান তিনি। বন্ধ করে দেন মহড়া। তারপরই লিখলেন, ‘সর্ব খর্ব তারে দহে তব ক্রোধ’। কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন ‘যতীন দাস’ নামক একটি কবিতা। পরে ‘প্রলয়শিখা’ গ্রন্থে সেটি অন্তর্ভুক্ত করার পর ব্রিটিশ সরকার বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যতীন দাস তখন সাহসের নাম, বীরত্বের নাম, স্বাধীনতার ধ্বনির নাম। 

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথকে 'নিষিদ্ধ' বই উৎসর্গ বিপ্লবীর; কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল বিশ্বকবিকেও

Powered by Froala Editor