দীর্ঘ ৩০ বছর কেটেছে কারাগারে; বাংলার যে ‘মহারাজ’কে ভুলেছেন অনেকেই

‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়’। ব্রিটিশ শাসনের সময় প্রতিটা মুহূর্তে এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সেটা উপলব্ধি করে গেছেন। বাংলায় তখন দিকে দিকে আগুন জ্বলছে। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জেরে ব্রিটিশ পুলিশ ক্ষিপ্ত। নানা জায়গায় চলছে তল্লাশি অভিযান। তাঁদের রোখ যত বাড়ছে, ততই তরুণ রক্ত বাংলার বিপ্লবের আঙিনায় এসে দাঁড়াচ্ছে। এরকমই ছিলেন একজন। পদ্মাপারের ময়মনসিংহের সাধারণ এক পরিবারের ছেলে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নামার জন্য রক্ত যেন ফুটছে তাঁর। নজরেও পড়লেন একসময়। এবার তো বাড়ি থেকে পালাতে হবে! পান্তাভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। পেছনে পুলিশ। টানা ৮৫ মাইল হেঁটেছিলেন; এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নেননি। কেবল একবার তিন পয়সার ছোলা ভাজা কিনেছিলেন। ব্যস, আবার ছুট। এভাবেই তিন বছর পর বাড়ি ফিরেছিলেন ‘মহারাজ’ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। মাত্র দশদিন, তারপর আবার বাইরে। যেভাবেই হোক, দেশকে এই গোরা শাসকদের থেকে মুক্ত করতেই হবে… 

সহকর্মী, অনুজরা তাঁকে ডাকতেন ‘মহারাজ’ বলে। সত্যিই, মহারাজোচিতই তাঁর বিপ্লব-জীবন। ভারতের ইতিহাস ঘাঁটলে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবীদের নাম উঠে আসবে। তাঁদের অধিকাংশই বাংলার। কিন্তু এই তালিকার বাইরেও অনেকেই থেকে যান গোপনে। অনেকের অত্যাচারের খবর আমাদের কান অবধি পৌঁছয় না। ত্রৈলোক্যনাথ ছোটো থেকেই মন প্রাণ দিয়ে বিপ্লবের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাড়ির ভেতরেই দেখেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিবেশ। এমনকি স্কুলের শিক্ষকরাও ত্রৈলোক্যনাথকে সেই আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতেন। ধীরে ধীরে সেখান থেকে স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া। রক্তের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র। সামনে আসে অনুশীলন সমিতির নাম। সেই থেকেই শুরু বিপ্লবী কাজকর্মেরও। সঙ্গে পুলিশের খাতাতেও নাম ওঠা। 

প্রবেশিকা পরীক্ষা তাঁর আর দেওয়া হয়নি। তার আগেই ত্রৈলোক্যনাথ গ্রেফতার হন ১৯০৮ সালে। সেটাই ছিল প্রথমবার। দীর্ঘ জীবনে অসংখ্যবার কারাগারের ওপারে গিয়েছেন তিনি। সহ্য করেছেন পুলিশের অকথ্য অত্যাচারের। কিন্তু দিনের শেষে বিপ্লবীদের তালিকায় কখনই তাঁর নাম ওপরের দিকে আসেনি। সে নিয়ে তাঁর কোনো বক্তব্যও ছিল না। দীর্ঘদিন জেলে থাকার উদাহরণের কথা বললে আমরা নেলসন ম্যান্ডেলার কথা বলি। দীর্ঘ ২৭ বছর দক্ষিণ আফ্রিকার কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের ইতিহাসেই যে এরকম দৃষ্টান্ত রয়েছে, তার খোঁজ কি রাখি আমরা? ত্রৈলোক্যনাথের বয়ানেই, “মাঝখানে দু-একমাস বিরতি ছাড়া আমি টানা ৩০ বছর জেলখানায় কাটিয়েছি।” এমন কোনো শাস্তি ছিল না, যা তিনি ভোগ করেননি। কিন্তু যা-ই হয়ে যাক, তাঁর লক্ষ্য ছিল একটাই। দেশের স্বাধীনতা। ইংরেজদের পরাজয়। তার জন্য যত কষ্ট সহ্য করতে হয়, হোক… 

এই ৩০ বছরের শাস্তি জীবনেই একবার তাঁকে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়েছিল। সেই সময় সেলুলার জেল মানে মৃত্যুখানা। লোকমতে, যারা যায় খুব কম লোকই নাকি বেঁচে ফিরে আসে। কথাটা অনেকটা সত্যিও বটে। বন্দিদের ওপর অমানুষিক রকমের নির্যাতন চলে। প্রতিবাদ করলে উল্টে সেই মাত্রা আরও বেড়ে যায়। অনেকে আত্মহত্যা করতেন, অনেকে রোগে ভোগে মারাই যেতেন। ১৯২৪ সালে যখন সেখান থেকে মুক্তি পান ত্রৈলোক্যনাথ, সবার আগে চলে আসেন বাড়ি। অনেকদিন দেখা হয় না তো সবার সঙ্গে! বাড়ির সামনে মেজদাদাকে দেখে প্রণাম সেরে নেন। অদ্ভুত ব্যাপার, ভাইকে দেখে একবারও চিনতেও পারলেন না দাদা। না, এড়াতে চাননি। দীর্ঘদিনের অত্যাচারে তাঁর শরীরের অবস্থা এমন হয়েছিল যে তাঁকে চেনা সত্যিই মুশকিল হয়ে পড়েছিল। 

স্বাধীনতার পর ফিরে গিয়েছিলেন ওপার বাংলায়। সেখানেও জুটেছিল কারাবাস। পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করেছিল তাঁর বই। বৃদ্ধ মানুষ, এই ধকল আর নিতে পারেননি। মৃত্যুর আগে কলকাতায় চলে আসেন। ভারত সরকার তাঁর নামে একটি রাস্তাও করেন। কিন্তু তারপর? তাঁর মতো আরও কত জনের নাম পড়ে রয়েছে পিছনের পাতায়? অবশ্য ত্রৈলোক্যনাথের তাতে কিছুই যায় আসে না। তিনি এখন অন্য খানে, অন্য যুদ্ধে মগ্ন… 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ব্রিটিশ শাসনে প্রথম ফাঁসি, মহারাজা নন্দকুমারের হত্যাদৃশ্য দেখতে জনসমুদ্র কলকাতায়

More From Author See More