মায়ানমারের রোহিঙ্গা গ্রাম ‘হারিয়ে’ যাওয়ার পিছনে কোন অভিসন্ধি?

মানুষের স্মৃতি বোধহয় সত্যিই ক্ষণস্থায়ী। আজ তাই রোহিঙ্গাদের নিয়ে কথা বলতে গেলে হঠাৎ মনে হতে পারে, আবার পুরোন কাসুন্দি ঘাঁটা শুরু হয়েছে। আবারও সেই রিফিউজি ইস্যু, তার সঙ্গে এনআরসি-র ইস্যু জড়িয়ে যাওয়া। না, সবই আবছা মনে পড়ে এখনও। মাত্র ৩ বছর হল মায়ানমারের সেই ভয়ঙ্কর গণহত্যার। কিন্তু গৃহহীন রোহিঙ্গারা এখনও ঘরে ফেরার স্বপ্ন দেখেন। তাঁদের গ্রাম, তাঁদের বাড়ি – আর তার মধ্যে তাঁদের ছোট্ট পরিবার।

কিছুদিন আগেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি মেনে নিয়েছেন মায়ানমার সরকার। বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের মধ্যে এই বিষয়ে চুক্তিও সাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু সেই ফিরে আসা হবে নিয়ম মেনেই। এমনটাই বলা হয়েছে চুক্তিতে। আর তার ফলশ্রুতি? মায়ানমার সরকার তাঁদের ঘরে ফেরার বিষয়টি মেনে নিয়েছেন, এমনটাই জানতে পেরেছিলেন কিছু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু। তাই তাঁরা ঠিক করলেন আর এই অনিশ্চিত জীবনে নয়। এবার ফিরে যেতে হবে। কিন্তু সীমান্ত পেরোতেই ধরা পড়লেন রক্ষীদের হাতে। এখন তাঁদের বাসস্থান জেলখানা। কারণ ওই যে, নিয়ম মেনে ফিরিতে হবে।

কিন্তু কোথায় ফিরবেন? সেই গ্রাম, সেই বাড়ি – আর কী খুঁজে পাওয়া যাবে সেসব? বাড়ি তো ছাই হয়ে গিয়েছে আগেই। তার মধ্যে গ্রামের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাবে না হয়তো আর। কারণ সম্প্রতি মায়ানমারে কর্মরত একটি মার্কিন সংস্থার কর্মীরা একটি বিষয় নজরে এনেছেন। দেখা যাচ্ছে মায়ানমার সরকারের দেওয়া তথ্যতে রোহিঙ্গাদের পুরনো কোনো গ্রামের কোনো নাম নেই। সেই সমস্ত নাম বদলে ফেলা হয়েছে। কোথাও আশেপাশের শহরের নামে নামকরণ হয়েছে গ্রামের। কোথাও নাম একেবারে অন্য। এভাবেই মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেল ৪০০টি গ্রাম। এই নতুন তথ্য দিয়েই জাতিপুঞ্জের মানচিত্র তৈরি হবে।

২০১৭ সালে মায়নমারে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল, তার নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা বরং প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছে সরকার। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা এখনও চান না যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমরা সেখানে ফিরে আসুক। মানবাধিকার কর্মীদের চাপের মুখে সরকারকে হয়তো ফিরে আসার বিষয়টা মেনে নিতে হচ্ছে, কিন্তু সেখানেও কী কোনো সদিচ্ছা আছে আদৌ। এইসব প্রশ্নই ঘুরেফির আসছে বর্তমান প্রেক্ষিতে। বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা তাই আক্ষেপের সঙ্গে জানাচ্ছেন, আর হয়তো ঘরে ফেরা হল না।

মানচিত্র পরিবর্তনের বিষয়ে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সরব জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার কর্মীরা। মার্কিন সরকারও এখানে বেশ এক হাত সমালোচনার সুযোগ ছেড়ে দেননি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, জাতিপুঞ্জের যে পর্যবেক্ষক মায়ানমারে উপস্থিত তাঁর এখানে কি কোনো বক্তব্যই ছিল না? পরিদর্শক দলের প্রধান ওলা আমগ্রেন জানিয়েছেন, তিনি এই বিষয়ে কিছু না বললেও রোহিঙ্গাদের ফিরে আসার বিষয়ে যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেটা দেখতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ঠিক যেন গাছ কেটে ফেলার বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই, কিন্তু ফলের জোগান ঠিক থাকতে হবে। আবার যে মার্কিন সরকার এই ব্যাপারে মায়ানমারের সমালোচনা করছেন তাঁরাও কিন্তু নিজেদের সমস্ত সরকারি তথ্য আপডেট করে চলেছে। তাহলে এই পরিস্থিতিতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন সহায়-সম্বলহীন রোহিঙ্গারা? সারা পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতাবান মানুষই কি একযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেননি? ইতিহাস এই অধ্যায়ের যবনিকা কোথায় টানে, সেটাই শুধু দেখার বিষয়।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন
শেষ ৫০ বছরে পৃথিবী থেকে মুছে গেছে ৬৮ শতাংশ বন্যপ্রাণ, জানাল সমীক্ষা

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More