হারিয়েছে বাস্তব অস্তিত্ব, একমাত্র ছবিতেই আজও জীবন্ত বাংলার ‘বড়ো দুখের রেল’

সরু রেললাইনের পাশ দিয়ে চলে গেছে মেঠো পথ। সেই রাস্তা ধরেই দ্রুত পায়ে হাঁটছেন এক ভদ্রমহিলা। একটা ট্রেন ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে চলে গেল তাঁকে। ট্রেন থেকে ভেসে এল চিৎকার, “ঠাকুমা, কোন ট্রেন ধরবেন আজ?” প্রত্যুত্তরে ভদ্রমহিলা বুঝিয়ে দিলেন, আজ তাড়াতাড়িই গন্তব্যে পৌঁছতে হবে তাঁকে।

আশির দশকে বাঁকুড়া-রায়নার অধিকাংশ যাত্রীরাই পরিচিত ছিলেন এমন ঘটনার সঙ্গে। কারণ ছিল দু’টি পৃথক রেল লাইনের সহাবস্থান। ব্রডগেজ লাইন এবং ন্যারোগেজ লাইন। একদিকে যেমন তখন সেখানে চালু হয়ে গেছে ইলেকট্রিক লোকাল ট্রেন। পাশাপাশিই চলত বাষ্পচালিত শকটও। এই ন্যারোগেজ লাইন পরিচিত ছিল বাঁকুড়া-দামোদর উপত্যকা রেলওয়ে বা বিডিআর হিসাবে। তবে যাত্রীরা এই ‘বিডিআর’-এর নামকরণ করে নিয়েছিলেন ‘বড় দুখের রেল’। 

নামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এর কারণ। অত্যন্ত ধীর গতি। ভাড়াও ছিল বেশ কম। তাই হাতে সময় থাকলে পকেট বাঁচানোর জন্যই এই ট্রেনলাইনকে বেছে নিতেন মানুষ। কৃষি-পণ্য পরিবহণে বিশেষ ভূমিকা নিত এই ট্রেনগুলিই। গ্রামীণ অঞ্চলগুলির মধ্যেও যোগাযোগ স্থাপনের একমাত্র রাস্তাই ছিল এই ট্রেন। তবে আশির দশকের শেষ থেকেই নগরায়নের হাওয়া খেলে গেছিল দেশজুড়ে। আসতে শুরু করেছিল ইলেকট্রিক লাইন আর হাইওয়ে। ধীরে ধীরে উন্নয়নের এই গতির কাছে হারতে থাকে ন্যারোগেজ। নব্বই দশকের মাঝামাঝি ১৯৯৫ সালে হারিয়ে যায় বাঁকুড়ার এই ন্যারোগেজ লাইন।

তবে শুধু বাঁকুড়া নয়, হাওড়া, চণ্ডীতলা, শিয়াখালা, কালীঘাট, ফলতা, শখেরবাজার, ফলতা, কাটোয়া-সহ বাংলার বহু অঞ্চলেই একসময় রাজত্ব ছিল ছোট্ট এই রেলের। বাঁকুড়া-সহ বাকি সমস্ত লাইনগুলিই হারিয়ে গিয়েছিল বাংলার বুক থেকে। তবে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই একপ্রকার ধুঁকতে ধুঁকতে টিকে ছিল কাটোয়া লাইন।

 

আরও পড়ুন
গম্ভীর মুখ থেকে সবাইকে হাসিয়েছিল ক্যামেরা, সেখান থেকেই শুরু ‘সে চিজ’-এর যাত্রা

কাটোয়া থেকে বালগোনা হয়ে বর্ধমান অবধি ৫৬ কিলোমিটার পথ সেই ট্রেন চলত কিছুদিন আগে অবধিও। এই ছোট্ট পথ অতিক্রম করতেই সময় লেগে যেত ৪ ঘণ্টা। ট্রেনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৫ কিমি। ২০১৪ সালে বর্ধমান থেকে বালগোনা অবধি পথে ব্রডগেজ লাইন বসে যায়। বাকি বালগোনা থেকে কাটোয়া অবধি ২৮ কিলোমিটার পথও ইলেকট্রিক লাইনে উন্নত হয় ২০১৬-১৭ সাল নাগাদ। ইতিহাস হয়ে যায় শতাব্দীপ্রাচীন একটি ঐতিহ্য।

তবে এই ইতিহাসের তলায় শায়িত রয়েছে আরও এক বৃহত্তর ইতিহাস। যার বয়স দেড়শো বছরেরও বেশি। ১৮৩১ সাল। রাজা রামমোহন রায় প্রথমবারের জন্য রেলগাড়িতে চাপলেন ম্যাঞ্চেস্টার যাওয়ার পথে। সেই ঘটনা নিয়েই রীতিমত হইহই পড়ে গেল এদেশের সংবাদ-মাধ্যমেও। তার সমান্তরালেই তখন ভারতেও কথা-বার্তা চলছে রেললাইন পাতার বিষয়ে। ১৮৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার পাকাপাকিভাবে শিলমোহর চাপাল সেই পরিকল্পনায়। তবে সাধারণের জন্য সেই রেলপথ নয়।

আরও পড়ুন
ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি – হুজুগ, নিষ্ঠা ও কিছু বিপন্ন বন্যপ্রাণের গপ্পো

প্রথম উদ্যোগ নিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। ১৮৪৩ সালে তিনি ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির রেলকে চিঠি লিখে প্রস্তাব দিলে সাধারণের যাতায়াতের জন্য রেলপথ তৈরির। তাতে তিনি মোট খরচের এক-তৃতীয়াংশ অর্থও দেবেন বলে জানালেন। কিন্তু শেষ অবধি আর তার বাস্তবায়ন হয়নি। তার ঠিক পরের বছরই রেলপথের বেসরকারিকরণ করল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। 

আরও পড়ুন
প্রথম বাঙালি হিসেবে রেলগাড়িতে চড়লেন রামমোহন রায়, খবর বেরোল সংবাদপত্রেও

ব্যবসায়িক লাভের কথা ভেবেই ভারতে রেলপথ তৈরিতে আগ্রহ দেখাল ব্রিটিশ কোম্পানি মার্টিন-বার্ন রেল। পাতা হল মাত্র দু’ফুট চওড়া রেল লাইন। আর তার ওপর দিয়েই ছুটল বাষ্পচালিত রেল শকট। মাত্র তিনটি কামরা। প্রতি কামরায় দু’দিকে মুখোমুখি লম্বা বসার সিট। মার্টিন কোম্পানি যখন একটু একটু করে ব্যবসা বড় করছে। তখন এই দেশে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবেই ১৯১৪ সাল নাগাদ ব্যবসা শুরু করে আরও এক ব্রিটিশ রেল কোম্পানি ম্যাকলিওড এন্ড কো। 

দেশ স্বাধীনের পর বাঁকুড়া কিংবা বর্ধমান-কাটোয়ায় এই ম্যাকলিওডের রেলই চলত। তিনটি কামরার বদলে পাঁচ কামরার ট্রেনের প্রচলন করেছিল তারাই। শুরুরদিকে এই ট্রেনে রাতের বেলায় কামরায় ব্যবহৃত হত কেরোসিনের আলো। সেই আলোরও বদল করেছিল ম্যাকলিওড কোম্পানি। তবে এই বিবর্তনেও লাভ হয়নি খুব একটা। শেষমেশ গুটিয়ে নিতে হয়েছিল নিজেদের অস্তিত্ব।

তবে এই ন্যারোগেজ রেল বন্ধ হয়ে গেলেও একমাত্র উত্তরবঙ্গে আজও স্বমহিমায় চলছে এই রেলগাড়ি। তবে তাকে আমরা চিনি টয়ট্রেন হিসাবেই। দার্জিলিংয়ের ‘হিমালয়ান রেলওয়ে’ শুধু বাংলার নয় সারা ভারতের শেষ ন্যারোগেজ রেলপথ। এই রেললাইন আজও চলছে শুধুমাত্র পর্যটকদের ওপর ভরসা করেই। পাশাপাশি ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের তালিকায় এর নাম থাকায় মুছে যায়নি দেশের বুক থেকে। উন্নত প্রযুক্তি এবং সময়রক্ষার তাগিদে যে রেলকে ছেড়ে এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে মানবসভ্যতা। দার্জিলিংয়ে গেলে আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও টের পাওয়া যায় তার মাহাত্ম, রাজকীয়তা। ঘিরে আসে হারিয়ে যাওয়া এক অন্য নস্টালজিয়া...

Powered by Froala Editor