প্রথম বাঙালি হিসেবে রেলগাড়িতে চড়লেন রামমোহন রায়, খবর বেরোল সংবাদপত্রেও

তাঁর কোনো রাজত্ব ছিল না, কিন্তু নামের আগে বসেছিল 'রাজা' উপাধি। এদেশে বোধহয় তিনিই একমাত্র রাজত্বহীন রাজা। এমনকি মুকুটহীন সম্রাট বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাঙালিকে আধুনিক মননে চিন্তা করতে শিখিয়েছিলেন তিনিই। তাই তো রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এদেশের 'প্রথম আধুনিক মানুষ' বলেছিলেন। এতক্ষণে নিশ্চই বুঝে গিয়েছেন কার কথা হচ্ছে। তিনি রামমোহন রায়। থুড়ি, রাজা রামমোহন রায়। মৃত্যুর কয়েক বছর আগেই তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল এই রাজা উপাধি। সৌজন্যে স্বয়ং মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ।

সময়টা ১৮৩১ সাল। এদেশে মোটামুটি একটা নবজাগরণ ঘটিয়ে দিয়ে রামমোহন মনস্থির করলেন এবার বিলেতে যাবেন। নিছক ঘুরতে তিনি যাচ্ছেন না। কোনো এক অভিসন্ধি নিয়েই বিলেতের মাটিতে পা রাখার কথা ভেবেছিলেন তিনি। অনেকে মনে করেন, তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি বিলেত গিয়েছিলেন। তবে এই ধারণা সম্ভবত ঠিক নয়। কারণ ১৭৭৫ সালে মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন নামে এক ব্রিটিশ কর্মচারীর লেখা আত্মকথা থেকে জানা যায়, বছর দশেক আগে তিনি দোভাষীর কাজে বিলেত গিয়েছিলেন। অর্থাৎ রামমোহনের তখনও জন্মই হয়নি। পরবর্তীতে আরও কয়েকজন ব্রিটিশ কর্মচারীর বিলেত যাওয়ার কথা জানা যায়। কিন্তু রামমোহন তো কর্মসূত্রে বিলেত যাচ্ছেন না। তিনি স্বেচ্ছায়, নিজের পরিকল্পনা নিয়ে যাচ্ছেন। অতএব সেদেশে একটু সম্মান না পেলে তো সমস্যার। এদিকে তিনি শুনেছেন বিলেতের মানুষ ভারতের রাজা-বাদশাহ ছাড়া আর কাউকেই সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত নন। অতএব একটি ফন্দি বের করলেন তিনি। গোপনে সম্রাটকে জানালেন তাঁর অভিসন্ধির কথা। আর সম্রাট তৎক্ষণাৎ তাঁকে 'রাজা' উপাধিতে সম্মানিত করে সমস্ত খরচের দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে বিলেত পাঠাতে উদ্যোগী হলেন।

বছর দুয়েক পর ১৮৩৩ সালে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে মারা গেলেন রামমোহন। না, ততদিনে তো তিনি রাজা রামমোহন। যাই হোক, কী উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি বিলেত গিয়েছিলেন বা আদৌ তাঁর সেই উদ্দেশ্য সফল হল কিনা, সেসব কিছুই আর জানা যায়নি। কিন্তু বিলেতের প্রতি যে বাঙালির এক অমোঘ টান ছিল। আর একজন বাঙালি বিলেতে গিয়ে কী করছেন, কী কী দেখছেন; সেসব জানতেও উদগ্রীব ছিলেন তাঁরা। সেকালের সংবাদপত্রে এরকম কিছু বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছিল। 

তেমনই একটি সংবাদ থেকে জানা যায় তাঁর রেলগাড়ি ভ্রমণের কথা। সংবাদটি প্রকাশিত হয় ১৮৩১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তিনি তখন ইংল্যান্ডের লিভারপুলে অবস্থান করছেন। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরেই তিনি প্রথম রেললাইন দেখলেন। লোহার পাত কেটে বানানো রাস্তার উপর দিয়ে বাষ্পচালিত গাড়ি ছুটে যাচ্ছে; এই দৃশ্য দেখে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। বাঙালিদের মধ্যে তিনিই প্রথম রেলগাড়ি চড়েছেন। এমনকি সেই গাড়ি যখন ঘণ্টায় পনেরো ক্রোশ বেগে চলতে শুরু করে, তখন যে 'রাজা' অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেকথাও সংবাদে উল্লেখ করা হয়।

রামমোহন যখন রেলগাড়িতে ভ্রমণ করছেন, এদেশে তখন রেললাইন পাতার উদ্যোগ শুরু হয়ে গিয়েছে। বছর কুড়ি পর, ১৮৫৩ সালে প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন চালু হবে ভারতবর্ষে। এদেশের আধুনিকতায় সে এক মাইলস্টোন বৈকি। আর এই আধুনিকতার আস্বাদও প্রথম পেয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়। রবীন্দ্রনাথের প্রশস্তি তাই এদিক থেকেও একপ্রকার সার্থক বটে।

তথ্যসূত্র: বাংলার রেনেসাঁস, অন্নদাশঙ্কর রায়
কলের শহর কলকাতা, সিদ্ধার্থ ঘোষ

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবসা শুরু, ৭৮ বছর ধরে বাঙালির ভরসা কে. সি. পালের ছাতা

Powered by Froala Editor

More From Author See More