তর্কযুদ্ধে নেমেছিলেন খোদ টলস্টয়ের বিপক্ষে, বিস্মৃতির অতলে বিপ্লবী তারকনাথ দাস

বিংশ শতকের গোড়ার কথা। ভারতের বুকে ব্রিটিশরা নিজেদের ছড়ি ঘোরাচ্ছে। দেশের মানুষদের ওপর অত্যাচার নেমে আসছে। আর সেই সময়ই লর্ড কার্জনের হস্তক্ষেপে ঘটে যায় বঙ্গভঙ্গ। এই একটি ঘটনা আরও বহু জিনিসকে সামনে নিয়ে আসে। বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতে শুরু হয় বিপ্লবী কার্যকলাপ। স্বাধীনতা আন্দোলনের পন্থা, আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে নেতাদের মধ্যে। আর ভারত থেকে বহু দূরে বসে, এই পুরো ছবিটাই দেখতে লাগলেন কিংবদন্তি রুশ সাহিত্যিক লিও টলস্টয়…

ভারতের এই পুরো ছবিটা নিয়েই একটি বিস্তারিত প্রবন্ধ লেখেন টলস্টয়। নাম দেন ‘আ মেসেজ টু ইয়ং ইন্ডিয়া’। তাঁর মতে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য নরমপন্থী আন্দোলনের রাস্তাই সঠিক পথ। এবং তা নিয়ে নিজের বিস্তারিত যুক্তিও দিয়েছিলেন। লিও টলস্টয় বলেছেন বলে কথা, তাঁকে তো মান্যতা দিতেই হবে! কিন্তু এতসবের পরেও একজন ভারতীয় তাঁর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেন। টলস্টয় ঠিক কথা বলছেন না। তাঁর প্রবন্ধের বিপক্ষে নেমে, সমস্ত জ্ঞান, ইতিহাস, যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে পাল্টা প্রবন্ধ লিখলেন তিনি, তারকনাথ দাস। কাঁচড়াপাড়ার তারকনাথ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম।

ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে যদি একটু দেখা যায়, তাহলে তারকনাথ দাস সম্পর্কে কিছু তথ্য পাবেন আপনি। সিপাহী বিদ্রোহের প্রায় তিরিশ বছর পেরিয়ে গেছে। সেই সময়ই কাঁচড়াপাড়ার এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন তারকনাথ। পরিবারে সচ্ছলতা নেই, সেরকম অর্থ নেই; কিন্তু আছে মেধা। ছোটো থেকেই পড়াশোনায় অসম্ভব মনোযোগী ছিলেন তিনি; সেইসঙ্গে দোসর ছিল কলম। রচনা, প্রবন্ধ যাই হোক না কেন, সমস্ত বিষয় তারকনাথের কলম চলত তরতরিয়ে। কি ঝকঝকে ভাষা তাঁর!

এরকমই একদিন স্কুলে একটি রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। বিষয় ছিল ‘দেশাত্মবোধ’। সেখানেই অংশ নিয়ে বিস্তারিত একটি লেখা প্রকাশ করলেন তারকনাথ দাস। মাত্র ১৬ বছর বয়সের এক কিশোরের এমন লেখা দেখে চমকে গিয়েছিলেন সেদিনের অতিথি ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র। বুঝলেন এই ছেলের ভেতরে আগুন আছে। ওকালতি ছাড়াও প্রমথ মিত্রের আরও একটি পরিচয় ছিল। তিনি হলেন ইতিহাসপ্রসিদ্ধ বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা। প্রমথবাবু এবং তাঁর সহযোগী সতীশচন্দ্র বসু ঠিক করলেন, যে করেই হোক এই ছেলেকে সমিতির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এদিকে তারকনাথের মনেও ততদিনে দেশাত্মবোধ, স্বাধীনতার চেতনা দানা বেঁধেছে ভালোই। শুরু হল আরও এক বিপ্লবীর পথ চলা।

১৯০১ সাল। কাঁচড়াপাড়ার গ্রাম থেকে তারকনাথ চলে এলেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। এমন সময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তখনও ইনি ‘বাঘা যতীন’ নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হননি। পূর্ব বাংলার যশোরে সীতারাম মেলায় তাঁরা একটি গোপন মিটিং আয়োজন করলেন। তারকনাথ, বাঘা যতীন ছাড়াও সেখানে ছিলেন শ্রীশচন্দ্র সেন, অধরচন্দ্র লস্করের মতো বিপ্লবীরা। সবাই মিলে বিপ্লবের মন্ত্রে শপথ নিলেন এবং ঠিক করলেন, উচ্চশিক্ষা করার জন্য কয়েকজন বিদেশে যাবেন। উদ্দেশ্য কেবল উচ্চশিক্ষার নয়; গোপনে সামরিক শিক্ষাও। সেইসঙ্গে বাইরে থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পরিচালনা করা।

ততদিনে পুলিশের নজরেও চলে এসেছেন তারকনাথ দাস। ধরা পড়ার আগে যে করেই হোক বাইরে পালাতে হবে। ১৯০৫ সাল। ছদ্মবেশ ধরলেন তিনি; নাম নিলেন ‘তারক ব্রহ্মচারী’। তারপর সোজা চলে গেলেন মাদ্রাজ। সেখান থেকে জাপান, এবং দুই বছর পর সোজা আমেরিকার সিটল। পড়াশোনায় ভালো, দুর্দান্ত মেধা— কাজ পেতে এবং আবারও পড়াশোনা শুরু করতে অসুবিধা হল না। কানাডার ভ্যাঙ্কুবারে ইমিগ্রেশন বিভাগে অনুবাদকের কাজ পেলেন তারকনাথ। একইসঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় পড়াশোনা। পরবর্তীতে আমেরিকাতেই স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডিও করেন।

আরও পড়ুন
বায়ু থেকেই সংগ্রহ করা যাবে পানীয় জল, যুগান্তকারী আবিষ্কার বাঙালি গবেষকদের

এসব তো আছেই। ভেতরে ভেতরে তাঁর অন্য কাজও চলছিল। ১৯০৮ সালে শুরু করলেন ‘ফ্রি হিন্দুস্তান’ নামের একটি পত্রিকা। ইতিহাস বলে, এটিই কানাডার প্রথম দক্ষিণ এশীয় পত্রিকা ছিল। শুধু পত্রিকা নয়, নিজের একটি স্কুলও চালু করেন তারকনাথ। উদ্দেশ্য, কানাডা ও আমেরিকায় থাকা ভারতীয় ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখানো। সেইসঙ্গে স্বাধীনতার মন্ত্রও ছড়িয়ে দিতে শুরু করলেন। নিজের বাগ্মিতা, লেখার মাধ্যমেই একটু একটু করে বার্তা ছড়িয়ে দিতে শুরু করলেন তিনি। দেশে না থেকেও, বাইরে থেকে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন তারকনাথ। ঠিক করলেন, নরউইচ মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ নেবেন। নিজেকেও তৈরি করবেন, সঙ্গে বোমা বাঁধার কৌশল, বন্দুক চালনা-সহ অন্যান্য বিষয়ও দক্ষ হবেন। তেমনটাই কথা দিয়েছিলেন বাঘা যতীনকে…

কিন্তু সেটা হল না। ততদিনে তারকনাথের ব্রিটিশ-বিরোধী কার্যকলাপ প্রকাশ্যে এসে গেছে। না, কিছুতেই তোমাকে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া যাবে না। বিফল হলেও হাল ছাড়েননি তিনি। ততদিনে পরিচয় হয়েছে লালা হরদয়ালের সঙ্গে। বিষ্ণু গণেশ পিংলে, হরদয়াল, বরকাতুল্লাহ প্রমুখ বিপ্লবীর সঙ্গে মিলিত হলেন তারকনাথ। তৈরি হল ‘গদর পার্টি’। এই পার্টির সঙ্গে আমেরিকায় বসে বিভিন্ন আন্দোলনের পরিকল্পনা করতে লাগলেন তাঁরা। সেইসময়ই ভারতের বিপ্লবী দলের সঙ্গে এক হয়ে একটি ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করা হয়। যোগ দেয় জার্মানির স্বাধীন ভারত কমিটিও। কেবল ভারতেই নয়; কাবুল, সিঙ্গাপুর, সুয়েজ, জার্মানি সমস্ত জায়গায় একযোগে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। যার পুরোভাগে যুক্ত ছিলেন তারকনাথ দাস। অবশ্য সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি। যার জন্য ১৯১৭ সালে দু’বছরের জন্য গ্রেফতারও হন তারকনাথ…

আমেরিকায় থেকে সেখানকার ভারতীয়দের উন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তাঁর বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নেন। সেইসঙ্গে লিও টলস্টয়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বিতর্ক, প্রবন্ধ-পাল্টা প্রবন্ধ গোটা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই লেখাগুলি থেকেও ভারতের পরাধীনতা, আন্দোলন ও ব্রিটিশ অত্যাচার সম্পর্কে জানতে পারে বিশ্ববাসী। ভারতের বাইরে যে কজন ব্যক্তিত্ব স্বাধীনতার বার্তা নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে নাম আসবে এই মানুষটির। অথচ, আজ তারকনাথ দাস প্রায়-বিস্মৃতদের একজন। এখনও আমেরিকায় ভারতীয় ছাত্রদের জন্য এগিয়ে আসে তাঁরই নামাঙ্কিত ফাউন্ডেশন। আর তিনি, অবহেলিত…

আরও পড়ুন
বাংলায় নামকরণ ডাইনোসরের, আবিষ্কারের সঙ্গেও জড়িয়ে দুই বাঙালি

তথ্যসূত্র-
১. ‘A revolutionary from across the seas’, Sachidananda Mohanty, The Hindu

Powered by Froala Editor

More From Author See More