মহারাষ্ট্রের বস্তিতে বিনামূল্যে ক্লাস, নেপথ্যে জম্মুর কাঞ্চন

বস্তির মধ্যে ছোট্ট টিনের শেড দেওয়া অস্থায়ী একটি ক্লাবঘর। সেটাই সময় মতো বদলে যায় ক্লাসরুমে। প্রতিদিন সেখানে হাজির হয় গোটা শতেক ছেলে-মেয়ে। কেউ অষ্টম শ্রেণির আবার কেউ দশম শ্রেণির। কেউ কেউ আবার পড়াশোনার পাঠ চুকিয়েছে বছর কয়েক আগেই। তবে এই ক্লাসের দরজা খোলা থাকে সকলের জন্যই।

মহারাষ্ট্রের নাগপুর জেলার পিপড়ির বস্তিতে গেলেই দেখা মিলবে এই অভিনব স্কুলের। যা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘সংঘর্ষ বিদ্যাকেন্দ্র’ (Sangharsh Vidya Kendra) নামে। আর এই স্কুলের নেপথ্যে রয়েছেন, জম্মুর ৬১ বছর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক কাঞ্চন শর্মা (Kanchan Sharma)। বিগত ১১ বছর ধরে বস্তির দুঃস্থ এবং পিছিয়ে পড়া শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা দিয়ে চলেছেন তিনি। 

কাঞ্চন বর্তমানে মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা হলেও, তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা জম্মুর ত্রিকুটা নগরে। কর্মসূত্রে চলে এসেছিলেন দিল্লিতে। তারপর সেখান থেকে মহারাষ্ট্রের বদলি। টানা ৩৯ বছর কাজ করেছেন স্কুল এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক হিসাবে। ২০০৯ সালের কথা। মহারাষ্ট্রে চাকরি করার সময়ই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল মহারাষ্ট্রের বস্তির বিভীষিকাময় ছবি। গোটা অঞ্চলটা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকায় পড়াশোনা করা সেখানকার শিশুদের কাছে বাতুলতাই বটে। ফলে স্বল্প বয়স থেকেই তারা শিকার হয় শিশুশ্রমের। পাশাপাশি কিশোর বয়স থেকেই একটু একটু করে দানা বাঁধতে থাকে নেশা এবং অপরাধ করার প্রবণতাও। 

বস্তির শিশুদের স্কুলমুখো করে তুলতে সেসময় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন কাঞ্চন। বস্তিতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়েছিলেন স্কুলে। তাতে লাভও হয়েছিল প্রাথমিকভাবে। তবে পিপড়ি থেকে মহারাষ্ট্রের অন্য আরেকটি জেলায় তাঁর বদলি হয়ে যাওয়ার পর, গোটা ছবিটা ফিরে যায় আবার পূর্ববর্তী অবস্থায়। 

সংঘর্ষ বিদ্যাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনা আসে সেখান থেকেই। তবে খুব একটা সহজ ছিল না এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। তিনি যে সরকারি প্রভাষক। ফলে, বেসরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা কার্যত আইনি অপরাধ। স্কুল এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলে প্রশাসনিক স্তর থেকে বিশেষ অনুমতি পাশ করান কাঞ্চন। তারপর বস্তির সাধারণ মানুষদের সঙ্গে আলোচনা করেই শুরু করেন অস্থায়ী এই বিদ্যালয়। 

বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বস্তির শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিদ্যার আলো ছড়াচ্ছেন তিনি। একটা সময় চাকরি সামলেও, প্রতিদিন হাজির হতেন এই স্কুলে। অবসরগ্রহণের পর বর্তমানে পুরো সময়টাই পিপড়ির দুঃস্থ শিশুদের জন্য খরচ করেন কাঞ্চন। বিনামূল্যে শিক্ষা পরিষেবা পৌঁছে দেন তাদের কাছে। তবে আজ আর একা নন। মাইনে দিয়েই রেখেছেন বেশ কয়েকজন সহ-শিক্ষক। নিজেই পাশাপাশি নিজের সঞ্চয় থেকেই শিশুদের ইউনিফর্ম এবং বই-খাতার খরচ জোগান ষাটোর্ধ্ব শিক্ষিকা। 

বর্তমানে তাঁর স্কুলের ছাত্রসংখ্যা একশোজনেরও বেশি। বদলেছে বস্তির স্বাভাবিক জীবন-যাপনও। এক কথায়, তাঁর এই উদ্যোগই যেন পাল্টে দিয়েছে সমাজের প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিটাও। সেই কারণেই হয়তো স্থানীয়দের কাছে শিক্ষক নন কাঞ্চন। হয়ে উঠেছেন ‘সুপার টিচার’…

Powered by Froala Editor

More From Author See More