মার্ক্সের 'ডাস ক্যাপিটাল' নিয়ে নাট্য ও গীতিনাট্য

কার্ল মার্ক্স বললেই যে বইয়ের নামটা আমাদের মনের মধ্যে আসে, তা হল 'ডাস ক্যাপিটাল'। যার শুধুমাত্র প্রথম খণ্ডটি মার্ক্স সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন। বাকি দু-খণ্ডের জন্য ছিল মার্ক্সের (Karl Marx) লেখা নোটবুক— শেষ করেছিলেন তাঁর বন্ধু ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস এবং কার্ল কাউটস্কি। এই জটিল বই পড়তে গেলে কী পরিমাণ শ্রম ও জ্ঞানের প্রয়োজন, সে-কথা বলাই বাহুল্য। তাই সাধারণ স্তরে এই বইয়ের পাঠ একদমই নেই বললেই চলে। অর্থনীতির এমনই এক জটিল বিষয়কে নিয়ে নাটক হলে কেমন হয়? কী, অবাক হচ্ছেন? 'ডাস ক্যাপিটাল' (Das Capital) নিয়ে থিয়েটার (Theatre)! হ্যাঁ, এমনই একটি প্রযোজনা করেছে জার্মান থিয়েটার গ্রুপ 'রিমিনি প্রোটোকল'।

নাটকটা প্রস্তুত করার জন্য রিমিনি নাট্যগোষ্ঠীর হয়ে হিল্ডেগার্ড হগ ও ড্যানিয়েল ওয়েটজেল ১০০ জন মানুষের মতামত কিংবা ইন্টারভিউ নিয়েছেন। সেখান থেকে তুলে এনেছেন মোট আটটি কাহিনি। নাটকের দৃশ্যগুলিকে 'দৈনন্দিনের অংশ' হিসেবে তুলে আনা হয়েছে। 

থমাস কুজিনস্কি পূর্বতম পূর্ব জার্মানির অর্থনৈতিক ইতিহাসের অধ্যাপক, যিনি বুঝিয়েছেন কীভাবে সময় রূপ নেয় অর্থের। তাঁর একটি নাটকে ডাস ক্যাপিটাল নিয়ে আসতে গেলে ১৫০০ কর্ম সময় কিংবা ওয়াগনারের সুরের ৯০টি 'বৃত্ত চক্র'-এর প্রয়োজন। ক্রিশচান স্প্রেমবার্গ, যিনি দৃষ্টিহীন, হাওয়াই যন্ত্রের সাহায্য ২০,০০০ নোট তৈরি করেছেন, যা থেকে উঠে আসবে অর্থ/টাকার এক নিজস্ব 'শব্দ' । 

নাটকটি একটি লাউঞ্জ রুমের মধ্যে দেখানো হয়, যেখানে সারা ঘর ভরে আছে জুয়ার মেশিন, টেলিভিশন এবং অগুন্তি 'ডাস ক্যাপিটাল' গ্রন্থ। দর্শকদের হাতে পরে বইগুলি তুলে দেওয়া হয়। ইন্টিমেট থিয়েটারটি বর্তমানে প্রদর্শিত হচ্ছে জার্মানির ডাসেলডরফার স্কসফেলহউসে। নাটকটির মূল লক্ষ্য বিভিন্ন বাস্তব জীবনের জটিল সমস্যাকে সামনে রেখে শ্রম, অর্থ, শোষণ ও বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে দর্শকাভিনেতাদের (Spectactor) মধ্যে তর্ক ও সংলাপ বিনিময়। 

আরও পড়ুন
জার্মানির রাস্তায় পথ দেখাচ্ছেন কার্ল মার্ক্স, সঙ্গী এলভিস প্রেসলি!

এবার চলে যাব জুরিখে, ভেরিন ফ্রিইয়েস মিউজিক থিয়েটারে। এখানে প্রদর্শিত হবে 'কার্ল মার্ক্সের ক্যাপিটাল : দ্য মিউজিকাল'। ক্যাপিটালের গীতিনাট্য, ভাবতেই কেমন শিহরণ হয়! নাটকটি প্রযোজনা করেন আর্নল্ড, কোমারভ, শ্রোডার ত্রয়ী। একটা পুঁজিবাদী সমাজের দোলাচাল সঙ্গীতের তরঙ্গের মাধ্যমে তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে যে-কোনো জটিল বিষয়ও সহজবোধ্য হয়ে ওঠে বলে নাট্য নির্দেশক মনে করেন, আর মঞ্চসজ্জা, নৃত্য, অভিনয়, সঙ্গীত পরিবেশন শুধুমাত্র বিনোদনসর্বস্ব সমাজের অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে তাকেই ঘায়েল করার চেষ্টা। পুঁজিবাদী সমাজে একজন শিল্পী বা শিল্প(এখানে থিয়েটার) যে পণ্য, সে-কথা মার্ক্স তাঁর ‘ডাস ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে দেড়শো বছর আগে লিখে গেছেন। এই নাটককে নির্মাণের পিছনে কমোরভ ও আর্নল্ড প্রায় দু-হাজার পাতা থেকে খুঁড়তে খুঁড়তে বার করে এনেছেন ক্যাপিটালের 'লিবের্তো' বা মঞ্চের টেক্সট। গানগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নাম বলি— ছাব্বিশ অধ্যায়ের 'প্রাগৈতিহাসিক সমাজব্যবস্থায় সঞ্চয়' থেকে 'আহরণ ও বেগ', তারপর ধরুন বত্রিশ অধ্যায় থেকে 'একচেটিয়া পুঁজি' কিংবা এক নম্বর অধ্যায় 'বস্তু' থেকে 'বস্তুর মূল্যমান' ইত্যাদি। বর্তমানে মার্ক্স প্রাসঙ্গিক কি না, সাধারণত জন্মদিন এলে আলোচিত হয়। সারাবছর চুপ তারপর। কোনো বিষয়ই প্রাসঙ্গিক বলে কিছু হয় না— কিন্তু কত অভিনব পদ্ধতিতে ক্যাপিটাল-কে এই জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন থিয়েটারকর্মীরা। যেখানে জনগণের পক্ষে মার্ক্সের অর্থনৈতিক দর্শন বুঝতে ততটাও অসুবিধা হবে না— কারণ বিভেদ ও শোষণের সমাজে ক্যাপিটাল বোঝা একজন মানুষের নিজের জন্য প্রয়োজনীয়। প্রসঙ্গত, এমনভাবেই আরেক নাট্যকার বার্টল্ট ব্রেশট্ 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'কে কবিতার আকারে লিখেছিলেন জনগণের জন্য। চাইলে এই বই কিনে একবার পড়তে পারেন আপনিও...

আরও পড়ুন
মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সুভাষবাদ, জ্যোতিবাদ…

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ছিল ‘কার্ল মার্ক্স’, হয়ে গেল ‘জেনারেল শেরম্যান’, ২০০০ বছরের বুড়ো এক গাছের গপ্পো

Latest News See More