আজ বিদ্রোহের জন্মদিন

সাফদার হাশমি (Safdar Hashmi)— একটি বোধের অপর নাম, জেগে থাকার অর্থ। ভারতীয় রাজনৈতিক থিয়েটারের (Political Theatre) বিদ্রোহী নায়ক। রাস্তায় রাস্তায় লেখা আছে তাঁর জীবনযুদ্ধের কাহিনি। সংগ্রামী মানুষের নিঃশ্বাসে লুকিয়ে থাকে সাফদার-এর প্রাণবায়ু। ‘এই পথেই জীবন, এই পথেই মরণ আমাদের, সব কিছু পথের বুকেই...'

‘পৃথিবী পরিবর্তনের স্বপ্ন যাঁরা দেখেন, তাঁরা জনতার রাস্তায় নেমে আসেন, পথ হারানোর ভয় তাঁদের থাকে না। তাঁর পথের দিশা ছিল। কিন্তু সেই পথেই অমোঘ মৃত্যু এসে দেখা দিল তাঁর জীবনে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই। ‘গাঁও সে শহর তক’, ‘তিন ক্রোড়’, ‘অওরাত’— একের পর এক নাটক দেখাতে শুরু করল জনম নাট্যগোষ্ঠী। টিকিটের প্রশ্ন নেই সেখানে, আছে শুধু আদর্শের প্রতি বিশ্বাস, গণতন্ত্রের হালহকিকত তুলে ধরা। তাঁর লেখা নাটক 'হাল্লা বোল' আজ ছাত্র-যুবদের আন্দোলনের অন্যতম ট্যাগলাইন হয়ে উঠেছে। তরুণ বয়স থেকেই বাম ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সফদর তাঁর প্রতিভার পুরোটাই ঢেলে দিয়েছিলেন সাধারণ খেটে খাওয়ার মানুষের জন্য। 

বিশ্বজয়ী নাট্যনির্দেশক ও শিক্ষক পিটার ব্রুক তার ‘দ্য এম্পটি স্পেস’-এ বলেছেন—

"আমি যে-কোনো মুক্তাঞ্চলকে মুক্তমঞ্চ বলতে পারি। একজন সেখান দিয়ে পার করে গেলে অন্যজন কিন্তু তাকে দেখে, সেখান থেকেই কিন্তু থিয়েটারের প্রাথমিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে ওঠে।" 

আরও পড়ুন
নোবেল পুরস্কার পেয়েও ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল

কিন্তু জনগণের রাস্তা মুক্তমঞ্চ নয়। বরং এই সংঘবদ্ধতাই সাফদারের চেতনার চাবিকাঠি। আমি, আপনি, আপনারাই তাঁর নাটকের নায়ক। 

আরও পড়ুন
পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গে প্রয়োজন ক্লাসিক্যালের অনুশীলনও – ‘বিসর্জন’ নাটক থেকে বার্তা থেস্‌পিয়ান্‌স্‌-এর

জনগণের প্রতিবাদী কন্ঠের প্রতিভূ হয়ে ওঠে 'জন নাট্য মঞ্চ' থিয়েটারের ইতিহাসে যা 'জনম' নামে খ্যাত। ভারতবর্ষের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পথনাটকের দল। সাফদার সহ একদল তরুণ ১৯৭৩ সালে স্থাপন করেন এই দল। দেশজুড়ে ১০০টি রাস্তায় প্রায় ৮০০০ শো করেছে। 

আরও পড়ুন
ফেসবুক পোস্ট থেকে জন্ম নিল নাটক, অভিনব উদ্যোগ নির্দেশক দীপঙ্কর সেনের

সত্তরের দশকে ভারত যেমন দেখেছে নকশাল আন্দোলন, তেমনই দেখেছে জরুরি অবস্থা। এই সময়েই জন্ম হয় ‘জনম’-এর। সফদর হাশমির তাঁর নাট্যদল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়, গলিতে, রাজপথে। তৈরি হল ‘জননাট্য মঞ্চ’। জন্মলগ্ন থেকেই ভারতীয় শিল্পজগত ও জনতার নজর কেড়ে নিল জনম। ‘কুর্সি, কুর্সি, কুর্সি’ পথনাটিকটি প্রায় প্রতিদিনই অভিনীত হতে থাকল রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন স্থানে। এবং এই নাটকটিই মোড় ঘুরিয়ে দিল সফদর হাশমির। বলা ভালো, আওয়াজ তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।

এইভাবেও যে একটি আন্দোলন, একটি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় তার ভিত্তি তৈরি করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য সহ গণনাট্যবাহিনী। সেন্ট স্টিফেনস কলেজ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের কৃতী ছাত্র ছিলেন তিনি। সহজেই কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারতেন। তাতে অর্থের অভাব হত না। কিন্তু সুখী, সুবিধাবাদী মানসিকতার বিরুদ্ধেই বারবার কথা বলেছেন, সংলাপ তৈরি করেছেন তিনি। তাঁর শিক্ষা, তাঁর সমাজচেতনা, রাজনীতি তাঁকে নিয়ে আসে মানুষের মাঝে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘে জড়িয়ে পড়াও ছাত্রবয়স থেকেই। মঞ্চে নাটক দেখানোর সামর্থ্য ছিল না তখন সফদরের। ভাবলেন— চার দেওয়ালে ঘেরা হলে কতজন আসবেন, কতজন তাঁদের কথা শুনবেন! প্রসেনিয়ামও তো বকলমে একটি ঘেরাটোপে ভরা সুখী বিনোদন!

তাই প্রসেনিয়াম হলের মুষ্টিমেয় দর্শকের সঙ্গে সীমাবদ্ধ না থেকে, বিরাট প্রযোজনাকে জনতার উঠোনে নিয়ে এসে— গোটা দেশের বঞ্চিত মানুষের ভাষা হয়ে ওঠে সাফদার হাশমির নাটক। স্বাভাবিক ভাবেই শাসককে যে ভয় পেতেই হত, স্বাভাবিক ভাবেই গুলি তাকে চালাতেই হত, তাই চলেও ছিল বুলেট। কিন্তু শাসকের বুলেট একটা দেহকে বিদ্ধ করেছে মাত্র, সত্যকে হত্যা করবে এমন কোনো বুলেট পৃথিবীতে তৈরি হয়নি! 

একদিন যারা হাশমিকে খুন করেছিল ইতিহাসের অকাল প্রহসনে আজ তারাই এক বিরাট অংশের ক্ষমতালোভী বামপন্থীদের সঙ্গে জোট, আঁতাত কিংবা বন্ধুতায় আবদ্ধ। গতবছরই বাসন্তীতে 'ইঁদুরকল' পথনাটক করার জন্য সাম্প্রদায়িক দলের হুমকি শুনতে হয় জনগণমন নাটকের দলকে। শান্তিপুর সাংস্কৃতিক-কে 'রক্ত উপাখ্যান' নাটক করার জন্য শাসিয়ে গেছিল গুন্ডা বাহিনী। 

আসলে সাফদার হাশমির শুধু জন্মদিনই থাকে, কোনো মৃত্যুদিন হয় না। দিকে দিকে ধর্ষণ, গ্রাম পোড়ানো, বেকারত্ব, তোলাবাজি, গবেষকদের আত্মহত্যার দিকে প্ররোচনা দেওয়া হয়— একচ্ছত্র শাসন করে সাংস্কৃতিক মাফিয়ারা তখনই দিকে জ্বলে ওঠা প্রয়োজন সাফদারের নাম, সাফদারের সংলাপ। আনন্দ পটবর্ধন কবিতা লিখেছিলেন সফদারের স্মৃতিতে :

'বাবরি মসজিদ ভাঙতে তুমি দেখোনি
তুমি দেখোনি তার পরের হিংসা আর ঘৃণাকে
তুমি রামাবাঈ আর অন্যান্য দলিতের মৃত্যু দেখোনি
পরমাণু বোমার জন্য দেশের আকুলতা তুমি দেখোনি
২০০২ এ গুজরাটের সাম্প্রদায়ীক হিংসা তুমি দেখোনি
প্রতিবেশি পাকিস্তানে তালিবানের উৎপত্তি তুমি দেখোনি
আর এখানে তুমি হত্যাকারীর রাজ্যাভিষেক দেখোনি
আমরা যারা এখনো বেঁচে রয়েছি তারা এগুলো সব দেখেছি
কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।'

Powered by Froala Editor