নাটকের নামেই ‘ধর্মীয় ভাবাবেগে’ আঘাত! মধ্যপ্রদেশে বন্ধ হল নাট্যোৎসব

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্যপ্রদেশের ছত্রপুর জেলায় আয়োজিত হওয়ার কথা ছিল পাঁচদিন ব্যাপী নাট্য উৎসব। প্রস্তুতির কমতি ছিল না কোনো। তবে শেষ পর্যন্ত এই নাট্যোৎসব বাতিল করে ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (আইপিটিএ)। বিবৃতিতে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণেই বন্ধ রাখা হল এই উৎসব। কিন্তু না, নাট্যোৎসব বাতিলের মূল কারণ মহামারী নয়। কর্মকর্তাদের কাছে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বজরং দল।

কিন্তু হঠাৎ কেন এই বিরোধিতা? কেনই বা তাঁরা বন্ধ করে দিলেন প্রতি বছর আয়োজিত হয়ে আসে এমন একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে? ফেরা যাক সেই প্রসঙ্গেই। অন্যান্য বছরের মতোই এবছরেও অনুষ্ঠান শুরুর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই প্রকাশ করা হয়েছিল নাট্যোৎসবের সম্পূর্ণ সূচি। সেখানেই জ্বলজ্বল করছিল দুটি নাটকের নাম— ‘জাত হি পুছো সাধু কি’ এবং ‘বেসরম মেব জয়তে’। আর এই দুটি নাটকের বিষয়বস্তুই নাকি ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত আনে, এই ছিল উক্ত দলটির বক্তব্য।

তালিকা প্রকাশের পরই দলের তরফে নাটকটি বন্ধ করার জন্য ফোন গিয়েছিল জেলা শাসকের কাছে। হুমকির সঙ্গেই জানানো হয়েছিল প্রশাসন ব্যর্থ হলে, তারাই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অন্যদিকে চিঠি পৌঁছেছিল আইপিটিএ-র ইনচার্জ দেবেন্দ্র খুশওয়াহার কাছেও। এমন ‘অধর্মীয়’ নাট্যোৎসব আয়োজনের জন্য তাঁকে সতর্ক করা হয় ৭ ফেব্রুয়ারি। তবে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেও কোনো সমাধান পাননি তিনি। কুশীলব এবং দর্শকদের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নেন স্থানীয় থানার অধিকর্তাও। বরং উপদেশ দেন তাঁদের নিজেদের সেই সমস্যা মৌখিক কথোপকথনের মাধ্যমে মিটিয়ে নিতে। যদিও বর্তমানে পুলিশ সুপার সচিন শর্মার বক্তব্য, এই নাট্যোৎসব বাতিল করেছেন কর্মকর্তারা নিজেরাই। তবে পুরো ঘটনার কথাই স্বীকার করে নিয়েছেন ছত্রপুরের বজরং দলের সাধারণ সম্পাদক।

মূল বিরোধিতার কারণ  যে নাটক দুটি, এবার ফেরা যাক তাদের প্রসঙ্গে। ‘জাত হি পুছো সাধু কি’ নাটকটি মারাঠি নাটক ‘পহিজি যতিছে’-র হিন্দি অনুবাদ। লেখক পদ্মভূষণ পুরস্কারপ্রাপ্ত মারাঠি সাহিত্যিক বিজয় তেন্ডুলকারের। ইতিপূর্বে খাজুরাহো উৎসব, টিকামগড় উৎসব এমনকি কলকাতাতেও উপস্থাপিত হয়েছে নাটকটি। বিষয়বস্তু? নাটকটির মূল চরিত্র একটি উচ্চশিক্ষিত গ্রামীণ শিক্ষক। যিনি তাঁর এই বিপুল জ্ঞান এবং রচনার পরেও ভুলে গেছেন প্রতিবাদের ভাষা। অন্যদিকে ‘বেসরম মেব জয়তে’ নাটকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে চারটি ছোটো ছোটো ব্যাঙ্গাত্মক গল্পের ওপরে। যেগুলি প্রতিটিই সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার এবং সামাজিক বেড়াজালের খণ্ডচিত্র।

আরও পড়ুন
উত্তরপ্রদেশে প্রতি ৩ ঘণ্টায় একটি ধর্ষণ, বাংলার নারী-সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন আদিত্যনাথ!

নতুন করে নিশ্চয়ই বলে দেওয়া প্রয়োজন পড়ে না যে এই দুটি নাটকেই সক্রিয়ভাবে কোথাওই আসছে না ধর্মের প্রসঙ্গ। অর্থাৎ, বিষয়বস্তু না জেনে শুধুমাত্র নাটকের নামের ওপর ভিত্তি করেই এই প্রতিবাদমূলক অবস্থানে নেমেছেন উক্ত দলের সদস্যরা। 

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল সলমন রুশদি’র একটি বই ‘সেটানিক ভার্সেস’। সেই বইটি নিয়েই আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিলেন ধর্মনেতারা। পরবর্তীকালে ইরানে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে বিষয় হল ইরানেরও আগে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল ভারতে। কেন? ওই একই কারণ – ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত। ভারতে তখনও পর্যন্ত এসেই পৌঁছায়নি সেই বইটি। সুতরাং বইটির সামান্যতম মূল্যায়ন কিংবা পর্যালোচনা করার আগেই তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘নিষিদ্ধ’-র ট্যাগ। এক্ষেত্রেও যেন ঘটল ঠিক সেই ঘটনাই। 

আরও পড়ুন
ঠাকুরবাড়ির শখের থিয়েটার ও জোড়াসাঁকো নাট্যশালা

অন্যদিকে শিল্পীর স্বাধীনতা কমতে কমতে মাটিতে এসে ঠেকেছে বর্তমানে। কার্টুন কিংবা কবিতা এঁকে কিংবা নিতান্ত কমেডিয়ানকেও যে জেলে যেতে হয়েছে— সাম্প্রতিক সময়ে এমন উদাহরণ রয়েছে হাজার হাজার। কিন্তু আইনতভাবে দেখতে গেলে ২৯৫ক ধারায় বলা হয়, কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভাবাবেগ আঘাত এবং ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে অপমানসূচক মন্তব্য অপরাধ। এখন বিষয় হল, ধর্মীয় ভাবাবেগের আঘাতের মাপকাঠি ঠিক কী? পাশাপাশি এও গুরুতর প্রশ্ন— ধর্মীয় আবেগ ঠিক কতটা ঠুনকো হলে তাকে আঘাত হিসাবে ধরা যাবে না? সুতরাং এই আইনের মধ্যেও রয়েছে ফাঁক। তবে যতটুকু বাক-স্বাধীনতা দিয়ে থাকে সংবিধান, ভারতের আইন— সেটুকুও কি সংকটে? প্রশ্ন রইল পাঠকের কাছেই...

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন
উত্তরপ্রদেশে রাস্তা নির্মাণের জন্য কাটা পড়বে ১ লক্ষ ৮৯ হাজার গাছ, জানাচ্ছে আরটিআই

তথ্যসূত্র-
১. IPTA cancels theatre festival in MP after Bajrang Dal protests, Iram Siddique, Indian Express
২. IPTA cancels theatre-event following opposition from Bajrang Dal, Sabrang India

Powered by Froala Editor

More From Author See More