কলকাতার ‘মহেন্দ্র’কে নাটোরের রাজকন্যার প্রেমপত্র; ১৫০ বছর আগেকার না-জানা গল্প

আজ থেকে প্রায় একশো কুড়ি থেকে দেড়শো বছর আগের কথা। কলকাতা আর নাটোরের মধ্যে চলত চিঠি চালাচালির খেলা। প্রায় দেড়শতক আগের প্রেমপত্রের কথা শুনলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু যদি বলা হয়, সেই চিঠি রাজকন্যার? তবে এক ধাক্কায় অনেকটাই কি বেড়ে যাবে না কৌতূহল? হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। দিঘাপতিয়ার রাজকন্যা ইন্দুবালার লেখা চিঠি। ভেসে আসত এই কলকাতাতেই। বছর দুয়েক আগে উদ্ধার হয় সেইসব হারিয়ে যাওয়া চিঠিদের সারি। যাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে রয়েছে এক অদ্ভুত প্রেমের উপাখ্যান।

নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমথনাথের মেয়ে ছিলেন ইন্দুপ্রভা। তবে জ্ঞান হওয়ার আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল বিবাহ। এক পরিচিতের পুত্রের সঙ্গে সম্পর্ক পাকা করেছিলেন রাজা প্রমথনাথ। এমনকি তাঁর পড়াশোনার বন্দোবস্তও করলেন রাজামশাই স্বয়ং। অন্যদিকে একদম ছোট্টবেলায় মাকে হারিয়েছিলেন ইন্দুপ্রভা। মানুষ হয়েছিলেন দিদির কাছে। সেই অর্থে দিদি ছাড়া আর কাউকেই সেভাবে পাননি ইন্দুপ্রভা। একটা সময় চলে গেলেন সেই দিদিও। 

আর অজানা সেই ‘পুরুষ’-এর বাড়িতে আনাগোনা লেগে থাকলেও কখনোই তাঁকে চোখে দেখেননি সামনাসামনি। তবে শেষমেশ গড়ে উঠল বন্ধুত্ব। ধীরে ধীরে সেই বন্ধুত্ব গড়াল প্রেমের দিকে। অজানা সেই ‘সুপুরুষ’ তখন মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী থেকে হয়ে উঠেছেন মহেন্দ্র। 

তবে অন্তরঙ্গ বন্ধু, প্রেয়সী হয়ে ওঠার পরেও ইন্দুপ্রভা কাছে পেলেন না মহেন্দ্রকে। তিনি তো কলকাতার দুঁদে উকিল। থাকেন ভবানীপুর। কাজেই নাটোরে না ফিরলে দু’দণ্ড চোখের শান্তি হওয়ার নয়। ফলে চিঠিতেই চলতে থাকল মান-অভিমানের পালা। চিঠিতেই দুঃখ-গঞ্জনা, প্রেমের কবিতা, সবকিছুই। আর কলকাতায় থেকে সেসব চিঠি পেয়ে কেঁদে উঠত শক্ত মনের আইনজীবী মহেন্দ্র চৌধুরীর মনও। তিনিও লিখতেন প্রত্যুত্তর। শুরুতে ‘প্রিয়তমে’, শেষে ‘তোমার মহেন্দ্র’। মাঝের টুকু নয় ব্যক্তিগতই থাকল রাজকন্যা আর তাঁর রূপকথার রাজপুত্রের।

আরও পড়ুন
প্রেম নিবেদনের কয়েকদিন পরেই ফাঁসি, ১০ বছর ‘ফিরে আসা’র অপেক্ষায় কল্পনা

সব মিলিয়ে প্রায় ২৮৫টি চিঠি। অসংখ্য কবিতা আর বেশ কয়েকটি বই। ইন্দুপ্রভার নিজের লেখাই সেসব। তার মধ্যে রয়েছে নিজের আত্মজীবনীও। তবে কালের প্রবাহেই হারিয়ে গিয়েছিল সেসব। কারণ ১৯৫৬ সাল নাগাদ জমিদারি প্রথা উঠে যেতে পুরো রাজবংশই চলে এসেছে কলকাতায়। নাটোরের রাজবাড়ি ভরে উঠেছিল শূন্যতায়। দু’বছর আগে বাংলাদেশের আধিকারিকেরা একটি সিন্দুক খুঁজে পান। তাতেই থরে থরে সাজানো ছিল কবিতা, চিঠি আর ইন্দুবালার লেখা বইগুলি। সঙ্গে ছিল মহেন্দ্র’র ব্যবহৃত দামি পাথর বসানো মুকুট, হাতির দাঁতের বাটওয়ালা ছুরি। 

সেসবই নাটোরের সেই দিঘাপতিয়ার রাজবাড়িতে সংরক্ষিত হয়েছে। মিউজিয়ামে। আর এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকার সমুদ্রভ্রমণের সাক্ষী থাকা এক কবিতা ‘বঙ্গোপসাগর’ বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে রাজবাড়ির দেওয়ালে। “সচঞ্চল নীল জল করিছে কি ঝলমল/ জ্যোৎস্না মাখিয়া গায়ে সমুজ্জ্বল নিরমল...” দেড়শো বছরের আগের লেখা সেই কবিতাজুড়ে আজও ঝলমল করে ওঠে সাবেকি প্রেম। অদ্ভুত সেই মায়াময় আখ্যান...

আরও পড়ুন
প্রেমের কাছে আত্মসমর্পণ, সারা বিশ্ব ঘুরে ব্রাজিলেই থিতু 'বাউণ্ডুলে' সুরেশ বিশ্বাস

তথ্যসূত্র -
১। ইন্দুপ্রভার চিঠি, momspresso.com
২। দিঘাপাতিয়ার রাজকুমারীর আত্মকথা, এস এম রশিদ, বণিকবার্তা
৩। রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার ২৮৫ প্রেমপত্র, নাসিম উদ্দিন নাসিম, বাংলাদেশ প্রতিদিন

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
কবিতার সূত্রে সম্পর্ক, বিরহেই অমরত্ব পেয়েছিল দাগ দিলভি ও মুন্নিবাই-এর প্রেম

More From Author See More