প্রাচীন নাট্যশাস্ত্রের সুর ধরেছেন কণ্ঠে, ৭০০ বছরের 'ঐতিহ্য' নিয়েই বিদায় ওস্তাদজির

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য। ফরাসের উপর বসে গম্ভীর মুখে আলাপ শুরু করছেন কোনো ওস্তাদ। তরুণ প্রজন্ম যেন খানিকটা ভয় ও সম্ভ্রম নিয়েই তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এভাবেই যখন ইতিহাসের শিকড় আলগা হয়ে আসছিল, তখনই দেখা গেল তাঁকে, বর্তমানে অতি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম কোক স্টুডিওর মঞ্চে। না, র‍্যাপ বা রক অ্যান্ড রোল নয়, বদলে যাওয়া রুচির কথা মাথায় রেখেই শুরু করলেন আলাপ। কিন্তু তার ভিতরেই সঞ্চারিত হল খাঁটি গোয়ালিওর ঘরানার সঙ্গীতের জাদু। মানুষটি আর কেউ নন, ওস্তাদ গুলাম মুস্তাফা। সঙ্গীতের কোনো ধারা নিয়েই শুচিবাইগ্রস্ততা ছিল না তাঁর। বরং ইতিহাস সেঁচে খুঁজে দেখতেন তার মূলকে। আর এভাবেই বাঁচিয়ে রেখেছেন, বলা ভালো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে নতুন করে জীবন্ত করে তুলেছেন তিনি।

ওস্তাদ গুলাম মুস্তাফার জন্মই হয়েছিল সঙ্গীতের জগতে। দাদু ইনায়েত হোসেন খানকে চিনতেন না এমন মানুষ নেই। ওয়াজেদ আলি শাহের সভা গায়ক ছিলেন তিনি। বাবা, মা সকলেই চাইতেন, ছেলে গান নিয়েই থাকুক। আর তিনি নিজেও ছেলেবেলা থেকেই ঢেলে দিয়েছিলেন সমস্তটা। সঙ্গীত শিক্ষার শুরুরটা বাড়িতেই। এরপর দীক্ষা নিয়েছেন ওস্তাদ ফিদা হোসেন খান এবং ওস্তাদ নাসির হোসেন খানের কাছে। ধীরে ধীরে নিজেই তৈরি করলেন নিজের সঙ্গীতের ধারা।

সঙ্গীতের মূল খুঁজতে খুঁজতে ওস্তাদজি পৌঁছে গেলেন প্রাচীন ভারতবর্ষে। ভরতের নাট্যশাস্ত্রের কথা তো আমরা ইতিহাসের বইতে পড়েছিল। ইতিহাস থেকে জানি সেই সময়ের ভারতের সাংস্কৃতিক কৃষ্টির কথা। কিন্তু কেমন ছিল তার সুর? সেই সন্ধানও দিলেন ওস্তাদ গুলাম মুস্তাফাই। মাতঙ্গ ঋষিদের লেখা গান তুলে নিলেন নিজের কণ্ঠে। একটি-দুটি নয়, এরকম মোট সাতটি গান রেকর্ড করেছিলেন তিনি। সেইসব রেকর্ডিং সযত্নে রক্ষিত আছে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির আর্কাইভে। ভাবতে অবাক লাগে, ৭০০ বছর ধরে কোনো শিল্পী যে গান ধরেননি, সেই সুরকে নতুন করে প্রাণ দিলেন বিশ শতকে এসে।

ঠিক একইভাবে আবার তুলে এনেছেন উনিশ শতকের রাজনীতির ছাপও। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের দরবারে যে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার জন্ম, তাই তৈরি করে দিল গুলাম মুস্তাফার গানের ভাষা। তাই কখনো আলাপ শুরু হল আল্লার কথা দিয়ে, আবার কিছুদূর গিয়ে তাই মিলে গেল ব্রহ্মের বন্দনার সঙ্গে। সঙ্গীতের কি নিজস্ব কোনো ধর্ম থাকে? বা হয়তো সময়ের, মানুষের ধর্মই সঙ্গীতের ধর্ম। মিলিত জীবনের ধর্ম।

আরও পড়ুন
শেষ হল কান্ট্রি মিউজিকের একটি অধ্যায়, প্রয়াত কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী চার্লি প্রাইড

সিনেমার জন্য প্রথম গান তৈরি করেন একটি মারাঠি সিনেমায়। সেটা ১৯৫৮ সাল। এরপর মারাঠি ও গুজরাটি ভাষার অসংখ্য ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। এমনকি বাংলায় মৃণাল সেনের পরিচালনায় ‘ভুবন সোম’ ছবিতেও তিনি গান গেয়েছেন। কাজ করেছেন বলিউডেও। পেয়েছেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, পদ্মশ্রী পুরস্কারের মতো সম্মান। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রয়োগ প্রায় মুছেই যেতে শুরু করে। আর তখনই নিজেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়েছিলেন ওস্তাদ গুলাম মুস্তাফা। ডুবে ছিলেন নিজস্ব সঙ্গীতের জগতে।

আরও পড়ুন
‘আমার সোনার বাংলা’র পাশ্চাত্য সঙ্গীতায়োজন, কলকাতা-ঢাকা-লন্ডন এক সূত্রে বেঁধেছিলেন সমর দাস

বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত অসুখে। দুবছর আগেই ব্রেনের সমস্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দীর্ঘদিন। রবিবার বিকালে মুম্বাইতে নিজের বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ওস্তাদ গুলাম মুস্তাফা। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন লতা মঙ্গেশকর থেকে এ. আর. রহমান প্রত্যেকেই। ৮৯ বছর বয়সে শেষ হল এক সঙ্গীতময় অধ্যায়।

আরও পড়ুন
করোনায় প্রয়াত সরোদশিল্পী ওস্তাদ শাহদাত হোসেন খান

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ আর পণ্ডিত রবিশঙ্করের ডুয়েলের 'কাহানি'

More From Author See More

Latest News See More