সরে গেলেন পঙ্কজ মল্লিক, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র সঙ্গীত পরিচালনায় ২৪ বছরের যুবক হেমন্ত

দ্বিতীয় পর্ব

আকাশবাণীর কালজয়ী ‘মহালয়া’ অনুষ্ঠানটির পরিকল্পক ও ভাষ্যকার বাণীকুমার সে-সময় রেডিওর অন্যতম একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব। সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাণীকুমারকে একদিন দেখা গেল রেডিও আপিসে অসহায়ভাবে পায়চারি করতে। পারলে নিজের মাথার চুলই উপড়ে ফেলেন তিনি। তাঁর পরিকল্পিত একটি ফিচার প্রোগ্রামের রিহার্সাল তিনদিন ধরে একই জায়গায় আটকে আছে নির্দিষ্ট একজন শিল্পীর অনুপস্থিতিতে। চতুর্থ দিনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার কারণে এই অবস্থা তাঁর। এদিকে সেই ফিচারের শিল্পী হিসেবে ওয়েটিং রুমে বসেছিলেন তরুণী বেলা মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর ছোটো বোন আভা। বাণীকুমার প্রশ্ন ছুঁড়লেন একজনকে – ‘বড়খোকা আসেনি?’  কী এক বিশ্বাসে উত্তর এল – ‘আসবে, আসবে।’ বিরক্ত বাণীকুমার বললেন – ‘কবে আসবে বলতে পারো?’ খুব স্বাভাবিকভাবেই ‘বড়খোকা’ নামটি শুনে বেলা মুখোপাধ্যায় ভাবতে থাকলেন কত বড় শিল্পী এই ‘বড়খোকা’, যার জন্য স্বয়ং বাণীদার মতন মেজাজি মানুষও প্রতীক্ষা করতে পারেন, তাঁকে বাদ দিয়ে প্রোগ্রাম করার নাম পর্যন্ত করেন না।

প্রতীক্ষা পর্ব চলতে থাকল। হঠাৎ ওয়েটিং রুমের সুইং ডোরে ক্যাঁচক্যাঁচ করে আওয়াজ হল। সুইং ডোরের ওপরের অংশ দিয়ে দেখা গেলো এক তরুণের মাথা ও বুক। রোগা ও লম্বা এই তরুণকে দেখে সবাই হইহই করে উঠল। একজন সুউচ্চ কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন – ‘ঐ তো! বড়খোকা এসে গেছে।’

এদিকে এত লম্বা ও তরুণ একজনকে দেখে হেসে গড়িয়ে পড়লেন বেলা ও তাঁর বোন। সে হাসি থামে আর না। হাসতে হাসতে লাল হয়ে ওঠে দু’জনের মুখ। সেই হাসি দেখে লাল হয়ে ওঠেন সেই তরুণও। সেদিন কি বেলা মুখোপাধ্যায় জানতেন, এই লম্বা তরুণটিই হয়ে উঠবেন তাঁর সারাজীবনের অবলম্বন?

আরও পড়ুন
‘বিবিধ গানে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যদি নিজেকে আরও একটু বেশি করে দিতেন!

পরদিন একজন সাবধান করে তাঁদের – ‘খবরদার! অমন বেয়াদপি করবি না। জানিস বড়খোকা আমাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কালই বড়বাবুর কাছে নালিশ করতে যাচ্ছিল।’

আরও পড়ুন
হেমন্ত যদি চিনা খবরের কাগজও সুর করে পড়ে, লোকে শুনবে - বলেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস

সত্যিই হেমন্ত-বেলা’র প্রথম সাক্ষাৎ এক গল্প বটে।

আরও পড়ুন
অসিতবরণের সূত্রেই যোগাযোগ আকাশবাণীতে, সেই প্রথম বেতারে গাইলেন হেমন্ত

শুধু বেলা মুখোপাধ্যায় নয়, অজিত চট্টোপাধ্যায়ের এবং বিকাশ রায়ের সঙ্গেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আলাপ এই বেতার আপিসেই। কবি নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎও হয়েছিল এই রেডিওতেই। বাণীকুমার ও নজরুল ইসলাম দুজনে ছিলেন দুই ভিন্নপ্রান্তের মানুষ। বাণীকুমার যেমন রাশভারী, নজরুল তেমনই প্রাণখোলা হাসিখুশি মানুষ। দুজনেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ডাকতেন বড়খোকা বলে। নজরুল সম্পর্কে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘আমার গানের স্বরলিপি’-তে বলেছেন – ‘ঐ গার্স্টিন প্লেসেই অনেকবার দেখা হয়েছে নজরুল ইসলামের সঙ্গে। গানের রিহার্সালও দিয়েছি। এক আধটা গেয়েওছি। আমরা খুবই উঁচু চোখে দেখতাম ওঁকে। কবি হিসেবে তো জানতামই তাছাড়া নানান ধরণের সুর একমাত্র নজরুলই করতেন। নতুন নতুন গান করে আমাদের শোনাতেন। একটা ভাল গান করে পাঁচজনকে শোনানোর বাতিক ছিল। এমনিতে খুবই বিখ্যাত ছিলেন, কিন্তু তখনও ঠিক লেজেন্ড হয়ে ওঠেননি। সেটা হলেন আরও পরে। রেডিও ওঁর ঘরবাড়ি ছিল। দিনের বেলা রেকর্ড কোম্পানিতে থাকতেন, সন্ধ্যেবেলা রেডিওতে চলে আসতেন।’

আরও পড়ুন
শুধু উত্তমকুমারই নন, অন্যান্য নায়কদের কণ্ঠেও অবিস্মরণীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

সেইসময় রেডিওতে যাকে কাছে পেতেন তাঁকে নতুন গানের স্বরলিপি করে দিতে বলতেন নজরুল। অনেকেই হয়ত জানেন না, নজরুলের গানের স্বরলিপি করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও। গানটি হল ‘সেদিনও বলেছিলে’। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর বেতারেই সেই গান পরিবেশন করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সঙ্গে গেয়েছিলেন আরও একটি গান ‘পথ চলিতে যদি চকিতে’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সারাজীবনে গাওয়া মাত্র সাত-আটখানা ঐতিহাসিক নজরুলগীতির মধ্যে ‘সেদিনও বলেছিলে’ অন্যতম প্রধান এক সৃষ্টি। এছাড়াও আকাশবাণীতে পরবর্তীতে ‘মেঘলা নিশিভোরে’-সহ আরও বেশ কিছু নজরুলগীতি উনি পরিবেশন করেছেন যেগুলির কোম্পানি থেকে প্রকাশিত স্টুডিও রেকর্ডিং নেই।    

এখানে বলা দরকার বাণীকুমার সম্পর্কে আরও কিছু কথা।

বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য ওরফে বাণীকুমারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন প্রখ্যাত সুরকার শৈলেশ দত্তগুপ্ত মহাশয়। হেমন্ত’র গান তাঁর পছন্দ হলে তিনি রেকর্ড করান হেমন্ত’র গান এবং বন্ধু বাণীকুমারকে বলেছিলেন - ছেলেটি খুব ভালো গায়। একটু দেখিস। জহুরি বাণীকুমার গান শুনে বুঝলেন শৈলেশবাবুর কথা মিথ্যে নয়। তিনিই সুযোগ করে দিলেন হেমন্তকে তাঁর ফিচার প্রোগ্রামে। তখন ফিচার প্রোগ্রামের দক্ষিণা ছিল পাঁচ টাকা। একটার জন্য পাঁচ টাকা, বাকি চারটে ফ্রি অর্থাৎ পাঁচটা ফিচার করলে পাঁচ টাকা মিলত। তখন থেকেই বেতারের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠল হেমন্তর।

তখন একের পর এক ফিচার প্রোগ্রাম করছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

‘বেতার জগৎ’ থেকে জানা যায়, ১৯৪১ সালের ১৯ আগস্ট বিকেল পাঁচটায় সম্প্রচারিত ‘ঠাকুরদার উইল’ নামের একটি ফিচারে অংশ নেন হেমন্ত। রচনা – সাগরিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, বেতাররূপ ও প্রযোজনায় ছিলেন নির্মলভাই (‘গল্পদাদা’ যোগেশচন্দ্র বসুর পুত্র নির্মলকুমার বসু)।  সহশিল্পী ছিলেন – অজিত চট্টোপাধ্যায়, শ্রীলতা বসু, জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিমল বসু। এর আগেও 'প্রদোষ প্রতিমা' নামে আরও একটি ফিচারে তিনি অভিনয় করেছেন বলে জানা যায়। ১৯৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় নির্মলভাইয়েরই প্রযোজনায় অজয় ভট্টাচার্য রচিত এবং শৈলেশ দত্তগুপ্ত’র সঙ্গীত পরিচালনায় ‘পিসিমার কথা’ এবং ‘তাই তাই তাই’ ফিচার দুটিতে অংশ নেন হেমন্ত। সহশিল্পী ছিলেন ইলা ঘোষ। এছাড়াও ‘ঠাকুরদার ঝুলি’ ইত্যাদি বহু ফিচার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

এই বাণীকুমারের অনুরোধেই ১৯৪০ সালে বাঙালির চিরকালের জনপ্রিয় ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে প্রথম অংশগ্রহণ করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাণীকুমার রচনা, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনা ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ সমৃদ্ধ এই গীতিআলেখ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন হেমন্ত। কোরাস গান তো বটেই, সেই সঙ্গে ‘জাগো দুর্গা’ গানটিও একক কণ্ঠে গাইতে শুরু করেন হেমন্ত! দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় নন, সে গানের প্রথম দাবিদার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল ১৯৪০ সালের ১ অক্টোবর, ভোর সাড়ে পাঁচটায় মহালয়ার শুভক্ষণে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়াও সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, অনিল দাস, শৈল দেবী, ইলা ঘোষ, সুপ্রভা ঘোষ (সরকার), কল্পনা হাজরা প্রমুখ। যন্ত্রসঙ্গীতে ছিল সুরেন্দ্রলাল দাস ও মুন্সী আহমেদ নির্দেশিত ‘যন্ত্রীসংঘ’।

১৯৫১ সালে মুম্বাই যাবার আগের বছর পর্যন্ত প্রতিবছর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অংশ নিতেন এই অনুষ্ঠানে। পরবর্তীতে গানটি গাইতে শুরু করেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।

১৯৪৪ সালে ঘটল এক দুর্দান্ত ঘটনা! বেতার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতান্তর ঘটায় পঙ্কজ কুমার মল্লিক সেবার সরে গেলেন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ থেকে। সবার মাথায় হাত। কি হবে এবার? এত বড় অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনার গুরুদায়িত্ব সামলাবে কে? সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন বাণীকুমার। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নিতে বললেন ২৪ বছর বয়সী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। তাই হল! সেবছর সঙ্গীত পরিচালনা করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

ঐসময় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে বেশ কিছু নতুন গানে সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। পঙ্কজবাবু পরবর্তীতে ঐ সুরগুলো রেখে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ বর্তমানে যে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আমরা শুনতে পাই, তার কয়েকটি গানের সুর হেমন্তবাবুর করা।

এখানে মহালয়ার প্রোগ্রামের কথা কিছুটা বিস্তৃত ভাবে বলতেই হয়।

Powered by Froala Editor

More From Author See More