অসিতবরণের সূত্রেই যোগাযোগ আকাশবাণীতে, সেই প্রথম বেতারে গাইলেন হেমন্ত

প্রথম পর্ব

ছেলেগুলোর ভীষণ ইচ্ছে, তাদের বন্ধু মিত্র ইন্সটিটিউশনের প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন অনুষ্ঠানে গান গাইবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সে-দাবি মঞ্জুর হয়নি! কারণ, তাঁদের বন্ধু মাথায় বড্ডো লম্বা, ঐরকম একজন ঢ্যাঙা-লম্বা ছেলে মিত্র ইন্সটিটিউশনের ছাত্র, সেটা জানাজানি হলে স্কুলের সম্মানহানি হবার আশঙ্কা আছে! বড়োলোকেদের স্কুলের রকমসকম দেখে বন্ধুরা সব রেগে আগুন! ওদের মধ্যে একজন সেদিনই প্রতিজ্ঞা করলেন, বন্ধুকে দিয়ে রেডিওতে গান করাবেনই। রেডিওতে গান করানোতে সেই বন্ধুর অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই বন্ধু হলেন পরবর্তী কালের বিখ্যাত 'পদাতিক কবি' সুভাষ মুখোপাধ্যায়, আর তাঁর বন্ধু হলেন সঙ্গীতজগতের কিংবদন্তি - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

বেতারের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক সেই পনেরো বছর বয়স থেকে। তা অটুট ছিল জীবনের শেষ পর্যন্ত। এই দীর্ঘ যাত্রাপথের শুরুটা অনেকেই হয়তো জানেন। তবু 'বেতার ও হেমন্ত' শীর্ষক আলোচনায় সেই কথা বিস্তৃত না বললে অন্যায় হবে না কি? তাই আজ একই কথার পুনরাবৃত্তি।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় তখন সেকেন্ড ক্লাসের (অর্থাৎ এখনকার দিনের ক্লাস নাইন) ছাত্র। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাবা এবং কাকা দুজনেই তখন গান গেয়েছেন রেডিওতে। তাহলে তাঁর বন্ধুই বা গাইবে না কেন? নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শে বসলেন সুভাষ। কিন্তু গাইবে বললেই তো গাওয়া যায় না? রেডিওতে গাইতে গেলে অডিশনে পাশ করতে হবে, ওদের পছন্দ হলে তবেই গান গাওয়া যাবে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মা এই ঘটনা জানতে পেরে বললেন, টিপিদাকে গিয়ে ধর, ওঁর ছেলে কালো রেডিওতে তবলা বাজায়। যেমন কথা তেমন কাজ। টিপিমামাকে গিয়ে ধরলেন একদিন সুভাষ।

আরও পড়ুন
শুধু উত্তমকুমারই নন, অন্যান্য নায়কদের কণ্ঠেও অবিস্মরণীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

টিপি হলেন সুভাষের দুই মামার সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসের কলিগ বন্ধু তারাপদ মুখার্জি। মামার বাড়িতে অনেকবার দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। তাঁকে খুঁজে পেলেন গোলাপ শাস্ত্রী লেনের সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফের অফিসেই। রেডিওতে বন্ধুকে গান গাওয়ানোর ব্যাপারে বলতে টিপিমামা বললেন, 'তুই এক কাজ কর - শনিবার বিকেলে আমাদের বাড়িতে যাস। কালোকে আমি বলে রাখব।'

শনিবার এল। বিকেল নাগাদ সুভাষ গেলেন সারপেন্টাইন লেনে টিপিমামার বাড়িতে। বাড়িতে প্রবেশ করেই শ্যাওলা-পড়া ছোটো উঠোন। সামনে একজন কমবয়সি ছিপছিপে গড়নের লোক খোলা কলের নিচে ভিজে গামছা দিয়ে পিঠ রগড়াতে রগড়াতে গা ধুচ্ছেন এবং গান গাইছেন। কালোদাকে গলা তুলে ডাকতেই তিনি সাড়া দিয়ে বললেন - ঘরে গিয়ে বস, আমি এখুনি আসছি। সেদিনই রেডিওতে হেমন্ত'র অডিশন দিতে যাবার দিন পাকা করে বাড়ি ফিরলেন সুভাষ। একাই সব ব্যবস্থা সেরে পরে হেমন্তকেও জানালেন সব।

আরও পড়ুন
১৪টি দেশের ৩২৫ জন শিল্পী জুড়লেন গানে, লকডাউনে বিশ্বরেকর্ড ভারতীয় সুরকারের

এরপর এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন। 'ছোট আদালত'-এর উল্টোদিকের রাস্তার শেষে ১নং গার্স্টিন প্লেসের বাড়ির সামনে নির্ধারিত দিনে পৌঁছলেন দুই বন্ধু - হেমন্ত ও সুভাষ। বন্ধু হেমন্তর অডিশনের দিন আজ। সুভাষের পা কাঁপছে তখন। হেমন্তকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী রে, ভয় পাচ্ছিস না তো!' হাসি হাসি মুখে নির্বিকার হেমন্ত বললেন, 'না, ভয় পাব কেন।' রেডিও অফিসে কালোদা ওঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওঁরা যেতে ওঁদের নিয়ে গেলেন একটা বড় হল ঘরে। সামনেই বসেছিলেন বেতারের মিউজিক বিভাগের প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ মিঃ বি. কে. নন্দী, তিনিই নেবেন আধুনিক গানের বিভাগে হেমন্তর অডিশন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেমন্ত নির্বিকারভাবে এগিয়ে গিয়ে বসলেন হারমোনিয়ামের সামনে, টেনে নিলেন নিজের কাছে। অবলীলায় গাইলেন সেনোলা কোম্পানি থেকে সদ্য প্রকাশিত সন্তোষ সেনগুপ্তর রেকর্ড করা একটি গান 'আজও পড়ে গো মনে, দুটি কাজল আঁখি' (কথা - নরেশ্বর ভট্টাচার্য, সুর - শৈলেশ দত্তগুপ্ত)। অডিশন শেষ হবার পর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে সুভাষ জিজ্ঞেস করলেন, কেমন হল? হেমন্ত বললেন, 'গাইলাম তো দরদ দিয়ে। এবার কর্তার মর্জি।'

স্বাভাবিকভাবেই এরপর ফলাফল জানার জন্য শুরু হল দীর্ঘ প্রতীক্ষা। কিন্তু সে প্রতীক্ষা করছে কে? হেমন্ত? একেবারেই নয়। তিনি তখন তাঁর সাহিত্য-চর্চায় মগ্ন। এদিকে দিন গড়ায়। সুভাষ মাঝেমধ্যেই খোঁজখবর নেন, কিছু খবর পাওয়া গেল কিনা। হেমন্তর যেন কোনো হেলদোলই নেই, তিনি নেতিবাচক মাথা নাড়েন।

আরও পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে পত্রিকা প্রকাশ, গ্রেপ্তার কবি শম্ভু রক্ষিত

তিন মাস কেটে যায়। শুরু হয় স্কুলের টেস্ট পরীক্ষা। এরমধ্যেই হেমন্তর বাড়িতে একদিন একটা হলুদ খাম এসে পৌঁছল। পুরোটা পড়ে হেমন্ত বেজায় খুশি। ছুটলেন রাসবিহারী এভিনিউয়ে মহানির্বাণ মঠের পাশে বন্ধুর বাড়িতে। একগাল হেসে বন্ধু সুভাষকেও দেখালেন সেই চিঠি। প্রোগ্রাম পেয়েছেন হেমন্ত! ডেট দিয়েছে।

কিন্তু আবার ঘনিয়ে এল চিন্তা! বাবাকে বলবেন কী করে? উনি যদি পারমিশন না দেন, তাহলে...

আরও পড়ুন
লকডাউনে আলোর সন্ধান, নতুন গান তৈরি করলেন বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী

অফিস যাবার আগে একদিন বাবাকে বললেন রেডিওর প্রোগ্রামের কথা। রেগে উঠলেন কালিদাস মুখোপাধ্যায়। বাড়ির ছেলের গলায় ঝুলবে গাইয়ের তকমা? রেডিওতে গান-টান গাওয়া হবে না, পড়ালেখার সময় এখন, তাই কর মন দিয়ে, বলে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

সেদিনই বন্ধুদের মধ্যে পরামর্শ সভা বসল, এবার কী করা? বন্ধুরা আস্বস্ত করলেন হেমন্তকে, প্রয়োজনে তারাই বোঝাবেন হেমন্তর বাবাকে।

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের ভাইপোর কাছে শিখেছেন গান, মুক্তিযুদ্ধের সময় কনসার্টের আয়োজকও তিনিই

তবে প্রয়োজন হল না। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরার পর হেমন্তর বাবাকে বোঝালেন তাঁর মা। ছেলের আগ্রহ তো তাঁর মারও। শেষমেশ মায়ের কথাতেই রাজি হলেন বাবা।

সেই পরীক্ষার মধ্যেই আবার সুভাষের কাছে হাজির হলেন হেমন্ত। রেডিওর চিঠিতে উল্লেখ ছিল আধুনিক গানের জন্য সময় বরাদ্দ দশ মিনিট, অর্থাৎ দুটো গান এবং এমন গান গাইতে হবে যাতে কপিরাইটের সমস্যায় না পড়তে হয়। তার জন্য জোগাড় করতে হবে গান। রেডিওতে গাওয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের চোখে অপরাধ হলেও তখন রেডিওতে গাওয়া আর্টিস্টদের পাড়ার লোকেরা দেখত বেশ উঁচু চোখেই। কাজেই ভালো গান ঠিক করতে হবে। কিছুদিন আগেই কমল দাশগুপ্তের সুরে এবং প্রণব রায়ের কথায় একটা গান শুনেছেন তিনি 'তোমার হাসিতে জাগে'। সুভাষকেই বললেন এই সুরে একটা গান লিখতে। বন্ধু সুভাষ কবিতা লিখেছেন, কিন্তু আগে গান লেখেননি কোনদিন, হঠাৎ বললেই হল? ঘসঘস করে কাগজে 'তোমার হাসিতে জাগে' গানটির কথা লিখে দিলেন, ঐ ছাঁদে লিখতে হবে। প্রথম গান লেখা, সময় লাগবে। পরীক্ষার পড়া ছেড়ে সারাদুপুর চলল গান লেখার পর্ব। সুভাষ লিখলেন, "আমার গানেতে এলে নবরূপী চিরন্তনী / বাণীময় নীলিমায় শুনি তব চরণধ্বনি..."। শেষ হবার পর হেমন্ত কাগজটা তুলে নিয়ে বললেন, 'বাহ! খাসা হয়েছে।'

আরও পড়ুন
‘#ভাগ্যিসসুমনছিলেন’, সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের অস্ত্র হয়ে উঠছে কবীর সুমনের গান

একটা তো হল, কিন্তু আরেকটা গান। হেমন্তদের পাড়ায় ভাটিয়ালি গাইতেন নিরাপদ চক্রবর্তী নামের একজন। তাঁর কাছেই শিখে নিলেন একটি ভাটিয়ালি গান - "আকাশের আরশিতে ভাই / পইর্যামছে মোর মনের ছায়া..."। লোকগীতিতে কপিরাইটের হাঙ্গামা নেই। দুটি গান জোগাড় হয়ে গেল।

অবশেষে এলো প্রোগ্রামের দিন এল। তখন রেডিও খুব লোকের বাড়িতেই রেডিও থাকত। অত্যন্ত চিন্তাগ্রস্ত সুভাষ সকাল থেকেই। সন্ধ্যেয় হেমন্তর গান। কিন্তু শুনবেন কোথায়? সর্দার শঙ্কর রোডের ঘটকবাড়ির শালা তাঁর ছোটকাকার বন্ধু। সেখানেই যাবেন ঠিক করলেন। দুপুর থেকেই উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছেন যাবার জন্য। উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছেন আরও একজন। হেমন্তর মা। বাড়ির সব কাজ সারতে সারতে তাঁর চোখ চলে যাচ্ছে বারবার ঘড়ির দিকে, ছেলের গান আছে রেডিওতে।

আরও পড়ুন
শুধু গান নয়, বেলা বোসের নামে রয়েছে আস্ত একটি স্টেশনও

প্রোগ্রাম শুরু হবার এক ঘণ্টা আগেই সুভাষ চলে গেলেন ঘটকবাড়িতে। বসে থাকতে থাকতে একজন লোক এসে বসলেন ঘরে। বাড়ির কাকিমা সেই লোকটিকে বললেন, 'এই ছেলেটির বন্ধু আজ রেডিওতে গাইবে' আর সুভাষের দিকে ফিরে বললেন, 'তুমি চিনতে পারছ তো? ইনি হলেন পাহাড়ী সান্যাল!' সুভাষের টেনশন আরও বেড়ে গেল! একে তো চিন্তা বন্ধু ট্রামে বা বাসে ঠিকমতো পৌঁছেছে কিনা, তারপর যদি পৌঁছে যায় ঠিকমতো গাইতে পারবে কিনা। যদি গাইতে গিয়ে গলা ভেঙে যায়, কী হবে?

এদিকে গান শুরুর দশ মিনিট পূর্বে হেমন্ত-জননী কিরণবালা দেবী এবং সেজভাই তারাজ্যোতি উঠে এলেন পাশের বাড়ির ছাদে। তারও পাশের বাড়ির জানলার একটি পাল্লা খুলে গেল, গরাদের ভেতর দিয়েই দেখা গেল বড় রেডিওটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোষণা হল 'এবার আপনাদের গান গেয়ে শোনাচ্ছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়'। শুরু হল গান।

আরও পড়ুন
আমার ছবিকে প্রভাবিত করেছে পিঙ্ক ফ্লয়েড, বিটলস, রবীন্দ্রনাথের গান

ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা সুভাষের হুঁশ ফিরল পাহাড়ী সান্যালের কথায় - "বাঃ বাঃ। চমৎকার। তোমার বন্ধুটিকে বল চর্চা করলে ও ভাল গাইয়ে হবে।' অল্প হেসে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে গেলেন তিনি। বাড়ি ফিরে বুক গর্বে দশ হাত হল তাঁর, বন্ধু বেতারে গান করেছে!

তৃপ্তির হাসি আর উজ্জ্বল মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও। ইতিহাসের এই হল সূচনা। তারপর বেতারে হেমন্তবাবুর প্রোগ্রাম সম্প্রচারিত হয় পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৬ সালে।

আরও পড়ুন
শ্রোতার অপেক্ষা নেই, রাতের রাজপথে একাই গান গেয়ে চলেছেন এই বৃদ্ধ

ওহো! একটা কথা তো বলাই হয়নি। এই কালোদাই হলেন ভাবীকালের প্রখ্যাত অভিনেতা অসিতবরণ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম রেডিওতে গান করার ব্যাপারে তাঁর অবদানটুকুও সঙ্গীত-প্রেমীরা স্মরণ করতে বাধ্য!

বেলা মুখোপাধ্যায়ের সাথে প্রথম সাক্ষাৎও তো রেডিও অফিসেই। সে এক মজার ঘটনা। যদিও ঘটনাটি অনেক বছর পরের। 

আরও পড়ুন
জার্মান সঙ্গীতজ্ঞের গান প্রকাশ্যে আনলেন মাইসোরের শেষ মহারাজা

Powered by Froala Editor

More From Author See More