‘মায়াবন্দরের দিকে’ পাড়ি দিলেন কবি মৃণাল বসু চৌধুরী, ফুরলো শ্রুতি আন্দোলনের অধ্যায়

দুই বাংলার সাহিত্যমহলেই অবাধ বিচরণ ছিল তাঁর। ‘শ্রুতি’ আন্দোলনেরও অন্যতম পুরোধা তিনি। কথা হচ্ছে কবি ও কথাকার মৃণাল বসু চৌধুরীকে (Mrinal Basu Chaudhury) নিয়েই। গত ২৮ তারিখ থেকেই বসেছে কলকাতা বইমেলার আসর। আর তার তৃতীয়দিনেই ঘনিয়ে এল বিষণ্ণতার মেঘ। না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন কবি মৃণাল বসু চৌধুরী। সকাল ১১টা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। 

১৯৪৪ সালে এপার বাংলাতেও জন্ম মৃণাল বসু চৌধুরীর। স্কুল জীবন থেকেই কবিতার সঙ্গে গড়ে উঠেছিল সম্পর্ক। শুরুতে ছোটো পত্রিকার কাছেই আশ্রয় খুঁজেছিল তাঁর কবিতা। পরবর্তীতে কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহেই লেখা পাঠানো ‘দেশ’ পত্রিকায়। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত মৃণাল। বয়স বড়োজোর কুড়ি বছর। প্রকাশিতও হল সেই কবিতা। এই কবিতাটির সূত্রেই তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ জমে কবি সাগরময় ঘোষের। বাংলা কবিতা-জগতের সম্পর্ক গড়ে ওঠাও ‘দেশ’ পত্রিকার হাত ধরেই। পরিচয় শক্তি-সুনীল, নবনীতা দেবসেন কিংবা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে। 

তবে গতানুগতিক সাহিত্যচর্চায় কোনোদিনই আটকে থাকেননি মৃণাল। চেয়েছিলেন ছক ভেঙে কবিতার জগতে নতুন ধারা নিয়ে আসতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়াকালীন সেই লক্ষ্যেই শুরু করেন স্বতন্ত্র সাহিত্য পত্রিকা ‘শ্রুতি’। যে কাগজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন পবিত্র মুখোপাধ্যায়, রত্নেশ্বর হাজরা, পরেশ মণ্ডল, পূর্ণেন্দু পত্রীর মতো ব্যক্তিত্ব। পরবর্তীকালে এই পত্রিকার স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরই জন্ম দেয় শ্রুতি আন্দোলনের। বামপন্থী চিন্তাধারা কিংবা হাংরি আন্দোলনের উগ্র ও যৌনধর্মী বিষয়ের বাইরেও সমাজ-সংস্কৃতির একটি বড়ো অংশ রয়েছে— তার বৃহত্তর চিত্রই ফুটে ওঠেছিল শ্রুতি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। অবশ্য ‘শ্রুতি’ নিয়ে বিতর্কও ঘনিয়েছিল তৎকালীন সময়ে। 

‘শ্রুতি’-র প্রথম প্রকাশের বছরেই প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল মৃণালের। ‘মগ্ন বেলাভূমি’ সাড়া ফেলেছিল তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘শহর কলকাতা’ প্রকাশিত হয় আরও বছর পাঁচেক পর। তবে নব্বইয়ের দশকের শেষ লগ্নে বাংলা কবিতার জগৎ থেকে একপ্রকার স্বেচ্ছায় অন্তর্ধান নেন মৃণাল বসু চৌধুরী। ১৯৮৭ সালের পর কাব্যগ্রন্থ তো বটেই, কোনো পত্রিকাতেও তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়নি দীর্ঘ ১২ বছর। ১৯৯৯ সালে নির্বাসন ভেঙে পুনরায় আত্মপ্রকাশ বাংলা কবিতায়। প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘কবিতা সংগ্রহ’। এর পর ধারাবাহিকভাবে দুই বাংলা থেকেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একাধিক গল্প, কবিতা এবং প্রবন্ধ গ্রন্থ। যার মধ্যে ‘স্বপ্ন পরস্পর’, ‘গুহাচিত্র’, ‘স্বর্গ থেকে নীলপাখি’, ‘মায়াবন্দরের দিকে’, ‘শব্দ-স্মৃতিঘর’ উল্লেখযোগ্য ছাপ রেখে গেছে বাংলা সাহিত্যে। 

আরও পড়ুন
কারাগারে বসে লেখা ভালোবাসার কবিতা, বিশ্বের ‘প্রাচীনতম’ ভ্যালেন্টাইনের নিদর্শন এটিই

সমসাময়িক লেখালিখির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগ ছিল শেষ বয়সেও। তরুণ কবি ও লেখকদের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল লিটল ম্যাগাজিন অন্তপ্রাণ, স্বল্পবাক মৃণালের। অকুণ্ঠভাবেই জানিয়েছিলেন, বাংলা কবিতার গতিপথ নির্ধারণ করে তরুণরাই। লেখক-কবিদের আধিক্য, কাব্যজগতের ডামাডোলের মধ্যেও ভালো পাঠক ও সমালোচকদের দৃষ্টি খুঁজে নেবে তরুণ প্রতিভারা— এমনটাই বিশ্বাস ছিল তাঁর। 

আরও পড়ুন
প্রয়াত কবি প্রভাত চৌধুরী, শোকস্তব্ধ অনুরাগীরা

বাংলা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, কবিতাবাংলা, অরণি পুরস্কার-সহ একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন মৃণাল বসু চৌধুরী। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাহিত্যচর্চা চালিয়ে গিয়েছিলেন সকলের আড়ালে। তাঁর নীরব চলে যাওয়ার মধ্যেও যেন থেকে গেল সেই প্রচারবিমুখ কবিসত্তাই। সেইসঙ্গেই শেষ হল বাংলা কবিতার এক অন্যতম অধ্যায়। অভিভাবক হারালেন তরুণরা…

আরও পড়ুন
জার্মান শেফার্ডের কবিতাপাঠ! নাৎসি গবেষকদের দৌলতে কুকুরও হয়ে উঠেছিল বাঙ্ময়

Powered by Froala Editor