কারাগারে বসে লেখা ভালোবাসার কবিতা, বিশ্বের ‘প্রাচীনতম’ ভ্যালেন্টাইনের নিদর্শন এটিই

আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কথা। পঞ্চম শতাব্দীর শেষ লগ্নে পেগান সংস্কৃতি জন্ম দিয়েছিল ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র। ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য তো বটেই আজকের দিনে ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র উন্মাদনা ভারতীয় তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও কম নয়। আর ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র কথা উঠলে গোলাপই হোক কিংবা ভ্যালেন্টাইন কার্ড চালাচালির প্রসঙ্গও উঠবে স্বাভাবিকভাবেই। তবে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কিংবদন্তি যেমন খুব একটা সুখকর নয়, ঠিক তেমনই বিশ্বের প্রাচীনতম ভ্যালেন্টাইনের (Valentine) সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এক অন্ধকার অধ্যায়। হ্যাঁ, বিশ্বের প্রাচীনতম (Oldest Card) ‘ভ্যালেন্টাইন কার্ড’ লেখা হয়েছিল কারাগারে (Prison)। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে।

অবশ্য ভ্যালেন্টাইন কার্ড হালের বিষয়। সে-যুগে ছাপাখানার চল ছড়িয়ে পড়েনি ইউরোপে। ভ্যালেন্টাইন কার্ড বলতে মানুষ বুঝত হাতে লেখা কবিতা। ব্রিটেনের কারাগারে লেখা এমনই একটি কবিতার পাণ্ডুলিপিকে ধরে নেওয়া হয় বিশ্বের প্রাচীনতম ভ্যালেন্টাইন কার্ডের নির্দশন হিসাবে। সেই গল্পেই ফেরা যাক বরং।

পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিক সেটা। যুদ্ধ চলছে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে। ১৪১৫ সালে শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে ফরাসিরা। ব্রিটিশদের হাতে বন্দি হন হাজার হাজার ফরাসি যোদ্ধা। বাদ ছিলেন না রাজপরিবারের সদস্যরাও। সেভাবেই অ্যাজিনকোর্টের যুদ্ধে বন্দি হয়েছিলেন ফ্রান্সের সম্রাট পঞ্চম চার্লসের নাতি চার্লস ডি’অরলিনস। টাওয়ার অফ লন্ডনে বন্দি রাখা হয় তাঁকে। সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ তো ছিলই। বন্দি হওয়ার পর কারাগারে বসেই তিনি শুরু করলেন সাহিত্যচর্চার কর্মযজ্ঞ। জীবদ্দশায় পাঁচ শতাধিক কবিতা রচনা করেছেন ডিউক চার্লস। যার অধিকাংশই লেখা হয়েছিল লন্ডনের ওই কারাগারে বসেই। 

“যে সু দেজা দে’মুর তানি/ মে ট্রেসদুলসে ভ্যালেনতিনি”

আরও পড়ুন
বাংলার প্রথম বাণিজ্যিক গোলাপ, বাঁকুড়ার ফুলেই ভালোবাসার উদযাপন কলকাতায়

মিডল ফ্রেঞ্চে লেখা এই কবিতাটি পাওয়া যায় লন্ডনের কারাগারে বসা চার্লসের লেখা পাণ্ডুলিপি থেকেই। যার বাংলা মানে অনেকটা এরকম— ‘হে আমার ভালোবাসা, আমি প্রেমে ক্লান্ত…’ 

আরও পড়ুন
ভালোবাসাই তাঁদের কাছে আসল ধর্ম; তবুও পূর্ণতা পেল না দেব আনন্দ-সুরাইয়ার প্রেম

একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, এই কবিতার মধ্যে ভালোবাসার উচ্ছ্বাস নেই কোনো। বরং দমচাপা কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে যেন। হ্যাঁ, এই কবিতার প্রেক্ষাপটও যে খুব একটা সুখকর নয়, তা তো বলা হয়েছিল প্রথমেই। বোনে ডি’আরমাগনাক— চার্লসের স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়েছিল এই কবিতা। চার্লস তখনও কারাবন্দি। ফ্রান্স থেকে তাঁর কাছে ভেসে এসেছিল স্ত্রী-বিয়োগের সংবাদ। প্রিয়তমাকে শেষ বিদায়টুকুও জানাতে পারেননি ফ্রান্সের ডিউক। সেই আক্ষেপ এবং যন্ত্রণাই যেন ছত্রে ছত্রে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। 

আরও পড়ুন
ভালোবাসা তাঁকে ‘ভিখারি’ করেছে, শেষ জীবনে মুদির দোকান খুলেছিলেন কমল দাশগুপ্ত

শুধু এই কবিতাটিই নয়, সব মিলিয়ে চার্লসের লেখা প্রায় ১৪টি প্রেমের কবিতার হদিশ মেলে তাঁর পাণ্ডুলিপিতে। আর তাদের অধিকাংশের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে নিঃসঙ্গ এক প্রেমিকের কথা। বলাই বাহুল্য, নিজের ট্র্যাজিক জীবনের কাহিনিই তিনি চিত্রায়ণ করেছিলেন কবিতার মাধ্যমে। 

১৪৪০ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান চার্লস। ফ্রান্সে বাকি জীবনটা তিনি কাটান সাহিত্যচর্চার মধ্যে দিয়েই। ’৬৫ সালে জীবনাবসান হয় ফরাসি ডিউকের। স্বাভাবিকভাবেই চার্লসের লেখা কাব্যসামগ্রীর কিছুটা রয়েছে ফ্রান্সে, কিছুটা ব্রিটেনে। কারাবন্দি অবস্থায় লেখা ১৬৬টি কবিতার পাণ্ডুলিপি আজও সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। সেখানেই রয়েছে বিশ্বের প্রাচীনতম ভ্যালেন্টাইন। 

অবশ্য প্রাচীনতম বললে সামান্য ভুল থেকেই যায়। চার্লসের আগেও ভ্যালেন্টাইন লেখার চল ছিল ইউরোপীয় নাইটদের মধ্যে। সেগুলো স্বরচিত হত না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। জন লিডগেট, ক্রিশ্চিন পিজান, জন গোয়ারের মতো কবিদের লেখায় হাতে হাতে ঘুরত সংশ্লিষ্ট মহলে। তবে সে-সব কবিতার মূল পাণ্ডুলিপির সন্ধান মেলেনি আজও। কাজেই প্রাচীনতম ভ্যালেন্টাইন না হলেও, প্রাচীনতম ভ্যালেন্টাইনের নিদর্শন হিসাবে ধরে নেওয়া যায় চার্লসের কবিতাটিকেই…

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More