১৩০ বছরের ভালোবাসা-সমর্থন, ‘ভারতসেরা’ মোহনবাগান ও কলকাতার নতুন বসন্ত

জোসেবা বেইতিয়ার সুইফট টাচে বাড়ানো বলটা লা-লিগার বাবা দিওয়ারা যখন ডানপায়ের শটে জালে জড়িয়ে দিলেন, কোথাও যেন চিকচিক করে উঠল বেলো রজাকের অচেনা দুটো চোখ। এই শহর তাকে হয়তো ভুলেই গেছে। এমন সমাপতনের মুহূর্তে ভেসে ওঠে নামখানা। জন জনসনের পাশ থেকে হেড করে যাওয়া একটা কালো শরীর ইতিহাসের বাঁকে যে বৃত্ত শুরু করেছিল, তাকেই শেষ করলেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা বাবা দিওয়ারা। মোহনবাগান আর ফুটবল যেভাবে হাত ধরে পেরিয়ে এসেছে ১৩০ বছর, সেভাবেই পেরিয়েছে কাল, পাল্টেছে সময়, বদলে গেছে দেশ-সমাজ-রাজনীতি। শুধু ইতিহাসের পাতাজুড়ে থেকে গেছে মোহনবাগান ক্লাব আর তাদের সুদীর্ঘ ইতিহাস, যা রেকর্ডবুক থেকে নেমে এসেছে ধূসর পৃথিবীর কোলাহলে। হয়েছে আধুনিক ভারতের উত্থানের এক জীবন্ত দলিল!

আজকের ভারতসেরা মোহনবাগান স্লোগানের ভেতর সব্বাই রয়েছে - সেদিনের অভিলাষ ঘোষ থেকে আজকের টিংকু দাস, সেদিনের ভূপেন্দ্রনাথ বসু থেকে সুব্রত-প্রশান্ত-চুণী হয়ে চিমা-ওডাফা কিংবা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া উমাকান্ত পালধির মতো হাজারে হাজারে মানুষ, ইতিহাস যে বহমান….

কলিকাতা-সুতানুটি-গোবিন্দপুর - আঠারো শতকের শেষের দিকে, ভারতের রাজধানী কলিকাতা শহর মোটামুটিভাবে এই তিনটি গ্রাম জুড়ে গড়ে উঠেছে। শহর বলতে তখন দুটো রাজপথ। সার্কুলার রোড যা আজকের এজেসি বোস রোড, আর অন্যটা হ্যারিসন রোড, অধুনা এম জি রোড। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ধর্মতলা ও উত্তরে শোভাবাজার অবধি এই দুই হাত মেলে থাকা পাকা রাস্তার পাশে, একটু একটু করে আধুনিক হতে থাকা শহর কলকাতা। শোভাবাজার-আহিরীটোলা-ফরিয়াপুকুর অঞ্চলে পাকাবাড়ি লাগোয়া ছোটো ছোটো একচালা বাড়ি ছড়িয়ে আছে। বিখ্যাত গলির বাঁকে বাঁকে লেগে আছে বনেদিয়ানা। সন্ধ্যায় সাইকেলের ক্রিং, রকের আড্ডা আর মাঝে মাঝে শান্ত কলকাতার বুকে ব্রিটিশ বুলেটের শব্দ!

শ্রীপান্থ লিখেছিলেন, ব্রিটিশরা অত্যাচারের ফাঁকে আমোদপ্রমোদের জন্য এই কলকাতায় আফিমের মতো নিয়ে এসেছিলেন ফুটবল খেলাকে। বাঙালিরা সেই ফুটবলকেই নিয়েছিল পাল্টা লড়াই-এর অস্ত্র হিসেবে। ১৮৫০ সালের পর থেকেই উত্তর কলকাতায় ফুটবল খেলার যে চল শুরু হয়েছিল, তাকে পূর্ণতা দিলেন ফরিয়াপুকুরের তিন অভিজাত পরিবার। কিরীটি মিত্রের বাড়ির সামনে সাজানো বাগান, সাধ করে পূর্বপুরুষ নাম রেখেছিলেন 'মোহনবাগান ভিলা ', ১৮৮৯ সালে মোহনবাগান ক্লাবের জন্ম, ভূপেন্দ্রনাথ বসুর সভাপতি হওয়া কিংবা প্রথম ১৯০৪ সালে কোচবিহার কাপ জয় - সে ইতিহাস তো লেখাই থাকবে স্কোরবোর্ডে। ১৯১১-এর শিল্ড জয়ের কথা লেখা থাকবে বই-এর পাতায়। কিন্তু যা লেখা থাকবে না তা হল লড়াই-এর গল্পগুলো, একটার পর একটা টুর্নামেন্ট জয় পরাধীন ভারতের বুকে। এ-উদ্দীপনা ছিলো সংক্রামক, যা আন্দোলিত করেছিল গোটা ভারতবর্ষকেই। জাতীয় জীবনে পর্যদুস্ত ভারতবাসীর জয়ের একটা তীব্র ক্ষুধা ঘুমিয়ে ছিল, সঙ্গে ছিলো শিরদাঁড়া সোজা রেখে শোষকের দর্পে পাল্টা কষে লাথি দেবার তীব্র বাসনা। মোহনবাগানের সেই ফাইনালটি তাই আর শুধু কোনো খেলা রইল না। ২৯ জুলাইয়ের ফাইনালকে তারা পরাধীনতার নৈরাশ্য পায়ে ঠেলার ও বিজয়ের প্রথম সুখ অনুভব করবার উপলক্ষ্য হিসেবে দেখছিলেন।

সে ইতিহাস আজ অতীত, স্বাধীনতার সময়ে গোষ্ঠ পাল, তারপর মোহনবাগানে শৈলেন-চুণী যুগ এল একে একে। ইস্টবেঙ্গলের উত্থানের আগে কলকাতা মানেই মোহনবাগান।

তবে রাজনীতি আর সমাজের প্রতিটা বাঁকে পাল্টেছে মোহনবাগানের ইতিহাস। ডুরান্ড, রোভার্স, শিল্ডে ভরে উঠেছে ট্রফি ক্যাবিনেট। সুব্রত-প্রশান্ত-বিদেশ-মানস-দিলীপ একে একে দশক পেরিয়েছে। তবে সত্তরের শেষভাগে ইস্টবেঙ্গলের আধিপত্য ভেঙে উঠে, আশির দশকের শুরুতে কৃশানু-বিকাশ জমানার আগে অব্দি মোহনবাগানের যে রাজকীয় উত্থান, তা হয়তো ১৩০ বছরের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ। ৭৭-এ পেলের কলকাতা আসার পর থেকেই বদলে যায় হাবিবের মোহনবাগান। বলা হত ফুটবল সম্রাট সুদূর ব্রাজিল থেকে নিয়ে এলেন মোহনবাগানের স্বর্ণভাগ্যটি। নব্বই-এর দশকে টুটু বসু ক্ষমতায় এসে প্রথম গঙ্গাপাড়ের ক্লাবে বিদেশি খেলোয়াড় আনার চল করলেন, গোষ্ঠ পালে পা পড়ল চিমা ওকোরির, তারপর এল অমল দত্তের শেষ জমানা, বিখ্যাত ডায়মন্ড সিস্টেম!

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক কিন্তু আবার অনেকটাই লাল-হলুদময়। আশিয়ান জয়, জাতীয় লীগ জয় করে তখন বেশ চনমনে ইস্টবেঙ্গল। তবে একটা জাতীয় লীগ জয়ের পর প্রথম মোহনবাগানকে কিছুটা লড়াইতে ফিরিয়েছিলেন মরক্কান কোচ করিম বেঞ্চারিফা, রানার্স!

তবে সাবেক মোহনবাগান কর্তারা কিন্তু বড়ো প্লেয়ার তুলে আনতে ওস্তাদ ছিলেন বরাবরই। ২০১১ মরশুমে ইস্টবেঙ্গলে মর্গান জমানাকে টেক্কা দিতে তারা নিয়ে এসেছিলেন ভয়ংকর ওডাফাকে। একটা অবনমন আতঙ্ক যে ওডাফা মোহনবাগানকে বাঁচিয়েছিলেন একা হাতে, সঙ্গে ছিল সুব্রত-প্রশান্তর ক্ষুরধার মস্তিষ্ক - আজ এই ভারতজয়ের দিনে ভারত কাঁপানো ওডাফা লাইমলাইট থেকে অনেক অনেকদূরে বসে অপেক্ষমান। হয়তো খবর পাচ্ছেন তাঁর প্রিয় দল জিতেছে। একদিন যে ওডাফা আক্ষেপ করে বলেছিলেন - "আমার পিছনে মোহনকর্তারা একটা সনি নর্দি দিলে চ্যাম্পিয়ন করিয়ে দিতাম বলে বলে…"। ওডাফার মতো স্ট্রাইকার হয়তো আর আসবে না ভারতীয় ফুটবলে!

এরপর সোনি নর্দি জমানায় এলো প্রথম আইলিগ, কোচের চেয়ারে বঙ্গতনয় সঞ্জয়। মনে রাখতে হবে সেই প্রথম মোহনবাগান দলগত ঐক্যে ফুটবল খেলেছিল, একুশ শতকে প্রথমবার, ওডাফার আমলে যা ছিল না। ফলে এল সাফল্য!

আজকের জয়ের পর আলো এসে পড়েছে এক স্প্যানিশ ভদ্রলোকের ওপর। বাংলার ফুটবল যাকে কী দিতে পারবে, তা মহাকাল বলবে। কিন্তু অচেনা কিবু বাংলাকে দিয়ে গেলেন অনেক কিছু। মোহনবাগান কিংবা ইস্টবেঙ্গলের সাবেক কর্তা, সমর্থক এমনকি তাবড় তাবড় প্লেয়ার-কোচরা এতবছরে যা করতে পারলেন না, কোন অচেনা হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা কিবু সেটা করতে পারলেন। ফুটবলের বাইরে গিয়ে এই প্রথমবার হাজার হাজার সাধারণ মানুষের মন জিতলেন স্প্যানিশ মানুষটি। সেই মাঠে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই তাঁর, তিনি জিতে গেছেন তাঁর আসল লড়াই। কিবু জানেন না এই শহরে তাঁর মেয়াদ কতদিন, বাংলার ফুটবল আগামী বছর থেকে এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়াবে, সেখানে উল্টেপাল্টে যাবে অনেক হিসেব। কিন্তু এই বসন্তের কলকাতার রং স্প্যানিশ শিল্পী তাঁর ছাত্রদের নিয়ে করে দিলেন সবুজ-মেরুন। আগামীর ইতিহাস যাকে ভুলবে না কোনোদিন। তিনি মোহনবাগানকে নয়, জেতালেন অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে লড়াইকে। জেতালেন সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সোনালি বাতাবরণকে। আস্ফালনের বিরুদ্ধে গিয়ে জেতালেন নীরব বিদ্রোহকে।

আজকের বেইতিয়ার স্বপ্নের ফুটবল, ফ্রানের অদম্য জেদ কিংবা বাবার গগনচুম্বী প্রতিভা লেগে রইল ফাগুনী পূর্ণিমার আকাশে। ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ সে বটগাছে যেন নতুন পাতা এল এই বসন্তে। তার নিচে মানুষের কোলাহলে দুলে উঠছে সোনালি ইতিহাসের চূড়া। বাংলার ফুটবল আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে আসমুদ্রহিমাচলের সামনে। কোথাও দূরে দাঁড়িয়ে হাসছেন কৃশানু-বিকাশ, সুব্রত-প্রশান্ত, সুভাষ-শ্যাম থেকে শিশির-দীপেন্দুরা। ভারতীয় ফুটবলের মক্কায় দেশের শ্রেষ্ঠ খেতাব ঢুকছে আবার। দায়িত্বের ভারে আরও ন্যুব্জ হচ্ছে বনস্পতি। তার ছায়ায় পথিকের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমশ। আজ তো উৎসব, আজ তো বাগানে বসন্তের দিন - সে বসন্ত ছুঁয়ে থাক মানুষের জীবনকে। ছুঁয়ে থাক অকালে হারিয়ে যাওয়া উমাকান্ত-টিংকুদের। ছুঁয়ে থাক সামান্য ঠিকে কাজের টাকা বাঁচিয়ে মাঠে যাওয়া শীর্ণকায় সমর্থকটিকে। ছুঁয়ে থাক বাবার হাত ধরে মাঠে আসা কোনো নতুন প্রজন্মকে – এ-চাওয়ার রং লেগে থাকুক আগামী কয়েকটা দিন। সেই আনন্দের কোথাও আজ অন্তত অসহিষ্ণুতা বা হিংসার প্রবেশ নিষিদ্ধ করছে মহাকাল।

বাংলা ময়দানের আকাশে বাতাসে আজ যে শুধুই বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, এ-বসন্ত তার জয়মাল্য গেঁথেছে একটু একটু করে, আজ যা ছুঁয়ে যাবে একশো তিরিশ বছরের কোনো সোনালি ইতিহাসকে। আরও একবার রঙিন করে দেবে শহর কলকাতার এক হলদে দলিলকে…