ভালোবাসার সঙ্গে ছিল বন্ধুত্বও, পরস্পরের ‘সঙ্গী’ হয়ে উঠেছিলেন যেসব বাঙালি দম্পতি

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর-জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

আঠেরো শতকের মাঝামাঝি। বঙ্গসমাজে রেনেসাঁ আসেনি তখনও। রক্ষণশীল সমাজের প্রতি পদক্ষেপে রয়েছে নানা নিষেধ, নানা ‘নিয়ম’। আর মেয়েদের স্বাধীনতা, শিক্ষা? সেসব তখনও বহুদূরের নক্ষত্রের মতো। কলকাতার প্রসিদ্ধ ঠাকুরবাড়িও সেই অন্ধকার থেকে তখনও বেরোয়নি। ঠিক এমন সময়ই জোর আঘাত আনলেন দেবেন্দ্রনাথের মেজ পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম ভারতীয় হিসেবে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করা তো রীতিমতো ইতিহাসের পাতায় নাম তোলা। সেই সঙ্গে তাঁর কাজ, বিভিন্ন অযৌক্তিক নিয়ম থেকে সবাইকে বের করা। সেই কাজেই পাশে পেয়েছিলেন স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে। যশোরের লাজুক মেয়েটি যেন হয়ে উঠলেন সত্যেন্দ্রনাথের অস্ত্র। স্ত্রী’কে নিয়ে পাড়ি দিলেন সাগরের ওপারে। সমাজের মাথায় হাত। এ কী অনাসৃষ্টি! ঠাকুরবাড়ির মুখ থমথমে। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ নিজের লক্ষ্যে স্থির। প্রাথমিক আড় ভাঙার পর, সেই যুদ্ধে সামিল হলেন জ্ঞানদানন্দিনীও। গড়ের মাঠে ঘোড়ায় চড়া থেকে শুরু হয় আগল ভাঙার দৌড়। তারপর নানা সময় ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে মতানৈক্যও হয়েছে তাঁর। শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ পরা শুরু হল তাঁরই হাত ধরে। কিন্তু সেসব মানতে পারেনি কেউ। সত্যেন্দ্র-জ্ঞানদা জোড়াসাঁকো ছাড়লেন। যা করেছেন, দুজনে একে ওপরের সঙ্গে থেকে, হাতে হাত রেখে করেছেন। নিজের শর্তে বেঁচেছেন দুজনেই। সেখানে ছিল বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস; সর্বোপরি, ভালবাসা…

জগদীশচন্দ্র বসু-অবলা বসু

স্বামী ভারতের বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম প্রণম্য ব্যক্তিত্ব। স্ত্রীও হতে পারতেন প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ তিনি নিজেই ছেড়েছেন অসুস্থতার জন্য। পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁর স্বামীর বিজ্ঞান গবেষণার কাজে। শুধু তাই নয়, সমাজের সমস্ত মেয়েদের পাশে ছিলেন অবলা বসু। তিনি এবং তাঁর স্বামী-বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু একসঙ্গে দেশের বিজ্ঞান প্রসারের ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নেরই ফসল ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’। একদিকে যেমন ধরেছেন সংসারের হাল, অন্যদিকে অক্লান্ত হয়ে সাহায্য করে গেছেন মেয়েদের উন্নতি সাধনে। দীর্ঘকাল তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের সম্পাদক। বলা ভালো, তাঁর হাত ধরেই রূপ ফিরে পায় স্কুলটি। সমস্ত কাজেই একে অপরকে পাশে পেয়েছিলেন জগদীশ-অবলা। যত ঝড় এসেছে, দুজনে মিলে আগলেছেন সেসব। বিজ্ঞান, সাহিত্য, নারীশিক্ষা, সমাজ সচেতনতা— সমস্ত কিছুই করে গেছেন তাঁরা। এক অর্থে, দশভুজার ভূমিকাই পালন করে গেছেন অবলা বসু।

নরেন্দ্র দেব-রাধারানী দেব

বিংশ শতকের গোড়ার কথা। তখনও সমাজের নানা মহলে রয়ে গেছে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস। প্রবলভাবে রয়ে গেছে পর্দাপ্রথা। মেয়েদেরকে ঘরের ভেতরেই রেখে দিতে চায় সমাজের পুরুষরা। সেখান থেকেই উঠে এলেন রাধারানী দেবী। তাঁর জেদ, আত্মবিশ্বাস, মাথা নত না করা— এই সমস্ত কিছুই তাঁকে করেছে সেই সময়ের এক ব্যাতিক্রমী চরিত্র। ‘মেয়েমানুষ’ না, ‘মানুষ মেয়ে’ ছিলেন তিনি। কবিতাই তাঁর সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিল কবি নরেন্দ্র দেবকে। এর আগে অল্প বয়সেই বাধ্য হয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল রাধারানীকে। কিন্তু স্বামী মারা যান অল্প বয়সেই। পরে আবার নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে বিয়ে। এখানেই বাংলা চাক্ষুষ করল একটি নতুন ঘটনার। কনে কিনা নিজেকেই নিজে সম্প্রদান করছে! হইহই পড়ে গেল সমাজে। কিন্তু সমস্ত শেকল তো ভাঙতেই এসেছেন নরেন্দ্র-রাধারানী। ডিভোর্সের পক্ষে একদিন জোরালো বক্তব্যও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এসবের বাইরে, প্রেম তাঁদের দুজনকে ছাড়েনি কখনও। একসঙ্গে ঘর বেঁধেছেন, ‘ভালো-বাসা’ ভরিয়ে রেখেছেন ভালবাসায়।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়-গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়

তিনি মিছিলের মানুষ। তিনি বিপ্লবের মানুষ। আবার, অন্যদিকে তাঁর শরীর কবিতারও বটে। আদ্যন্ত রোম্যান্টিক। যে ভূমিকাতেই থাকুন না কেন, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে প্রধান বিষয় হল মানুষ। সেই কাজে যোগ্য বন্ধু ও সহযাত্রী হিসেবে পেয়েছিলেন স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুজনেই একে অন্যের হাত ধরে মানুষের জন্য, অক্ষরের জন্য জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। বেশি আশা ছিল না কোনোদিনই। নয়তো সুভাষ কি করে বলতে পারলেন- ‘তুমিই আমার মিছিলের সেই মুখ/ দিগন্ত থেকে দিগন্ত যাকে খুঁজে বেলা গেল…’। সবাই এক কথায় স্বীকার করে, সুভাষ-গীতা মনে যা, মুখেও তা-ই। সব ফেলে ছুটে গেছেন বস্তির মানুষদের উন্নয়নে। গ্রামে গিয়ে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে কাজও করেছেন। আজকের চাকরিসর্বস্ব, পুঁজিসর্বস্ব দুনিয়ায় এমন দৃশ্য বোধহয় দেখা যাবে না আর… বিপ্লবে, কবিতায় পরস্পরের সঙ্গী হয়েছেন তাঁরা। যেখানে মানুষই হল ভ্যালেন্টাইন…

সত্যজিৎ রায়-বিজয়া রায়

একজন গোটা বাংলা ও ভারতের সিনে দুনিয়ার ‘মানিকদা’; আরেকজনের পরিচয় কারোর কাছে ‘মঙ্কুদি’, কারোর আবার ‘মঙ্কু মাসি’। সত্যজিৎ রায়-বিজয়া রায়ের সম্পর্ককে ঠিক তথাকথিত দাম্পত্যের ছাঁচে ফেলা যায় কি? শুধু স্ত্রী নয়, সত্যজিতের কাছে বিজয়া ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু, বেস্ট ফ্রেন্ড। তাঁদের সম্পর্কের শুরু থেকে জটিলতা তো ছিলই। প্রধান কারণ ছিল দুজনের পারিবারিক যোগাযোগ। সত্যজিৎ ছিলেন বিজয়া রায়ের তুতো ভাই। তাঁর সঙ্গেই কিনা প্রেম, এবং বিয়ে! ১৯৪৯ সালে দুই হাত এক হলেও, বহুদিন প্রকাশ্যে আসেনি সেই কথা। এক সময় আগল ভেঙেছেন। সত্যজিতের শুটিংয়ে মেকআপ, কস্টিউম, লোকেশন সমস্ত কিছুর দায়িত্ব থাকত বিজয়া রায়ের হাতে। সেই সঙ্গে ছিলেন লেখক সত্যজিৎ রায়ের প্রবল সমালোচক। ‘ফেলুদা’ ও অন্যান্য গল্প এবং সমস্ত চিত্রনাট্যের প্রথম পাঠক থাকতেন তিনি। পড়ার পর যা বলতেন, সেই কথাই শুনতেন কিংবদন্তি পরিচালক। এতটাই বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ছিল পরস্পরের। আজ ভারতীয় সিনেমায় সত্যজিতের অবদান কী, এই প্রশ্নটা করলে সিনেপ্রেমীরা বেশ গুছিয়ে একটা লেখা লিখে ফেলবেন। সেই অবদানের পেছনের বটগাছটি হয়ে থেকে গেছেন বিজয়া রায়, সত্যজিতের ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইড অ্যান্ড, ওয়াইফ।

প্রেম কী? ভালোবাসারও কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা হয় কি? এই দম্পতিরা নিজেরাই হয়তো তৈরি করেছিলেন দাম্পত্যের এক নতুন সংজ্ঞা। শুধু এঁরাই নন, বাকি থেকে গেলেন আরও অনেকেই। যাঁদের দাম্পত্য ছিল গতানুগতিক সমাজের কাছে এক 'বিদ্রোহ'। পাল্টে দিয়েছিলেন অনেকের মানসিকতা। শুধু 'স্বামী' বা 'স্ত্রী' হিসেবে নন, জীবনসঙ্গী হিসেবে সম্মান দিয়েছিলেন একে অপরকে। আজকের দিনে, বাংলার এই কিংবদন্তি চরিত্রদের কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। যেন না ভুলি তাঁদের দৈনন্দিনের মধ্যেও মিশে থাকা নির্ভরতা, স্বাতন্ত্র্য...