ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — দ্বিতীয় পর্ব

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত-র জন্ম ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে, কলকাতায়। বর্তমানে বাঁশদ্রোণীতে বসবাস করেন। পেশাগত জীবনে সাংবাদিক ছিলেন, বর্তমানে লেখালিখিতেই সম্পূর্ণভাবে ব্যস্ত। বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘বাঙালি হিন্দুর রসুল-চর্চা’ ও ‘বাঙালি মুসলমানের কালীচর্চা’ বইদুটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। কথোপকথনে কৃষ্ণপ্রিয়-র সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।

তন্ময়— হিন্দুরা রসুলচর্চার ক্ষেত্রে—মহম্মদের জীবনী বা আল্লাহ নিয়ে লেখার সময় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেছেন এবং ডিসক্লেমার দিয়ে রেখেছেন—যদি কোনো ভুল থাকে, তা যেন শুধরে দেওয়া হয়। অন্য ধর্মের মানুষ প্রবেশ করছে কেন, এই নিয়ে মুসলমান সমাজে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে—এই আশঙ্কা থেকেই কি ডিসক্লেমার দেওয়া?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— আব্দুর রহিমের কথা তো আমি উল্লেখই করেছি। আব্দুর রহিম তাঁর বইয়ের ভূমিকাতে লিখেইছেন, ভুলে ভরা সব। তো আমার সদিচ্ছা আছে, আমি করতে চাইছি, তারপর তুমি যদি বলে দাও ভুলে ভরা, তাহলে তো ঝুঁকি হয়ে যায়। ফলে একটা ভয় তো কাজ করেই।

তারপর, এই যে ছবি বা মূর্তি বা কোনো প্রতিকৃতি—যেন কোনো অবয়ব তৈরি না-হয় কোনোভাবে, কোনো লেখার মধ্যে—সে-খেয়ালও রাখতে হত। ফলে মনের মধ্যে ভয় তো ছিলই। সঙ্গত কারণেই এই ডিসক্লেমারটা দেওয়া হয়েছিল। সেটাতেই রুক্ষ্মিণীবাবুর বইতে একজন মুসলমান অধ্যাপক এই কথাগুলো মাথায় রেখেই লিখেছিলেন ওই ভূমিকাটা। তিনি মুসলমান বাঙালি। ইসলামিয়া কলেজেরই অধ্যাপক। তিনি লিখেছিলেন, মুসলমানরা তো মহম্মদের জীবনী নিয়ে কাজ করবেই। কিন্তু হিন্দুরা লিখতে এসেছে, এটার কৃতিত্ব ওদের থেকেও বেশি। এই যে ডিসক্লেমার, এর কারণ ওই ভদ্রলোক জানতেন, এ-ধরনের সমালোচনা হয় বা হিন্দুদের মধ্যে ভয় আছে। এই কথাটা বলার মধ্যে একটা উদারতাও ছিল।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — প্রথম পর্ব

তন্ময়— এই কথাটা থেকে আমার পরের প্রশ্নটা মাথায় আসছে। আপনার বইয়ে একটা জিনিস প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, উনিশ শতকে সাধারণ মুসলমান জনমানসের মধ্যে তথাকথিত শিক্ষার হার হিন্দুদের তুলনায় কম ছিল। সেই কারণেই কি হিন্দুরা যেমন ঝুঁকি সত্ত্বেও মুসলমানদের নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার দিকে অগ্রসর হয়েছেন এবং কোনো মুসলমান ভিনধর্মের শাস্ত্রচর্চা নিয়ে আলোচনায় অগ্রসর হননি? নাকি এই কারণটাও হতে পারে যে, তাঁদের সামাজিক গোঁড়ামি সংস্কার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— সামগ্রিকভাবে দুটোর দর্শন তো আলাদাই। একটাতে মূর্তি পুজো হয়, একটাতে হয় না। প্রথমেই ভয়ঙ্কর রকমের একটা অপোজিশন আছে। দু’নম্বর কথা হল, এটা তো সত্যি, ব্রিটিশরা ভারতে আসার পর—তারা হারাল কাদের? তারা তো হিন্দুদের হারিয়ে ভারতে আসেনি। এসেছে মুসলমান শাসকদের হারিয়ে, তাড়িয়েই। ফলে মুসলমানরা ওদেরই শত্রু ভাবল। ফলে ওদের ভাষা শিখব না, এরকম একটা গোঁড়ামি তো ছিলই। এই কথাগুলো আমারও বলার দরকার নেই। ওই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত যে মুসলমান বাঙালি সম্পাদনায় যে-পত্রিকাগুলো বেরোত, সেখানে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ছিল। ওরা প্রথম সংখ্যাটাতে একটা সম্পাদকীয় লিখত আর সম্পাদক তার একটা কারণও লিখতেন যে কেন তিনি পত্রিকাটা প্রকাশ করছেন। ওই অংশগুলো পড়লেই বোঝা যায় যে তাদের মধ্যে কী যন্ত্রণাটাই হচ্ছে। পাশাপাশি আমি আর তুমি দু’জনেই বাংলা ভাষায় কথা বলছি। অথচ, আমি অনেককিছু বেশি জেনে ফেলেছি, কারণ আমার পিছনে একটা ইংরাজি শিক্ষার জ্ঞান আছে, জানারও আগ্রহ আছে। আর আরেকজনের কাছে ইংরাজি শিক্ষাটাও নেই, জানার আগ্রহটাও এতটা নেই। এই যে তফাৎটা তৈরি হয়ে গেল, এটা তো মানতেই হবে। বাস্তবতাকে অস্বীকার করলে হবে না। আমি পুরাণের, কোরআনের আমল থেকে আধুনিক কলিযুগে এসে পৌঁছালাম, আমি রাস্তার দু’দিক দেখতে দেখতে আসছি। এবার যে-দৃশ্যগুলি আমার দেখতে ভালো লাগছে না, সেই জায়গাটা যদি আমি চোখ বুজে চলে যাই, তাহলে কিন্তু আমি ইতিহাসটা জানতে পারব না। ফলে যেটা বাস্তব, যেটা সত্যি, সেটাকে আমাকে মেনে নিতে হবে। এটা আমি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি, ওই মুসলমান বাঙালি সম্পাদিত পত্রিকাগুলোতে তারা কী বলেছে। ওখান থেকেই আমি দেখেছি তারা বলছে—‘ওঠো, জাগো, পড়ো। আমরা মিশব কী করে? সাহিত্য মারফতই আমরা মিশতে পারি। আমাদের লেখার সময় হয়েছে। আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে…’ ইত্যাদি ইত্যাদি। 

এই দেশে এত বৃহৎ একটা জনগোষ্ঠী হিন্দু—তাদের মধ্যেও গোঁড়ামি আছে। আবার ভারত যখন অবিভক্ত ছিল, তখন একটা ছোট্ট জনগোষ্ঠী মুসলমান—তাদের মধ্যেও গোঁড়ামি আছে। এখন এই গোঁড়ামির কত পারসেন্ট আমি রাখব আর কতটা ছাড়ব—সেটা নির্ভর করে আমার শিক্ষা এবং অগ্রগতির ওপরে। আমি একটা জায়গায় বদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে সেটা কীভাবে হবে?

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— আমার পরের প্রশ্ন, এই যে হিন্দুরা মুসলমানদের নিয়ে এবং মুসলমানরা হিন্দুদের নিয়ে লিখছেন, তাতে সমাজে একটা সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অবশ্যই উঠে আসছে। কিন্তু আপাতভাবে সমাজে যদি সেই সম্প্রীতির বাতাবরণ না-থাকত, তাহলে এই লেখাগুলো লেখার পরিসরও তাঁরা পেতেন না। সামগ্রিকভাবে দেশভাগপূর্ববর্তী সমাজে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই লেখাগুলো আদৌ কি ভূমিকা রেখেছে? রাখলে কতটা রেখেছে?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— সে-কালের লেখা সে-কালের লোক কতটা পড়েছে এবং পড়ে তারা কীভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছে— সেটা তো একটা আলাদা গবেষণার বিষয়। কিন্তু আমার মনে হয়, সে-কালে বসে এই যে লেখাগুলোর বিষয়বস্তুটা তারা নির্বাচন করছে, সেখান থেকেই বোঝা যায় এইধরনের লেখার প্রয়োজন তারা অনুভব করেছে। তার কারণ তারা বুঝতে পেরেছে, শুধু বিভেদটাই শেষ কথা নয়, ঐক্যটাও ছিল। তা নাহলে বিভেদের মধ্যে এই কয়েনেজটাও হত না আর এই ঐক্যবদ্ধ জায়গাটাতে লেখালিখির মাধ্যমে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করব, সেটাও আর হত না। আমার সবসময় মনে হয় এটা একটা রি-এসস্ট্যাবলিশমেন্ট হচ্ছে। সেটাই কালে কালে হয়ে এসেছে। আমিও তো সেটাই চেষ্টা করেছি নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার। বলছি যে, দেখো ভা,ই আমি যদি আমার লিগাসি দেখি, তাহলে এই ছিল আমাদের ঐক্য। ওরাও, ওদের আগের কালে তাকিয়ে দেখেছে ব্যাপারটা এইরকমই, সবাই তো মারামারি কাটাকাটি করেনি।

ধরো, হুসেন শাহের এক সেনাপতি ছিলে পরাগল খান। পরাগল খানকে হুসেন শাহ বলেন, তুমি চট্টগ্রামে গিয়ে ওই অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা হাতে নাও। তো তিনি যখন ওখান থেকে চলে যাচ্ছেন, তখন খুব মনখারাপ। হুসেন শাহের এখানে যে এত এত মানুষ, এত জ্ঞানীগুণী লোক, তারা আলোকিত করে থাকে রাজসভা, ওখানে একা একা গিয়ে ও কী করবে? যাই হোক, পরাগল খান গেল। ওখানে গিয়ে এক কবিকে আবিষ্কার করল। তার নাম কবীন্দ্র পরমেশ্বর। পরাগল খান পরমেশ্বরকে বলল, আমাকে বলো, এই যে মহাভারতের ১৮ দিনের যুদ্ধ হল, তাতে কে জিতল, কে হারল ইত্যাদি। তো কবীন্দ্র পরমেশ্বর তাকে বলছে যে হুজুর আমাকে ক্ষমা করেন, এটা আমি আপনাকে বাংলায় বলতে পারব না। কেন? তার কারণ হল, হিন্দু ধর্মে বর্ণিত ১৮টা নরক, তার মধ্যে নিকৃষ্টতম নরক হল রৌরব। এবং এই যে পুরাণ এবং রামায়ণ-মহাভারত— এটা যদি কেউ সংস্কৃত-ভিন্ন অন্য ভাষায় শোনেও, তাহলে সে ওই নরকে পতিত হবে। ফলে, আমি তো আর নরকে পতিত হতে পারব না। তার চেয়ে আপনি বরং সংস্কৃতটা শিখে মহাভারতটা সংস্কৃতে পড়ুন। পরাগল খান তখন বলল, আমি যদি সংস্কৃত শিখি তবে রাজ্য চালাবে কে? আমি হুকুম করছি, তোমাকে কে নরকে পাঠায় সেটা আমি দেখব। তো তখন পরমেশ্বর মহাভারতটা বাংলায় লিখল। পুরোটা লিখতে পারেনি। যতটুকু লিখেছিল সেটাকে বলা হয় ‘পরাগলি মহাভারত’। এই পুথি এখনও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে আছে। ওটাই হচ্ছে সংস্কৃত ভিন্ন অন্য কোনো ভাষায় অনূদিত প্রথম মহাভারত।

এখন এই যে পরাগল খানের মহাভারত পড়ার ইচ্ছে, পরমেশ্বরের অনুবাদ করে দেওয়া— এটা কী? একদিকে আমি যদি মারামারি, দাঙ্গা দেখি, এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমি হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যও দেখব। এবং এ-ধরনের অসংখ্য উদাহরণ ছিল। কাশীরাম দাস যখন লিখতে বসেছে মহাভারত, তাকেও তো শুনতে হয়েছে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরাই ছড়া কাটত, ‘কৃত্তিবেসে, কাশী দেশে এবং বামুন ঘেঁষে/ এই তিন সর্বনেশে’। রামাই পণ্ডিতদের আমল থেকে যদি দেখি, তাহলে এই ইতিহাসই পাব। এরকম উদাহরণ ছিল বলেই সম্প্রীতির ওই ধরনের উদাহরণগুলো এরা টেনে টেনে আনতে চাইছিল। কেউ কালীগান মারফত করেছে, কেউ মহম্মদের জীবনী নিয়ে করেছে। এভাবেই দেখেছে তারা বিষয়টা।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — প্রথম পর্ব

তন্ময়— এই যে উভয় ধর্মের লেখালিখির উদাহরণ আপনি তুলে ধরেছেন, সেটা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। ধর্মের ভিত্তিতে যখন দেশভাগ হল, তখন কি সাময়িকভাবে বা দীর্ঘমেয়াদে এই চর্চায় কোনোভাবে আঘাত লাগল, নাকি বাংলার অভ্যন্তরে এই চর্চা অব্যাহত ছিল?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— আঘাত যে নেমেছে, এটা তো সত্যিই। কারণ, ওই ব্যাপ্তি তো আর রইল না। এই বইগুলো যত সংখ্যক ছাপা হত, সেটা তো পুরো বন্ধই হয়ে গেল…


তন্ময়— এই প্রসঙ্গে আমার একটা অবজার্ভেশন আছে। যে-সব হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম নিয়ে লেখালিখি করে বইপ্রকাশ করেছেন, তাদের সিংহভাগেরই অবস্থান কিন্তু পূর্ববঙ্গে, যেটা মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূমি। তাই তো?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— হ্যাঁ। আমি যাদের নিয়ে কাজ করেছি, তাদের মধ্যে কৃষ্ণকুমার মিত্র কলকাতায় ছিল, বাকিরা সবাই তো পূর্ববঙ্গেই থাকত।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— ফলে এটা কি বলা যায়, তাদের পরিপার্শ্বও অনেকটাই প্রভাবিত করেছিল এই জাতীয় কাজ করার জন্য?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— হ্যাঁ। এবার এই দেশে বসেও তো প্রফুল্লচন্দ্র রায় তো এই কথাই বলতেন যে এত বিরোধ কেন, এত বিচ্ছেদ কেন? তো সবকিছুই সব কালে সব জায়গাতে ছিল। এখন ঘটনা হল যে, দেশভাগে এই চর্চায় একটা ব্যাঘাত ঘটেছে সেটা তো সত্যি। দেশভাগের পরে বটতলার মুসলমানি পুথিটা পুরোটাই উঠে গেল। চল্লিশের দাঙ্গাতে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যে যে ঘরে ছাপা হত, সেখানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।

প্যারালালি আরেকটা কথাও বলতে হবে। দেশভাগের পরে যে সবকিছু থেমে গেছে, এটাও নয়। এক নম্বর ক্যানিং স্ট্রিট থেকে একটা বই এখনও ছেপে বেরোয়। মুশকিল আসান পুথি। ওই পুথি কিন্তু প্রাচীন পুথি। আমাদের বারো ভুঁইয়ার এক ভুঁইয়া ছিল ঈশা খাঁ। তখন বাংলায় বর্গিদের আক্রমণ। ঈশা খাঁ বৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তার একটা সন্তান হবে। বউ গর্ভবতী। তো ঈশা খান মৃগয়া করতে যাচ্ছে। ওর ছেলের ১৪-১৫ বছর বয়স। তাকে বলেছে, তোমার যদি বোন হয় তবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গলা কেটে মেরে ফেলবে। কারণ বর্গিরা এসে আক্রমণ করে মেয়েটাকে নিয়ে চলে যাবে, সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। তো এরপর মৃগয়ায় চলে গেল ঈসা খান। যখন ফিরছে, তখন দেখছে শহরের লোকজন ভয়ে ভয়ে প্রণাম করছে ওকে। কী ব্যাপার? তো বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে ঈশা খাঁ দেখল মেয়েদের পায়ের একজোড়া জুতো। অর্থাৎ সে-মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। পুথিতে তার কী অপূর্ব বর্ণনা! ঈশা খাঁ তো রেগে আগুন। বউকে মারতে যায়। তো ছেলে এসে বাধা দিয়ে তখন দাঁড়ায়। বোনের গায়ে হাত দিতে দেবে না। ঈসা খান রেগে গিয়ে ভাই-বোন দুজনকেই জঙ্গলে পাঠিয়ে দেয়।

এবার জঙ্গলে গিয়ে কী করবে? খাবার জোগাড় করতে হবে তো। বোনকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে ঈশা খাঁ-র ছেলে শিকারে গেল। বোনকে বলে গেল, কোত্থাও নড়বি না, আমি আবার এই জায়গাতেই ফিরে আসব। এর কিছুক্ষণ পরে এক বুড়ি আসে মেয়েটার কাছে। এসে বলে, এই রাস্তা দিয়ে একটা হিন্দু পরিবারের মড়া যাবে, ওদের থেকে সাহায্য চাইবি। কী সাহায্য? ওই মড়ার সঙ্গে যে-সব হিন্দু বউ যাবে তাদের থেকে পান-সুপুরি চাইতে হবে। আর ৭ জন বউকে লাগবে। ওদের ডেকে একটা ঘটের ওপর রুমাল বিছিয়ে পান-সুপারি রাখবি। আমি মন্ত্র শিখিয়ে যাচ্ছি, এই মন্ত্র দিয়ে ‘আসান বিবি’-র নামে পুজো দিবি। তারপর ঘটটা পুকুরে ভাসিয়ে দিলেই দেখবি সমস্ত দুঃখ কেটে যাবে। তো এসব শোনার পর পাশ ফিরতেই ও দেখছে বুড়িটা আর নেই।

কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যিই মেয়েটা দেখে রাস্তা দিয়ে একটা হিন্দু মড়া যাচ্ছে। ও তাদের কাছে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সাহায্য চেয়েছে। এবার তারাও দেখছে, ফুটফুটে একটা মেয়ে কাঁদছে। ওর কথা শুনে ৭ জন বউ পান-সুপারি নিয়ে, ঘট নিয়ে ওর কাছে এসে বসেছে। আর ওকে যে পাঁচালিটা বুড়ি শিখিয়ে দিয়ে গেছে, সেটা ও পড়তে শুরু করেছে।

এবার আমি আমার মা-কে ওই পাঁচালি এনে দিয়ে বলেছিলাম, লক্ষ্মীর পাঁচালি যে-স্পিডে পড়ো, এটাও সেই স্পিডে পড়ো। দেখি কতক্ষণ লাগে। মা সেভাবেই পড়ল। তাতে সময় লেগেছিল সাড়ে নয় থেকে দশ মিনিটের মতো। যদি ওটা অত স্পিডেই বাচ্চা মেয়েটা পাঁচালিটা পড়ে থাকে তাহলে দশ মিনিট মতো সময় লেগেছে। তো একটা বাচ্চা মুসলমান মেয়ের জন্য ১০ মিনিট ধরে ৭টা হিন্দু বউ নিঃস্বার্থভাবে বসে ছিল, তার পাঁচালি পড়া শেষ হলে রুমালের ওপরে পান-সুপারি দেবে বলে। কারণ ওরা যদি না-দেয়, হাতে নিয়ে বসে না-থাকে, তাহলে এই বাচ্চা মেয়েটার ব্রতটাও সফল হবে না। এখান থেকে একটা সূত্র পেলাম। অর্থাৎ, আসান বিবি এখানে হিন্দুদের ইনক্লুড করে গেল। ৭ জন এয়োস্ত্রী না-বসলে দুঃখ-দুর্দশা ঘুচবে না। তো যাই হোক, ওই ৭ জন বউ নিঃস্বার্থভাবে বসে রইল। মেয়েটা ব্রতটা পুরো করল। তারপর ভাইকে নিয়ে দেশে ফিরে যেতে ঈশা খাঁ ওদের বুকে টেনে নিল। এই যে পুথিটা, এটা কিন্তু এখনো ছাপা হয়।

তো মুসলমানি পুথি নিয়ে আমার এই লেখাটা প্রথম প্রতিক্ষণ ম্যাগাজিনে বেরিয়েছিল ১৯৯৫ সালে। সে-সময় ক্যানিং স্ট্রিটের ওই দোকানে গিয়ে আমি জেনেছিলাম, প্রতিবছর ৫ হাজার কপি করে ছাপা হয় এই বইটা। সেটা আসাম, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যায়। এখন যদি দেশভাগের পরে এই চর্চা সম্পূর্ণভাবে ব্যাঘাত ঘটত বা বন্ধ হয়ে যেত, তাহলে সেমিনার বা গবেষণা বা আলোচনার পরিসরেই সেটা সীমাবদ্ধ থাকত। প্রতিবছর যখন ৫০০০ কপি ছাপা হয় এই পুথি ও সেটা এখনও বহু মানুষ পড়ে, তাহলে এখনও কোথাও কোথাও এই প্র্যাকটিসটা চলে। ৭টা না-হলেও অন্তত একজন বা দু’জন হিন্দু বউকে জোগাড় করে। অর্থাৎ, ভিন ধর্মের মানুষকে ইনক্লুড না-করলে, আমার প্র্যাকটিসটা করলেও আমার কোনো লাভ হবে না—এই ঐক্যের উদাহরণ কোনো সেমিনারেই ধরা পড়বে না।

এরপর আরও একটা কথা বলি। আমার কাছে একটা বটতলার মুসলমানি পুথি আছে। পুথিটার নাম ‘সাপের মন্তর’। ভূতে ধরা, সার বন্ধ করা, সাপে কাটা— এইসব ব্যাপার নিয়ে মোট ৯৫টা মন্ত্র আছে এই বইটাতে। এই ৯৫টা মন্ত্রের মধ্যে ৪৮-৫০টা মন্ত্র শুধু আছে রামের নামে, সীতার নামে। একটা মন্ত্রে বলা হচ্ছে, ‘আমার এ আজ্ঞা শীঘ্র লাগ, শীঘ্র লাগ, শীঘ্র লাগ/ খোদার দয়ায়, শ্রীরামের আজ্ঞায়’। এবার বলো একজন মুসলমান কি শুনবে, তাকে যদি ‘শ্রীরামের আজ্ঞায়’ বলা হয়? কিন্তু সে তো শুনেছে। এটাই প্র্যাকটিস করছে। এই বই তো মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হত বটতলা থেকে।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: বিশ্বজিৎ রায় — প্রথম পর্ব

তন্ময়— বর্তমানে উভয় ধর্মের আদানপ্রদান—হিন্দুরা মুসলমানদের নিয়ে, মুসলমানরা হিন্দুদের নিয়ে লিখছেন, এর একটা উদাহরণ হিসাবে আপনি কবীরের (কবীর সুমন) কালীগানকে তুলে ধরেছেন। এর বাইরে আর কী কী চর্চা হচ্ছে, যা আপনার চোখে পড়েছে? নাকি বর্তমানের দিকে এগোতেই চাননি?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— না, আমি সত্যিই এগোতে চাইনি। কালীচর্চা নিয়ে আরও অনেক লোক লিখছে হয়তো। ডেফিনিটলি লিখছে। এবং আমাদের পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে যে লোকসংস্কৃতির প্র্যাকটিস যেগুলো এখনও ঘটে, সেখানে তো কারবালার গান বা বিয়ের গানে— অনেক অনুষ্ঠানের মধ্যেই এই উপাদানটা খুব ভালোভাবেই আছে। আমি ওদিকে যাইনি। কিন্তু আমার একটা আক্ষেপ আছে। এই যে তুমি যে প্রশ্নটা কিছুক্ষণ আগেই করলে, এর মধ্যে আমার উত্তরের একটা অংশ আছে। হিন্দুরা যেখানে মোটা মোটা বই লিখে ফেলেছে, সেখানে মুসলমানরা ভক্তির জায়গা, সাধনার জায়গা, সাধকের মন থেকে কিছু গান লিখেছে, কেন? এখন হিন্দুরা যেসব বই লিখেছে, তার শুরুতে ‘আমার কৈফিয়ৎ’ বলে একটা অংশ লিখেছে। বইটা কেন লিখছে, সেটাই ভূমিকাতে জানিয়েছে তারা। কিন্তু মুসলমানরা তো সেটা করেনি। পাগলা কানাই গান গাইছে, হাসান রাজা গান গাইছে, আলি রাজা পয়ার ছন্দে লিখছে, এরা সেই কর্মটা করেনি। এমনকি নজরুলও লিখেছেন, কিন্তু কেন লিখছেন, সেটা কাউকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আমি হাতের কাছে একজনকে পেয়েছি যে এই জিনিসটা লিখেছে, এখনও লেখে। কোন ধারণা থেকে, কোন জায়গা থেকে এটা হয়— সেইটা জানার জন্যই কবীরের ওইটুকুই আমি ধরেছি।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: বিশ্বজিৎ রায় — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— ২০১৪-পরবর্তী ভারত এই সম্প্রীতিকে কী চোখে দেখছে? আপনার লেখার মধ্যে অন্তঃসলিলভাবে যে বক্তব্য বয়ে গেছে—বর্তমান ভারতে সম্প্রীতির সংকট দেখা দিয়েছে, সেখানে এই ভাষ্যগুলোকে বার বার তুলে আনা দরকার। ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক বা ধর্মীয় পরিস্থিতি—সেখান থেকে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদ এই সম্প্রীতির উদাহরণগুলোকে কী চোখে দেখবে?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— গোঁড়া হিন্দুত্ববাদ কি আর এই জিনিসগুলোকে ভালো চোখে দেখবে? আমার মনে হয়, গোঁড়া হিন্দুত্ববাদের জবাবটা কিন্তু গোঁড়া হিন্দুত্ববাদের মধ্যেই আছে। কোনো সম্প্রীতির প্রসঙ্গ না-টেনে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদের মধ্যেও পাওয়া যাবে ওদের কাউন্টার করার মতো কথা। ওই জায়গাগুলো খুঁজে বার করা দরকার। আমরা কী করি? সম্প্রীতির ব্যাপারগুলো মুখে বলে বেড়াই আর মনের মধ্যে আরেকটা ধারণা পুষে রাখি। আমি বলছি তো, আমরা অর্ধেক বুঝি বিবেকানন্দ, খানিক বুঝি বঙ্কিমচন্দ্র, আর কিছুই বুঝি না রবীন্দ্রনাথ। আমরা এই বাঙালিদের নিয়েই চিৎকার করি। বঙ্কিমচন্দ্র কেন ‘বন্দেমাতরম’ বলল, কেন ‘মা’ ডাকল দেশটাকে—সেই ব্যাখ্যাও এদের কাছে স্পষ্ট নয়। আর ওই ‘দেশমাতৃকা’-কে সন্তান হিসাবে আমি কীভাবে সার্ভ করছি, ‘মা’-এর প্রতি আমার কী কর্তব্য—সেই ব্যাপারেও আমার কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই, ওই নিয়ে আমার জানার ইচ্ছেও নেই, আমি শুধু মারতে শিখেছি, যে ‘মা’ বলবে না তাকে গিয়ে আমি মেরে ফেলব। আবার আরেক দল যারা এটা বলবে না, তারাও এর বিপরীত ধর্মটা পালন করছে।

এই জুন মাসের ১০-১২ তারিখের ঘটনা। গুজরাটে এক জায়গায় ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল উচ্চবর্গীয়দের। একজন দলির কিশোর বাউন্ডারিতে বসে খেলা দেখছিল। ছেলেটার কাছে বল যেতেই বলটা ও ধরে ফেলে। তার শাস্তি হিসাবে ওর কাকার বুড়ো আঙুল কেটে নেওয়া হয়। এই তো ভারতবর্ষ। মিনিবাসের কন্ডাকটররা যেমন বলে, পিছনের দিকে এগিয়ে যান। আমাদের এগিয়ে যাওয়াটাও তেমন ক্রমশ পিছনের দিকে। আর করার আছেটা কী? আমার সামনে কটা উদাহরণ আছে। আমি বড়োজোর আস্ফালন করতে পারি, দেওয়াল মাথা ঠুকতে পারি আর বলতে পারি, ‘দেখ এরকম করিস না। আমরা এরকম না। আমরা এইরকম ছিল।’ আর এই উল্টোটা কীরকম হয়? যে বলা হয়, দেখেছিস হিন্দুর বাড়িতে মুসলমান রাঁধুনি বিরিয়ানি রান্না করে দিচ্ছে, বিয়েতে বিসমিল্লার সানাই বাজছে। এতেই আমরা এত আহ্লাদিত, এতটাই শ্লাঘা— এতেই আমরা চোখ বুযে রইলাম। তারপর গিয়ে মধ্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে তুই আমাকে গরু খাওয়াবি, আমি তোকে শূকর খাওয়াব—হয়ে গেল সম্প্রীতি। কেউ গরু খেল কি শূকর খেল—তাতে সত্যি কি কিছু যায় আসে? আমার ভেতরে কী রইল?

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: অলোক সরকার — প্রথম পর্ব

তন্ময়— অস্থিরতার সময় প্রায়ই একটা কথা উঠে আসে, তুমি হিন্দু বা তুমি মুসলমান—আমার দেবদেবীদের নিয়ে কথা বলার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে? কে দিয়েছে? আপনার কী মনে হয়?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— আমাকে এইটা বলার অধিকারটা কে দিয়েছে? এটা আমার প্রথম প্রশ্ন। জ্ঞানের অনেকগুলি শাখা আছে। তার মধ্যে একটা শাখায় বিচরণ করতে পেরেছি। সব শাখায় পারিনি। তো যেটুকু পড়েছি, তাতে বিচার করতে শিখেছি, বুঝেছি। সেটা তো আমার মত, সেটা তো আমার বোঝা। সেইটাও তো আমি বলব। শুধু তুমি বলবে আমি চুপ করে শুনে যাব কেন? তোমাকেই বা এই অধিকারটা কে দিল? আমি হিন্দু, সেটা গর্ব করে বলার কী আছে? আমি তো বাই ডিফল্ট হিন্দু হয়েই জন্মেছি। আমি তো একটা টিকটিকি হয়েও জন্মাতে পারতাম, একটা আম গাছ হয়েও জন্মাতে পারতাম। আমি যে একটা হিন্দু বাঙালি পরিবারে জন্মেছি, সেটার পিছনে তোমার কী ভূমিকা রয়েছে, যে এই প্রশ্নটা উঠছে? এই প্রশ্ন করার অধিকারটা কে দিল? গণতন্ত্রের এই পরিসরটা আমাকে কে বলবে? ইউরোপ অন্ততপক্ষে এটা তো করতে পেরেছিল। ওদেরটা সত্যিকারের রেনেসাঁ। আমাদের নবজাগরণটা ঢপ। ওরা সমাজ থেকে ধর্মটাকে আলাদা করতে পেরেছিল। ধর্মটাকে রাস্তায় টেনে নামিয়ে সোশ্যাল প্র্যাকটিস করতে পারবে না।

আমার চোখ খুলেছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার পর পরই। তার ঠিক পরের বছরই আমি দিল্লি গেছি। কাজের সূত্রেই। লালকেল্লার সামনে থেকে টাঙ্গায় উঠেছি। একটা বুড়ো লোক। নাম রামসেবক। তা সে আমাকে খুব আদর করে ‘বাবু’ বলে ডাকছে। এই ‘বাবু’ মানে বাবু নয়, ছেলে অর্থে। জানা গেল ওর ছেলে, প্রায় আমার বয়সিই, মদ খেয়ে মরে গেছে। তো ওকে কথা হতে হতে বললাম, তুমি তো রামসেবক। রামের নামেই সবকিছু চলছে এখন। ও ইনস্ট্যান্টলি ঘোড়াটাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আমাকে বলল, আমি এই বুড়ো বয়সেই পরিশ্রম করে খাই বাবু। ওই পয়সা দিয়ে আমি খাই আর তারপর রামকেও খাওয়াই। রামের নামে আমি খাই না। ভারতবর্ষটা এখনও টিকে রয়েছে এই লোকগুলোর জন্য, অ্যাকাডেমিক্সের জন্য নয়। সব যদি অশিক্ষিতই হয়, অশিক্ষার মধ্যেও যদি এই স্বাভাবিক শিক্ষাটা থাকে, তাহলে বিবাদ নেই তো। হিন্দুদের শাস্ত্রে একটা কথা বলা হয়, অবিদ্যা। আমরা যে পড়াশোনাটা করি, সেটাকে বলা হয় অবিদ্যা। বিদ্যা হল পরাবিদ্যা। ওটাই আসল বিদ্যা।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: অলোক সরকার — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— আমরা দিনে দিনে দেখতে পাচ্ছি, বাংলার মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি যেমন আছে, তেমনই বাংলায় একটা অংশে ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক হিংসা, হিন্দুত্ববাদ—এই চিন্তাগুলোও ক্রমশ প্রবেশ করছে বিগত ১০ বছর ধরে। এবং সেটা স্পষ্টতই দৃশ্যমান। বিদ্যাচর্চার পরিসরে এই যে সম্প্রীতির উদাহরণগুলো তুলে আনা—এগুলো কি সামাজিক স্তরে সত্যি সম্প্রীতির আবহ গড়ে তুলতে পারে? একশো বছর আগে যে চেষ্টাটা তাঁরা করেছিলেন, তাঁরা কতটা সফল হয়েছিলেন? আর আজকের দিনে সেটা কতটা সফল হবে এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— আদৌ কি করতে পারে? পারে কি? এই প্রশ্ন আমারও জাগে। আপনি তো বেলঘরিয়া নিয়ে বই লিখেছেন। কলোনিটা কী, আপনি তো জানেন। সত্তর দশকে এক একটা কলোনিকে লাল দুর্গ হিসাবে গড়ে তোলা হবে বলে ঠিক করা হয়েছিল। সেই কলোনিতে এমন কি ঘটনা ঘটল যে সেই কলোনিগুলোতে লাল দুর্গ না-হয়ে এখন হনুমান মন্দির তৈরি হচ্ছে? কী কারণে? আমার বাড়ির সামনে একটা ব্যায়ামাগার ছিল। ক্লাবটার নাম অগ্রদূত ক্লাব। সেই ক্লাবের সামনে এইবছর থেকে শুরু হল সর্বজনীন হনুমান পুজো। অগ্রদূত ক্লাবের সামনে যেহেতু, তাই তার নাম রাখা হয়েছে রামদূত ক্লাব। ওখানে তো বিজেপি নেই। আগে সিপিআইএম জিতত, এখন তো সবটাই তৃণমূল। তবে ওখানে এটা হতে পারল কীভাবে? ভোটের পার্সেন্টেজ দেখলে দেখা যাবে তৃণমূলেরই বেশি। তা সত্ত্বেও কীভাবে এই পরিবর্তনটা সম্ভব হচ্ছে? আমার এই জায়গাটাতেই মনে হয়, যার যার যা যা শক্তি, তা নিয়েই প্রত্যেককে বাঙ্ময় হতে হবে। আমি তো শারীরিকভাবে অক্ষম, আমি কিছু পারবও না। ফলে আমার মনে হয়, এতদিন ধরে আমি যেগুলো দেখছি, যে-কটাদিন বেঁচে আছি সেগুলোই লিখে যাই। যদি দশটা লোকও অন্তত পড়ে। অন্তত পড়ে জানুক, ব্যাপারটা এইরকমও ছিল। ওইটুকুই আমার ক্ষীণ আশা।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — প্রথম পর্ব

তন্ময়— একটা তথাকথিত ন্যারেটিভ প্রচলিত আছে, হিন্দুরা অপেক্ষাকৃত সহিষ্ণু এবং মুসলমানরা অসহিষ্ণু। এবং একইরকম কথা সমাজ মাধ্যমের পাতায় ঘুরে বেড়ায়। যে, হিন্দুর দেবদেবীদের নিয়ে ঠাট্টা করছ, কিন্তু পারবে মুসলমানদের আল্লাহকে নিয়ে ইয়ার্কি-ফাজলামি করতে? কিন্তু আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস বা সংস্কৃতিচর্চার ইতিহাস ঘাটতে গিয়েই দেখেছি হিন্দুরা তাদের দেবদেবী নিয়ে কি অনায়াস রসিকতা, ঘরের লোকের মতো আপন করে নিয়েছে ঠাট্টা-তামাসা করেছে, বন্ধুর মতো মিশেছে। সেই পরিসরটা তো ধ্বংস হচ্ছেই। সেইসঙ্গে উঠে আসে—হিন্দুর দেবদেবী বলেই ঠাট্টা করা যায়, মুসলমানদের কিছু হলে ঠাট্টা করা যায় না। এটার সত্যতা কতটুকু?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— এটার একটা দিক হল যে ইসলাম ধর্মের তো ‘বিধর্মী’, ‘কাফের’ বলে শব্দগুলি আছেই। ফলে কেনই বা আমি বলতে যাব, শুধু শুধু গোলমাল পাকিয়ে লাভ কী? যে-কারণে ওই ডিসক্লেমারগুলো থাকত। এবার যদি হিন্দুদের কথায় আসি। গোপাল। ভাবো দেখি, কৃষ্ণ এত বড়ো একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ। কিন্তু সে তো বাঙালির ঘরে ঘরে গোপাল হিসাবে পূজিত। সবার বাড়িতে এইটুকু একটা মূর্তি, জামাকাপড় নাই, হাতে নাড়ু ধরে বসে আছে। তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে, স্নান করিয়ে, কত ঠাট্টা-ইয়ার্কি। আমার মা-ঠাকুমা তাকে নিয়ে কত কী করত। সেই আদি গোপালটা এখনও আমাদের বাড়িতে আছে। গোপালের বনভোজনও হয়। কলোনির সবাই নিজেদের বাড়ির গোপাল নিয়ে জড়ো করল এক জায়গায়, রান্নাবান্না হল, গোপালকে খাওয়াল, নিজেরাও খেল। তার মানে কী? শীতকালে আমি বনভোজন করব, সেখানে গোপালকে ইনক্লুড করে নিলাম যে নিমাই আমার। তেমনই রামকেও আলাদা করে সম্মান করতে হয়নি আমাদের। তাবলে কি রামকে অসম্মান করেছি? কিন্তু ‘হে রাম, ছি ছি ছি’—এই কথাটা কি আমরা বলতাম না? তার মানে কি রামকে অসম্মান করছি? রামকে আমার গুণেও লাগত। এক রাম, দুই রাম… রাম ছিল ইউনিট। তো আমার তো কোনোদিন প্রয়োজন পড়েনি তাকে নিয়ে দাঙ্গা করার, সে-ই সত্য বাকি সব মিথ্যা— এটা বলার। আমরা বন্ধুর মতো দেখতাম বলেই এটা করতাম। এখানেই ব্রাহ্মণ্যবাদ সর্বনাশটা করে। তা না-হলে চৈতন্যদেবের দরকার পড়ত না তো। যেমন ওদিকে শরীয়তি, তেমনই এদিকে সনাতনী। কাউকে ঢুকতে দেবে না, শিকল তুলে রেখে দিয়েছে। সেখানেই চৈতন্যদেব রাস্তায় নেমে বলছে, যতদূর এই নাম পৌঁছাবে ততদূরই মানুষের মুক্তি। ইষ্টনাম করো, ব্যস। আর কিচ্ছু লাগবে না। সেখানে তো মারামারি, কাটাকাটি, দাঙ্গা করার কিচ্ছু নেই। ভূত তাড়ানো থেকে শুরু করে, বিদ্যুৎ চমকালে, বাজ পড়লে আমরা বলতাম ‘রাম রাম রাম রাম…’।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— আমার শেষ প্রশ্ন হচ্ছে, লক্ষ্মণ সেনের আমল থেকে, প্রায় আটশো বছর ধরে বাংলায় হিন্দু আর মুসলিম প্রতিবেশী। একসঙ্গে বসবাস করে। এই ৮০০ বছরে যেমন বহু সম্প্রীতির উদাহরণ আছে, তেমনই ধর্মীয় বিভেদ, হানাহানির উদাহরণও আছে। সেটা বিভিন্ন সময়ে পাশাপাশি চলতে চলতে, বর্তমানেও দুটো জাতি পাশাপাশি আছে। বর্তমানে নব্যভারতে যে একটা জোয়ার শুরু হয়েছে, সেই জোয়ারের প্রেক্ষিতে বাংলার দিকে তাকালে ভবিষ্যৎ কী দেখতে পান? যে-বাংলা নিয়ে আমরা গর্ব করতাম, বাংলায় এ-ধরনের ধর্মীয় হানাহানি নেই, বাংলায় দুই জাতি একসঙ্গে বসবাস করে। বর্তমান দিক থেকে দেখলে ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো আশঙ্কা জন্মায়? নাকি মনে হয় বাংলা তার নিজস্ব সম্প্রীতির চরিত্রই বজায় রাখবে?

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— ভারতের প্রেক্ষিতে দেখলে, এখনও আশা জাগে। বাংলা সত্যি সত্যিই একটা পৃথক চরিত্রই বটে। কিন্তু তার পাশাপাশি এটাও বলতে হবে, বাংলার এই পৃথক চরিত্রটা বাঙালির ভাষার গুণেই হয়ে আসছে। না-হলে বাঙালি কিন্তু আরএসএস-এর জন্মের আগে থেকেই হিন্দুত্ববাদের প্রচারক।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — প্রথম পর্ব

তন্ময়— উনিশ শতক থেকে আরও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই ব্যাপারটা শুরু হয়েছে…

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত— ঠিক। ২০২৪ সালে গিয়ে তো আরএসএস-এর একশো বছর হবে, কিন্তু আমরা তারও আগে থেকে হিন্দুত্ববাদের প্রচার করেছি। কিন্তু এদেরকেই আমরা মাথায় তুলে রেখেছি, গলায় মালাটালা পরিয়ে। তো তার পরেও যখন তারা দাঁত ফোটাতে পারেনি, তখন আমার মনে হয় না একদল রাজনৈতিক লোক এসে দাঁত ফোটাতে পারবে বলে। দিনের শেষে গিয়ে বাংলার সাধারণ মানুষের মুখগুলোর দিকে তাকালেই আমার আশা জাগে…

(শেষ।)

অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই


Powered by Froala Editor