ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — প্রথম পর্ব

সুপ্রিয় চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৬ সালে, কলকাতার গড়পাড়ে। পরবর্তীকালে পার্ক সার্কাসের বাসিন্দা। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্রোহজ’, যা প্রকাশ পাওয়ামাত্রই পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায়। তার পরে লিখেছেন একাধিক উপন্যাস ও গল্প। ২০২১ সালে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনে শহিদদের স্মৃতিতে নির্মিত বেদি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করেন সুপ্রিয়, যা পরবর্তীকালে ‘স্মৃতি বিস্মৃতির শহিদ বেদি ৭০’(প্রকাশকাল মে ২০২২) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বর্তমান কথোপকথনটি আবর্তিত হয়েছে সেই বইটিকে কেন্দ্র করেই। কথোপকথনে সুপ্রিয় চৌধুরীর সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব।


তন্ময়— প্রথম প্রশ্নের হাত ধরেই সরাসরি বিষয়ে ঢুকে যাই। আপনি প্রাথমিকভাবে ফেসবুকে টালিগঞ্জের ‘রিট্রিট’ বাড়িটা নিয়ে লিখলেন, তারপর ক্রমে ধারাবাহিকভাবে শহিদ বেদি নিয়ে লেখালেখির কাজে প্রবেশ করলেন। সত্তরের শহিদ বেদিগুলি ডকুমেন্টেড করার ভাবনা আপনার মাথায় এল কীভাবে? এটা কি দীর্ঘদিনের লালিত কোনো চিন্তা, নাকি রিট্রিটের সূত্রেই উঠে আসা?

সুপ্রিয় চৌধুরী— শুধুমাত্র রিট্রিটের সূত্রে একেবারেই নয়। আমি বিভিন্নসময় বিক্ষিপ্তভাবে লিখেছি ওই জায়গাগুলো নিয়ে। টুকরো-টুকরো করে এসেছে। সেইসময়ের নকশাল আন্দোলনের শহিদদের তালিকাটা যদি আপনি দেখেন, মানে সবমিলিয়ে যাঁদের নাম বেরিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, দেখা যাবে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের অধিকাংশেরই বয়স ছিল ১৫ থেকে ২৮-এর মধ্যে। খুব বেশি হলে ৩০। আমাদের সেইসময়ের নেতৃত্বের সর্বোচ্চ দুজন লোক মারা গেছেন যথাক্রমে ৫২ ও ৫৬ বছর বয়সে। সার্বিকভাবে, বয়সটা সবারই খুব কম ছিল। এই কাজটা করতে গিয়ে মনে হয়েছিল, যাঁরা তখন ১৫, তাঁদের সবারই এখন ৬৭-৬৮ বছর বয়স। এঁরা তো কেউ-ই আর বেশিদিন থাকবেন না, সময়ের নিয়মেই চলে যেতে হবে। সুতরাং, বড়োজোর ১২-১৩ বছর আর। তার মধ্যে অনেকেরই শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। এই কাজটা করতে গিয়েই এটা আমার মাথায় স্ট্রাইক করে যায়। সেখান থেকেই মনে হয়, এই বেদিগুলোও হয়তো আর থাকবে না। কারণ, এগুলো তো কোনো সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষের নয়, যে, প্রচুর ক্যাডার রয়েছে, লোক রয়েছে, অফিস রয়েছে!  আর এই বেদিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো বিশেষ কোনো লোকই নেই আর। খুবই করুণ অবস্থা। 

এখন একজন-দুজন রয়েছেন, কেউ মারা গেছেন, অনেকের শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে, তাঁরা পাড়ায় থেকেও কিছু করতে পারবেন না। অনেক জায়গায় এলাকাটাই খালি হয়ে গেছে। যেমন, যেটা দিয়ে আমার প্রথম কাজ শুরু হয়, কলেজ স্ট্রিটের মোড়, মণি দত্ত লেন, সেখানে পাড়াটাই আর নেই। আজকে কল্পনাও করা যায় না, ওই গলিটার মধ্যে একসময় মিলিটারিরা নাকি ঢুকতে ভয় পেত। সেই পাড়াটাই নেই! পুরোটাই প্রেসের দখলে চলে গেছে। প্রেস, ছাপাখানা, গোডাউন— পাড়ার বাসিন্দারা চড়া দামে বড়ো-বড়ো বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছেন। এককালে ভবানী দত্ত লেনের নাম শুনলে পুলিশের হৃদ,কম্প হত। এইসব থেকেই মনে হল, লিখে রাখার মতোও কেউ নেই আর। তাও আমি লিখলাম বলে, কিছু-কিছু জরাজীর্ণ বেদির আবার সংস্কার হল। 

মোদ্দায়, অনেকদিন ধরে মাথায় এটা ঘুরত এই কাজটার কথা। রাস্তার ধারে জীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে, এমন অনেক বেদির খবরই আমি রাখতাম।

পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — প্রথম পর্ব

তন্ময়— আপনার ধারাবাহিক, যেটার ওপর ভিত্তি করে বইটা গড়ে উঠল, পুরোটাই আপনি ফেসবুকে লিখে গেলেন। কোনো পত্র-পত্রিকায় নয়। অথচ, সোশ্যাল মিডিয়ার বহু ভালো-মন্দ দিক, লেখা চুরি হওয়ার ভয় ইত্যাদি রয়েইছে। আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ধারাবাহিক লেখাকে কী চোখে দেখেন? তাতে কী উপকার বা অপকার হল?

সুপ্রিয় চৌধুরী— আমি ‘দ্রোহজ’ উপন্যাসটি লেখার পর টুকটাক লেখালেখি করেছি বিভিন্ন জায়গায়। ফলে, প্রকাশক বা ছাপার লোক পেতে আমার খুব একটা অসুবিধা হয় না। এই ধারাবাহিকটাও যখন আমি আরম্ভ করে ফেলেছিলাম, দুটো পর্ব বেরোনোর পরেই একটি পত্রিকা থেকে বলে যে, আপনার এই লেখাটা আমাদের এখানে দিতে পারেন। তাতে হয়তো আমার খানিকটা টাকা-পয়সার সুরাহা হত। আমি ভেবে দেখলাম, পত্রিকায় বেরোলে অনেক লোকের কাছেই পৌঁছাবে না। মনে হল এটা ফেসবুকেই দিই, তাতে অন্তত বহু লোকে পড়বে। সেইসঙ্গে বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ—নকশালবাড়ি। ব্যক্তিগতভাবেও আবেগের জায়গা। সেই জন্যই ফেসবুকে দিলাম। তাতে লাভই হল। বহু মানুষ পড়লেন। আর তার থেকেও বড়ো কথা হচ্ছে, যাঁরা আমার চেনা-জানা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের লোক, গণ-আন্দোলনকর্মী, তাঁরা অনেকটা লাভবান হলেন। আমি তো হঠাৎ লেখক-হয়ে-যাওয়া ৬৭ বছর বয়সি একজন, এই ধারাবাহিকের হাত ধরে বিশেষ এক পাঠকশ্রেণি তৈরি করতে পেরেছি। এটা আমার একটা সাফল্য বলেই মনে করি। আর কিছুর দরকার নেই। 

আমি তো বাণিজ্যিক পত্রিকাতেই বেশি লিখি, লিটল ম্যাগাজিনে বিশেষ লিখিনি। প্রথম কথা, আগে লিখিইনি। আমার লেখা যাঁরা পড়েন, তাঁদের কেউ কেউ কলেজ স্ট্রিটের শহিদবেদিটি সংস্কারের সময় বলেছেন, ‘বলুন কী দিতে হবে, কোথায় দিতে হবে?’ আমি বললাম, থাক লাগবে না, আমরাই চাঁদা তুলে করে নেব। মোদ্দা কথায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রের পাঠকরা সাড়া দিলেন। এটাই সবচেয়ে বড়ো লাভ আমার। আমার চেনা-পরিচিত, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বন্ধুরা, বা ‘দ্রোহজ’ থেকেই যাঁরা খেয়াল রেখেছেন, তাঁরা তো ছিলেনই। তার সঙ্গে মেইনস্ট্রিমের পাঠকরাও এটার সঙ্গে সাংঘাতিকভাবে জড়িয়ে গেলেন। এটা লাভই। আমার কোনো লোকসান হয়নি।


তন্ময়— এবার বই পড়ে জন্ম নেওয়া বেশ-কিছু প্রশ্ন করতে চাই। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেই কম-বেশি সমাজবিরোধীরা থাকে। কংগ্রেসে ছিল, সিপিআইএম-এ ছিল। সিপিআই (এমএল)-এ কি এ-ধরনের কোনো সমাজবিরোধী ছিল না?

সুপ্রিয় চৌধুরী— হ্যাঁ, হ্যাঁ, প্রচুর, প্রচুর। আমার ‘দ্রোহজ’ উপন্যাসটি পড়লেও সেটা আপনি বুঝতে পারবেন। তবে তার মধ্যেও বেশ-কিছু লোক ছিল, যারা পরবর্তীতে নব-কংগ্রেসে ভিড়ে গিয়েছিল। প্রচুর কমরেডদের ধরিয়ে দিয়ে, ক্ষতি করেছিল, প্রচুর বধ কাজ করেছিল পাড়ায় পাড়ায়। এমনকি কংগ্রেসি গুন্ডাদের থেকেও বেশি অত্যাচার করেছিল।

পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— তারা কি সবাই পার্টির সদস্য ছিল?

সুপ্রিয় চৌধুরী— আমাদের মতো লেভেলে পার্টির সদস্য বলে কিছু ছিল না, সব সমর্থক। দু-তিন বছর হইচই করতে করতে কেটে গেল। বাকি তিন বছর সিআরপির বিরুদ্ধে ঘেরাও সামলাতে সামলাতে কেটে গেল। বাকি সময়টা লাল-তেরঙ্গা-গেরুয়া সকলের সঙ্গে লড়তে লড়তে সময় কেটে গেল। পার্টিতে সকলেই তখন সমর্থক, তার মধ্যে প্রচুর সমাজবিরোধীও ঢুকে পড়ে। তারা ছিল মূলত তিন ধরনের। একদল সত্যিই নটোরিয়াস, মানে দুর্বৃত্ত। আরেকদল আছে এর মাঝখানে, তারাও পরবর্তীতে কংগ্রেস-টংগ্রেসে ভিড়ে যায়, কিন্তু কোনোদিন নকশাল আন্দোলনের কোনো ক্ষতি করেনি। বদলে সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছে, এমন বহু ঘটনা আছে। 

বর্তমান প্রদেশ কংগ্রেসের দু’জন লিডিং নেতা, তাদের নাম আমি করছি না, একজন তো সর্বময় কর্তা, আরেকজন তার থেকে খানিক ছোটো, বর্তমানে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন—এরাও বেসিক্যালি স্ট্রং ম্যান। সেইসময়টায় দীর্ঘ জেল-টেল খেটেছেন। এঁরা কোনোদিন নকশালপন্থীদের কখনো কখনো ক্ষতি করেননি, অদ্ভুত একটা শ্রদ্ধার ভাব আছে তাঁদের। এমনকী নকশালপন্থীদের বহু পত্রিকা-টত্রিকাতেও পরবর্তীকালে লিখেছেন। 

এরকম পাড়ায় পাড়ায় প্রচুর ছিল। একটা পার্টি গঠিত হওয়ার আগেই যখন ভেঙেচুরে গেল, পার্টিও তাদের সেই ট্যাকলটা দিতে পারেনি। আর রাজনীতি করা ছাড়াও বহু লোকই তো ভিড়ে গিয়েছিল! তখন যত অল্পবয়সি যত ছেলে— ১৪-১৫-১৬ বছর বয়স— তাদের খুব বেশি রাজনৈতিক জ্ঞান থাকারও কথা নয়। ফলে, যেটা হওয়ার সেটাই হল। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অনেকেই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু নকশালপন্থীদের ক্ষতি করেননি। আর তৃতীয় দল— তাঁরা নিঃসংকোচে প্রাণ দিয়েছেন, অন্যতম অগ্রণী যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন এবং নিজেদেরকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন, এই সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। মানে লুম্পেন-প্রলেতারিয়েত থেকে মানে পারফেক্ট প্রলেতারিয়েতে পরিণত হয়েছিলেন তারা। তিনটে ভাগ।


তন্ময়— আপনার ‘পাতালপুরাণ’ পড়ে আরেকটা টার্ম পেয়েছি আমরা—‘কংশাল’। আগে কংগ্রেস ছিল, পরে নকশাল।

সুপ্রিয় চৌধুরী— এটা মূলত সিপিআইএম-এর দেওয়া নাম। সিপিআইএম পরে ওইভাবে ব্যাপারটা হাজির করেছিল। ওই ব্যাপারটাকে বরাবর খুব ম্যালাইন করার চেষ্টা করেছিল সিপিএম। তবে হ্যাঁ, কংগ্রেসের থেকে তো কিছু মানুষ ভিড়ে গেছিল সত্যিই, এরাই পরবর্তীকালে ‘কংশাল’ হিসাবে পরিচিত হয়েছিল।


তন্ময়— পরের প্রশ্নটার আগে একটু ভূমিকা বলি। সেটা হচ্ছে, আমি ‘বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে’ বলে একটা বই লিখেছিলাম। সেই বইটায় ১৯৫০-৫৫ সাল পর্যন্ত বেলঘরিয়ার ইতিহাস ধরা আছে। কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন গবেষণার জন্য পরবর্তী সময়ের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। তাতে দেখেছি, নকশাল আমলে বেলঘরিয়ায় মাত্র দু-তিনটে উল্লেখযোগ্য অ্যাক্টিভিটি চিহ্নিত করা যায়। একটা হচ্ছে, বেলঘরিয়া হাইস্কুলের সামনে সিপিআইএমের একটা মিছিলের ওপর নকশালরা আক্রমণ করেছিল। আরেকটা হচ্ছে, বেলঘরিয়ার প্রফুল্লনগরে সিসিআর ব্রিজের ওপরে ছিল নকশালরা, আর নিচে ছিল সিপিআইএম। সারা বিকেল-সন্ধ্যা গুলির লড়াই চলেছিল এবং তিনজন সিপিআইএম কর্মী হত হয়েছিলেন। বেলঘরিয়ায় এর থেকে বেশি নকশাল আন্দোলনের অ্যাক্টিভিটি লক্ষ করা যায় না। এই নিস্তরঙ্গতার কারণ আপনার মতে কী?

সুপ্রিয় চৌধুরী— একটা জিনিস আপনাকে মানতে হবে, বেলঘরিয়া কিন্তু একচ্ছত্রভাবে নকশালপন্থীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়নি। দু’দিকে দুটো সলিড দল ছিল। একটা ননী সাহার দল, মানে সিপিআইএম। আরেকদিকে ইনু মিত্র—ইনু মিত্তির, কংগ্রেসের। যখন সিপিআইএম ভেঙে গেছে, কোঅর্ডিনেশন কমিটি হয়েছে, সেই অবস্থাতেও, ইনু মিত্রের সঙ্গে কলোনি এলাকায় অ্যাকশনে কোঅর্ডিনেশন কমিটির প্রথম শহীদ হন বাদল দাস। সুতরাং, বেলঘরিয়া নকশালন্থীদের ‘গড়’ যাকে বলা হয়, তেমনটা কখনোই ছিল না।

পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — প্রথম পর্ব

তন্ময়— সেটাই আশ্চর্য লাগে। একদিকে দমদম, খুব কাছেই কাশীপুর, আড়িয়াদহ, বরাহনগর, দক্ষিণেশ্বর, খড়দহ— আশেপাশের এই বেল্টটা যেখানে নকশালপন্থীদের দখলে ছিল, সেখানে মাঝখানে বেলঘরিয়া জায়গাটা কীভাবে বিচ্ছিন্ন থেকে গেল?

সুপ্রিয় চৌধুরী— যেমন যাদবপুর। যাদবপুরও কিন্তু তাই। যাদবপুরের একটা অংশ যদি আপনি দেখেন, এইভাবে বেলঘরিয়াটা বুঝতে সুবিধা হবে। মানে ৮বির ফুট, আর ৮বির উল্টোফুট— এই দুটোর মধ্যে কিন্তু হেল অ্যান্ড হেভেন ডিফারেন্স ছিল। এই ফুটটা, মানে বিজয়গড়, টালিগঞ্জের অঞ্চল— বাঁশদ্রোণীর আগে পর্যন্ত কিন্তু সিপিএমের দখলে ছিল। আবার উল্টোফুট— ঢাকুরিয়া ও অন্যান্য অঞ্চল ছিল নকশালদের দখলে। আপনি কি বলবেন যে, কী এমন ঘটল যাতে বিজয়গড় আজাদ? অমনটা হয়ে যায় এক-একটা জায়গায়…


তন্ময়— মোদ্দা কথায়, বেলঘরিয়ায় সিপিআইএম আর কংগ্রেসের ভালো হোল্ড ছিল বলেই নকশালরা গেড়ে বসতে পারেনি।

সুপ্রিয় চৌধুরী— হ্যাঁ, সেই কারণেই বেলঘরিয়া নকশালদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠতে পারেনি। আরে আমাদের সময় তো বেলঘরিয়াতেই ইনসেপ করা হত। দমদম দিয়ে গাড়ি গেলে, দেখা হত বেলঘরিয়ার ছেলে-টেলে আছে কিনা। বেলঘরিয়া থেকে পরবর্তীকালে, যারা নকশাল করত, বেশ-কিছু ছেলে সরে এসে আমাদের এদিকে ছিল।


তন্ময়— আপনার বই থেকে জানতে পারছি, কাশীপুর-বরাহনগর অঞ্চলে এক ভদ্রমহিলাকে শিরোশ্ছেদ করে রিক্সায় চাপিয়ে ঘোরানো হয়েছিল। আর দু-এক জায়গায় নকশালপন্থীদের মায়ের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল। বাবাদের ওপর নির্যাতনের উদাহরণ প্রচুর। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার বই-এ যত শহিদের নাম উঠে এসেছে, তাঁদের প্রত্যেকেই পুরুষ। নারীরা কি নকশাল আন্দোলনের সময় প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নামেননি? তাঁদের কেমন ভূমিকা ছিল?

সুপ্রিয় চৌধুরী— না, না, প্রচুর নেমেছে। নামেনি তা নয়। নকশাল আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের উদাহরণ প্রচুর। আমি অনেককেই জানি। কিন্তু তার থেকে বড়ো কথা, পরবর্তী সময়ে এই ভূমিকাটা ভীষণভাবে মেয়েরাই পালন করেছে। যখন নকশাল আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের বাইরে চলে গেল এবং বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ—আজকেও যা আছে আরকি— যদিও তা অনেক স্তিমিত, তাতেও দেখা যাচ্ছে নারীদের অংশগ্রহণ মারাত্মক। তুলনামূলকভাবে সেইসময় মেয়েদের ওপর প্রচুর অত্যাচার হয়েছে, জেলেও গেছেন অনেকেই। তবে রাস্তায় নেমে কাজ করার উদাহরণ অনেক কম। যেটা পরবর্তীতে, মানে সত্তর দশক পরবর্তী আন্দোলনে বিহার, অন্ধ্র, ওড়িশায় ব্যাপকভাবে দেখা গেছে, তার তুলনা পশ্চিমবঙ্গে নেই বললেই চলে। তবে তাই বলে নারীদের অবদানকে আমি এতটুকু ছোটো করছি না। যে পরিমাণ অত্যাচার তাঁদের ওপর করা হয়েছে, যে-কোনোদিনই তাঁরা মারা পড়তে পারতেন। সেটা হননি বলেই, তাঁরা কিছু করেননি এমনটা নয়। তবে হ্যাঁ, পরিমাণ কম ছিল। নারী অংশগ্রহণের ব্যাপারটা পরবর্তীতে যতটা ছিল, তার থেকে কম ছিল।

পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ভেঙে সিপিআইএম হল, সেখান থেকেও যে ভেঙে সিপিআই (এমএল)। তারপর আস্তে আস্তে কংগ্রেসি সমাজবিরোধী, পুলিশ, সিআরপিএফের সঙ্গে সিপিআইএমের সমাজবিরোধীরাও নকশালদের দমন করতে এগিয়ে আসে। আর যাই বলুন, নকশাল মতাদর্শও তো বামপন্থা থেকেই জাত। নকশালপন্থীদের ওপর যখন সিপিআইএমের সমাজবিরোধীরা আক্রমণ চালাচ্ছে, তখন কি কোথাও গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতার ভাবনা আসেনি? ’৭৮ সালে সিপিআইএম ক্ষমতায় আসার পর বন্দিমুক্তি হল। পরবর্তী সময়েও শাসকদল বিভিন্ন শহিদবেদি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সার্বিকভাবে নকশাল আন্দোলনের প্রতি সিপিআইএমের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

সুপ্রিয় চৌধুরী— প্রথমত, সিপিআইএমকে আমি বামপন্থী বলে মনেই করি না। জন্মলগ্ন থেকে ওরা নকশালবাড়ি দিয়ে নিজেদের শুরু করেছে। ওরা নাকি খুব ভালো ছিল! এসেই মরিচঝাঁপি করেছে, বানতলা করে ফেলেছে। আমি যদি সাঁইবাড়িটা বাদও দিই, ওই একটাই আমার মতে যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ ছিল, এছাড়া যা করে গেছে সিপিআইএম, নৃশংস গণহত্যা সব। আজকের দিনে বলার সাহস আছে? এই এখন যখন যোগীবাবা-মোদীবাবার লোকজনরা দাপাদাপি করছে, তখন কেন কোঁৎ পেড়ে বসে রয়েছে? কী করেছিল সন্তানদল? তারা নিজেরা একটু রাস্তায় নিজেদের মতো করে মিছিল করত। তাদেরকে সাম্প্রদায়িক স্লোগানও দিতে শুনিনি কখনো।  নিরস্ত্র— তাদের ট্রেন লাইনে মাথা ঠুকে, পিটিয়ে, রেলব্রিজের ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে— এ তো মানে…! আমি মনে করি, সিপিএম বরাবরই একটা গণঘাতক। 

আপনি বলবেন যে, তৃণমূল-কংগ্রেসি জমানায় হয়নি? হ্যাঁ, হয়েছে। কিন্তু সেগুলো সিপিআইএমের মতো স্টেট স্পনসরড নয়। তৃণমূল হল আদ্যোপান্ত লুম্পেন-ডেমোক্রেটিক একটা ব্যাপার-স্যাপার। তারপর একটা দুর্নীতির ব্যাপার তো রয়েছেই। তবে খুব প্ল্যানফুলি হত্যা— এটা সিপিএমের মতো কেউ করতে পারেনি। এবং আমি আপনাকে বলি, বরাহনগর নিয়ে যে সিপিএমে গল্পটা দেয়, আমি নাম ধরে-ধরে বলে দিতে পারি, কারা ঢুকেছিল আর কারা মেরেছিল। বঙ্কিম বিশ্বাস ওরফে বাবলাদা আর করুণা সরকার— এঁদের দুজনকে মেরেছিল সিপিআইএম এবং কারা মেরেছিল সে-কথাও বলে দিতে পারি। তবে খুব ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা করেছিল। কংগ্রেসিরা মদ খেত, হ্যারিকেন জ্বেলে, চোলাই-বাংলা খেয়ে এসে, রাম-টাম খেয়ে এসে পাড়ায় ঢুকে গুলি করেছে, মেরে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। সিপিআইএম এসেছিল খুব নন-টক্সিক অবস্থায়। খুব ঠান্ডা মাথায় নকশালপন্থীদের মেরেছে। তিনতলার ছাদ থেকে প্রথম লাথি মেরে নিচে ফেলে দিয়েছে। তারপর হাত-পা কেটেছে, বুকে চাকু দিয়ে লিখেছে সিপিআই(এমএল)। তারপর চাকু দিয়ে ঢেঁড়া দিয়ে ক্রস এঁকে দিয়েছে। 

সুতরাং, পরবর্তীকালে প্রত্যেকটা শহিদবেদির ক্ষেত্রে ওরা চূড়ান্তভাবে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বেহালায় অন্তত তিনটে শহিদবেদির কথা আমি জানি, বরাহনগরের গোটা তিনেক জানি, যেগুলো ওরা রাখতে দেয়নি। সঙ্গে শ্রীকলোনির শহিদবেদিটা। ছোট্টোমতো একটা বেদি ছিল, বহুবার বড়ো করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তখন সিপিএমের যা দাপট! আর ওই গণহত্যাটা তো... লোকে বলে কংগ্রেসিরাই নাকি প্রথম গণহত্যা করেছে বরাহনগরে। কিন্তু সিপিএম তো শ্রীকলোনির বেদিটা তো করতেই দেয়নি। হয়েছে সিপিএম যাওয়ার পরে। তৃণমূলও জানে যে সিপিএম অমন করেছিল। যখন গিয়ে বলা হয়েছিল, তখন তৃণমূল বলেছিল, না না আপনারা করুন। তখন বড়ো করা হয়েছিল শহিদবেদিটা। তো যাই হোক, যতদিন সিপিএম ছিল, ততদিন পর্যন্ত করা যায়নি।

সিপিএম রাজনৈতিকভাবে খুবই দেউলিয়া দল। ওদের মূল রাগ ছিল, নকশালদের ওরা কালচারাল ফ্রন্টে কমব্যাট করতে পারেনি। সেই জন্যই তাদের কোর থেকে এত হত্যা করেছে। প্রত্যেকটা জায়গায় সিপিএম-নকশাল যে খুনোখুনি— সেই প্রত্যেকটা খুনোখুনি কিন্তু আরম্ভ হয়েছে সিপিএমের হাত দিয়ে। আমি নাম করে করে বলে দিতে পারি। হাওড়ার যে শক্তি রায়— প্রেসিডেন্সি কনসোলিডেশনের, তাকে মারল প্রথম। হ্যাঁ, তারপরে নকশালরাও মেরেছে। তারাও তো দুগ্ধপোষ্য শিশু নয়। তারাও রিঅ্যাক্ট করেছে, রিট্যালিয়েট করেছে। সিপিএমেরও নিশ্চয়ই মরেছে। কম মরেছে, বেশি মরেছে— এই আরকি।

(পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব)

অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor