ক্ষুদিরামকে নিয়ে সিনেমা, তথ্যের যোগান দিলেন বিবেকানন্দ ও অরবিন্দের বিপ্লবী ভাইয়েরা

"বৃটিশ শাসকের এই নির্মম শাস্তিকে লজ্জা ও গ্লানিতে কলঙ্কিত করে, মরণ জয়ী বীর ক্ষুদিরাম, ১১ই অগাষ্ট, ভোর ৬টায় তাদের ফাঁসির দড়ি হাসতে হাসতে গলায় পরে নিল – আনন্দ ও উত্তেজনায় তার হাসিভরা মুখ হতে শুধু একটি কথা বেরিয়ে এল – ‘বন্দেমাতরম্‌’।"

ক্ষুদিরাম সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য কম-বেশি প্রায় প্রত্যেক বাঙালিরই জানা। ১৯০৮ সালে মুজাফফরপুরে কীভাবে কিংসফোর্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়েছিলেন ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী, কীভাবেই বা ক্ষুদিরাম ধরা পড়লেন এবং ফাঁসির আদেশ হল তাঁর – বাঙালিকে এ-গল্প শোনানো বাতুলতা। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসি হয় তাঁর।

এ-লেখার মূল সূত্র কিন্তু অন্য। ১৯৫১ সালে একটি সিনেমা প্রকাশ পায়; নাম – ‘বিপ্লবী ক্ষুদিরাম’। সিনেমাটির চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনা হিরন্ময় সেনের। নিবেদনে কল্‌ অব্‌ ইণ্ডিয়া লিমিটেড। সে-আমলের অনেক সিনেমার মতো, ‘বিপ্লবী ক্ষুদিরাম’-এরও প্রচার পুস্তিকা বেরিয়েছিল। প্রচার পুস্তিকা – যাতে সিনেমার শিল্পী, কর্মীদের সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য থাকত। পাওয়া যেত সিনেমার কাহিনির সারাংশও। দুর্লভ এই প্রচার পুস্তিকাতে রয়েছে ক্ষুদিরামের সংক্ষিপ্ত জীবনী। শুরুর অংশটি সেখান থেকেই নেওয়া।

ক্ষুদিরাম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য পরিচালক ও তাঁর টিম দ্বারস্থ হয়েছিলেন বিপ্লবী ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত(স্বামী বিবেকানন্দের ভাই), বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, লীলা দত্ত(বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের স্ত্রী) প্রমুখের। দেশ মাত্র চার বছর হল স্বাধীন হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনেকেই জীবিত। তাঁদের দেওয়া তথ্য ও পরামর্শের ভিত্তিতে গড়ে তোলা একটি সিনেমা – ঐতিহাসিক তো বটেই!

অভিনয় করেছিলেন আশু বোস, অমল সর্ব্বাধিকারী, ভাস্কর মুখার্জ্জি, ছায়াদেবী, ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, সত্য মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ সে-আমলের যথেষ্ট নামী অভিনেতা। সঙ্গীত পরিচালনায় দেবেশ বাগচী।

এই সিনেমাতেই রয়েছে বিখ্যাত সেই গান ‘একবার বিদায় দাও মা ঘুরে আসি’। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কণ্ঠে। ধনঞ্জয় তাঁর মাদক গায়কিতে অপূর্ব ফুটিয়ে তুলেছিলেন গানটির হাহাকার। অবশ্য এই গানটির কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বাঙালি বেশি পরিচিত লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গেই। ১৯৬৬ সালে ‘সুভাষচন্দ্র’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিল লতার কণ্ঠে গানটি। তবে, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের আবেদন ও গায়কি যে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে গানটিকে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

প্রচার পুস্তিকায় ক্ষুদিরামের জীবনীর পরেই রয়েছে সিনেমার তিনটি গানের লিরিক। ‘এ নহে মরণ, এতো নয়ে ঝরে যাওয়া’, ‘একবার বিদায় দাও মা ঘুরে আসি’ এবং ‘বাঁধন ছেঁড়ার লগ্ন এলো হে জাগো জোয়ান।’ রয়েছে সিনেমাটির বেশ কিছু স্থিরদৃশ্যও। তবে, নতুন আকর্ষণ জাগে ৮ পাতার পুস্তিকাটির শেষ পাতায় অর্থাৎ ব্যাক কভারে পৌঁছে। সেখানে পরবর্তী সিনেমার বিজ্ঞাপন – প্রেমেন্দ্র মিত্রের পরিচালনায় ‘হানাবাড়ী’, যা হয়তো অনেকেই দেখে থাকবেন। ধীরাজ ভট্টাচার্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয় রয়েছে ‘হানাবাড়ী’-তে। সঙ্গে রয়েছে ‘নন্দকুমারের ফাঁসি’ নামের সিনেমার বিজ্ঞাপনও। কোথায় গেল এইসব সিনেমা! তরুণ প্রজন্ম কি আদৌ দেখার সুযোগ পাবে আর?

সদ্য স্বাধীন একটি দেশে ক্ষুদিরামের জীবনীচিত্র যে বাঙালি মনে সে-সময় আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। সে-সময়ের সাক্ষী এই প্রচার পুস্তিকা। এখন সিনেমাটি দুর্লভ। বছর কয়েক আগেও অবশ্য টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হত। ক্ষুদিরাম সম্পর্কে যত ঐতিহাসিক দলিল রয়েছে, এই প্রচার পুস্তিকাটি সে-তালিকায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন নয় কি?

Powered by Froala Editor