১৭৮৫ সাল। দক্ষিণ আমেরিকার মেক্সিকো তখন স্পেনের উপনিবেশ। অরণ্য আর প্রাচীন সভ্যতায় দেশটির কোণায় কোণায় লুকিয়ে আছে রহস্য। স্পেনীয় অভিযাত্রীদের দল নিরন্তর অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে গোপন সম্পদ আবিষ্কারের জন্য। দিয়েগো রুইজ অবশ্য সেরকম লোক নন। মেক্সিকোর স্প্যানিশ সরকারের এক সাদামাঠা কর্মচারীমাত্র। তবে হ্যাঁ, প্রায়ই ঘন অরণ্যে চলে যান দুর্মূল্য তামাকের খোঁজে। আর সেই কাজে গিয়েই একদিন তিনি ‘আবিষ্কার’ করলেন এক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। না, আবিষ্কার বলা ভুল হল। বলা যেতে পারে ইউরোপীয়দের চোখে পুনরাবিষ্কার। কারণ, গত পাঁচশো বছর ধরে স্থানীয় উপজাতিরা একে যত্ন করত, রক্ষণাবেক্ষণ করত। কিন্তু স্পেনীয়রা আসার পরেই আশ্চর্য কৌশলে তা লুকিয়ে পড়ে অরণ্যের গভীরে।
‘এল তাজিন’ (El Tajin)—এই নামেই পরিচিত ঐতিহাসিক ক্ষেত্রটি। বর্তমান ঠিকানা মেক্সিকোর ভেলাক্রুজ রাজ্য। আনুমানিক ৬০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঘন বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্যের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এই নগরী। মেসোআমেরিকা সভ্যতার বিরাট অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা টোটোনাক উপজাতিদের প্রাণকেন্দ্র ছিল ‘এল তাজিন’। এক অর্থে বলা যেতে পারে রাজধানী। বৃষ্টি ও বজ্রপাতের দেবতা ‘তাজিন’ ছিলেন তাঁদের প্রধান উপাস্য। তাঁর থেকেই আসে এই শহরের নাম।
এক সময়ে সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছেছিল ‘এল তাজিন’। আশ্চর্য সব প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে সমৃদ্ধ স্থানটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে টোটোনাকদের নিজস্ব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অসংখ্য উপকরণ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মন্দির, রাজভবনের কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিরাটাকার পিরামিড। প্রায় ষাট ফুট উচ্চতার স্থাপত্যটির নাম ‘নিচেস পিরামিড’ (Niches Pyramid)। মোট সাতটি স্তরে রয়েছে ৩৬৫টি ধাপ। যা আসলে সপ্তাহ ও বছরের দিনসংখ্যার প্রতীকস্বরূপ। সমগ্র মেসোআমেরিকা সভ্যতা জুড়েই যে প্রতীকের ব্যাপক প্রয়োগ রয়েছে, তার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এখানে। ‘চিচেন ইতজার’ বা ‘কুকুলকান মন্দির’ও তার ব্যতিক্রম নয়।
‘তাজিন’ প্রধান দেবতা হলেও মন্দিরের গায়ে খোদাই করা রয়েছে আরও অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি। প্রাণীদের মধ্যে সাপ ও জাগুয়ারের ছবিই প্রধান। পৌরাণিক বিভিন্ন কাহিনির রহস্যময় বর্ণনা রয়েছে মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান, ছবিগুলি মূলত প্রকাশ করে মানুষের শক্তি ও ক্ষমতার দম্ভকে। পিরামিডের সামনেই তাজিনের সম্মানে আয়োজন করা হত ‘ভোলাডোর উৎসব’। প্রায় ৬৫ ফুট উঁচু একটি স্তম্ভে দড়িতে ঝুলে থাকতেন নৃত্যশিল্পীরা। ঝুলন্ত অবস্থাতেই হত অদ্ভুত নাচ ও কারসাজি। যাতে তাজিন তুষ্ট হয়ে সুখ-সমৃদ্ধিতে জীবন ভরিয়ে দেন।
আরও পড়ুন
সারা গুহায় ছড়িয়ে স্ফটিকের স্তম্ভ, মেক্সিকোতেই রয়েছে সাক্ষাৎ ‘চাঁদের পাহাড়’
‘নিচেস পিরামিড’ ছাড়াও ছিল প্রায় ২০টি খেলার জায়গা। বলের ব্যবহার সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া গেলেও তার বাকি ক্রীড়া পদ্ধতি অবশ্য আবিষ্কার করা যায়নি আজও। তবে দেওয়ালের গায়ের ছবি দেখে ইতিহাসবিদরা যা পেয়েছেন, যা চমকে দেওয়ার মতো। দীর্ঘ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার শেষে পরাজিতদের উৎসর্গ করা হত দেবতার উদ্দেশ্যে। তবে কি খেলাও এখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ ছিল? ধন্ধে রয়েছেন গবেষকরাও। সমগ্র ‘এল তাজিন’ জুড়ে রয়েছে পুরাণ ও লোককাহিনি মিশ্রিত এক রহস্যের বাতাবরণ, যা হয়তো ছাপিয়ে যায় প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহাসিক নমুনার মাহাত্ম্যকেও।
আরও পড়ুন
মেক্সিকোর প্রত্নক্ষেত্রে অবৈধ নির্মাণ, সরব জাতিপুঞ্জ
মতনৈক্য রয়েছে এই সমৃদ্ধ সভ্যতার পতনের কারণ নিয়েও। গভীর অরণ্যে থাকার কারণে বাইরের শত্রুর হাত থেকে নিরাপদ ছিল তাঁরা। কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ্বের হাত থেকে কি রেহাই ছিল? বিশেষ করে, রাজতন্ত্রের প্রবল দৌরাত্ম্যের উদাহরণ কিন্তু খোদাই করা আছে দেওয়ালের গায়ে। ফলে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো কারণ নিয়েও ভাবছেন ইতিহাসবিদরা। অবশ্য, বিস্মিত করেছে আরেকটি বিষয়। ‘এল তাজিন’-এর পতনের বহুদিন পরেও স্থানীয় উপজাতিরা রক্ষা করে এসেছেন সভ্যতার চিহ্নগুলিকে। নিয়মিত গাছপালা কেটে পরিষ্কার করতেন ‘নিচেস পিরামিড’-কে। কিন্তু ঔপনিবেশিকরা এর কোনো নিদর্শনই খুঁজে পায়নি দীর্ঘদিন। কীভাবে লুকিয়ে পড়ল এত বড়ো একটা শহর?
১৭৮৫-তে আবিষ্কারের পরেও স্পেনীয়রা কিন্তু খুব একটা মাথা ঘামায়নি একে নিয়ে। বরং ১৯২৪-এ মেক্সিকো সরকারের অধীনে শুরু হয় যথার্থ খননকার্য। তাও কাজ চলছিল ঢিমেতালে। ১৯৩৯-এ হোসে গার্সিয়া সম্পূর্ণ প্রকল্পটির দায়িত্বগ্রহণ করার পর দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চলে ‘এল তাজিন’-এর রহস্য অনুসন্ধান। ১৯৮৪-তে ‘প্রজেক্ট তাজিন’-এর মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয় নগরের বাকি অংশগুলিও। ক্রমে ভিড় জমায় পর্যটকরাও। তবে মায়া সভ্যতার নিদর্শনগুলির মতো জনপ্রিয়তা কখনই পায়নি এটি। আজও রয়ে গেছে কিছুটা অন্তরালে। যেভাবে লুকিয়েছিল কয়েকশো বছর। রহস্যের চাদরে, পৌরাণিক গল্পকথায়...
Powered by Froala Editor