‘ধন ধান্য’ : ভুলে ভরা

শ্রুতিমধুর- ১


গত মাসের ১৯ তারিখ ছিল বাংলার এক কৃতবিদ্য স্রষ্টার জন্মদিন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। নাটক লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, গানও বেঁধেছেন। প্রবন্ধ, নাটক বা কবিতার সঙ্গে ভীষণভাবে না হলেও বাঙালি শ্রোতা নানা প্রেক্ষিত ও প্রসঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলালের গানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে, একরকম বাধ্য হয়েই। দ্বিজেন্দ্রলালের সবথেকে বিখ্যাত বা শ্রুত গান বোধহয় ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ (ধনধান্যপুষ্পভরা কিংবা ধন-ধান্য-পুষ্প ভরা-ও লেখা হয়)। কারণ, না চাইতেও ছোটবেলায় প্রার্থনাসঙ্গীতে কোরাসে গাইতে গিয়ে শিখতেই হয়েছে সবাইকে! অথচ গাওয়ার ক্ষেত্রে এ গানে খুব অদ্ভুত কিছু ভ্রান্তি হয়ে এসেছে অনেকদিন থেকে। সেগুলো একে একে দেখা যাক্‌! সঙ্গে সঙ্গে বলব সমস্যার কথাও।

১/ প্রথম পঙক্তিটি প্রায়ই গাওয়া হয়- ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’। বিভক্তিবিপর্যয়। না, এ-বিভক্তি দিয়ে শব্দদুটো বললে ব্যাকরণেও কিছু ভুল হয় না, অর্থও বদলে যায় না। দেখুন, শিরোনামেও আছে ‘ভুলে ভরা’। ‘ভুল ভরা’ নয়। তাতে সমস্যা নেই। তবে প্রশ্ন হল, ‘ধান্যে’ আর ‘পুষ্পে’-ই যদি গাইলাম, তবে ‘ধনে’ গাইব না কেন? ধন, ধান্য আর পুষ্প—সম্পদ, শস্য আর সৌন্দর্য, আমাদের বসুন্ধরা এগুলোতে পরিপূর্ণ, এটাই তো লেখকের বক্তব্য। এ-কারগুলো একান্ত বাহুল্য। আশ্চর্যের বিষয়, দ্বিজেন্দ্রপুত্র দিলীপকুমার রায়ের রেকর্ডেও এই বাহুল্য বর্তমান। মুশকিল হল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান আক্ষরিক অর্থেই দিলীপকুমার রায়ের ‘পৈতৃক সম্পত্তি’। ফলে সেই গাওয়াকে অস্বীকার করা বা প্রশ্ন করা বেশ কঠিন একটা কাজ। তাই যাঁরা এ-যুক্ত উচ্চারণে গানটি বলেন, তাঁদের কাছে দিলীপ রায়ের ওই গাওয়াটি সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত ও কড়া সাবুদ। আমাদের হাতে এই বাহুল্যটিকে ‘প্রমাদ’ বলে চিহ্নিত করার প্রমাণ হিসেবে রয়েছে গীতবাণী, যেখানে এ-কার মোটেও নেই, এবং আছে (সম্ভবত ১৯০৭-এ) দ্বিজেন্দ্রলালের স্বকণ্ঠে গীত গানের রেকর্ড, যেখানে অত্যন্ত স্পষ্ট উচ্চারণে এ-কার বর্জিত ‘ধান্য’ আর ‘পুষ্প’ শোনা যাচ্ছে। গানটি ১৯০৯-এ প্রকাশিত ‘সাজাহান’ নাটকে যখন ব্যবহৃত হয়, তখনও ‘ধান্য’ আর ‘পুষ্প’-ই লেখা হয়। ১৯০৫-পর্বে গানটি প্রথম লেখার সময় আদতে কী ছিল, তা জানতে বেগ পেতে হবে। তবে দিলীপকুমার রায় স্বরলিপি করার সময়ে এ-কারগুলি বাদ দিয়েছেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

২/ অনেকসময় গাওয়া হয়- ‘চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা কোথায় এমন উজল ধারা’। উজল মানে উজ্জ্বল। ‘উজল ধারা’ বললেই কেমন ‘উতল ধারা’ মনে পড়ে, নয় কি? সেই ‘ধারা’ হল বৃষ্টির ধারা। কিন্তু ‘উজল ধারা’ মানে কী? উজ্জ্বল প্রবাহ? উজ্জ্বল বৃষ্টি? না, এই ‘ধারা’র সঙ্গে বর্ষণ বা প্রবাহ বা স্রোতের সম্পর্ক নেই। মূল কথাটি হল ‘কোথায় উজল এমন ধারা’। গোটা গানটিই তো কাকুবক্রোক্তির ঢঙে প্রশ্নসূচক বাক্য দিয়ে গড়া। কাকুবক্রোক্তি কী? এমন কায়দায় একটা প্রশ্ন করা, যার মধ্যেই প্রশ্নকর্তার উদ্দিষ্ট বক্তব্যের অভিমুখটা লুকিয়ে আছে। ‘ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?’- এ প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য হল, এই শ্যামল জন্মভূমি ছাড়া আর কোত্থাও এত স্নেহ খুঁজে পাবে না- একথা বলা। সেরকম, এই লাইনেও আসলে বলতে চাওয়া হচ্ছে, ‘এমন ধারা’ বা ঠিক এইরকম, এতটা উজ্জ্বল চাঁদ-সূর্য-নক্ষত্র কোথাও নেই। এখানে ‘ধারা’ শব্দটি ‘রকম’ বা ‘মতন’ অর্থে ব্যবহৃত। অতএব লোকনিরুক্তির খাতিরে ‘উজল ধারা’ মেনে নিলেও ‘উজ্জ্বলমত’ অর্থ বুঝে নিতে হবে।

৩/ ওই একই স্তবকের লাইন। এইটিই সবথেকে কঠিন ও বিভ্রান্তিকর জায়গা। তাই প্রমাদের সংখ্যাও একাধিক। কেউ গায় ‘তার পাখীর ডাকে ঘুমিয়ে উঠি। পাখীর ডাকে জেগে'। কেউ আবার গায় ‘তারা পাখীর ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখীর ডাকে জেগে।’

গানে বলতে চাওয়া হচ্ছে, এই জন্মভূমির পাখিদের কলরব শুনতে শুনতে ঘুম আসে, আবার সেই পাখিদের ডাকেই ঘুম ভাঙে। ‘তার পাখীর ডাকে ঘুমিয়ে, উঠি পাখীর ডাকে জেগে’। বেশ মুশকিলের বাক্য এ কারণেই যে, স্বরলিপিতে বা গীতবাণীতে যতিচিহ্ন নেই। তাই প্রথমে অর্থটা বোঝা যায় না। রথীন্দ্রনাথ রায়-সম্পাদিত দ্বিজেন্দ্র রচনাবলীতে অথবা প্রমথনাথ বিশী সম্পাদিত দ্বিজেন্দ্রলাল-রচনাসম্ভারে ‘সাজাহান’ নাটকের তৃতীয় অঙ্কের শেষে আছে এই গান, আর দুটিতেই যতিচিহ্ন আছে ‘ঘুমিয়ে উঠি’-র পর। কিন্তু এখানে গোলমাল বাধে ‘ঘুমিয়ে’ ক্রিয়াপদটাকে নিয়ে। বাক্যের প্রথমার্ধটি যদি গাওয়া হয়ে থাকে ‘ঘুমিয়ে উঠি’, তাহলে স্বাভাবিক ব্যাকরণ অনুযায়ী অসমাপিকা-সমাপিকার যুগল ক্রিয়া ধরলে ‘ঘুমিয়ে’-র সঙ্গে কখনোই ‘উঠি’ বসবে না, বসবে ‘পড়ি’। যেমন শুয়ে পড়া, খেয়ে নেওয়া, দেখে ফেলা, বলে দেওয়া ইত্যাদি, তেমনি ঘুমিয়ে পড়া। গানে এর পরের পরের স্তবকে এমন প্রয়োগও আছে; গুঞ্জরিয়া ধেয়ে আসা মৌমাছিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে’। ‘ঘুমিয়ে উঠি’ অসিদ্ধ, তা নয়, মুখের ভাষায় আকছার বলা হয়। কিন্তু সেই ‘ঘুমিয়ে ওঠা’ মানে আসলে কী? ঘুমনোর পর ওঠা। দুটি আলাদা ক্রিয়া। কিন্তু এই বাক্যে ‘উঠি’ পদ অন্য একটি অসমাপিকার সঙ্গে যুক্ত। এখানে যুগল ক্রিয়া হল ‘জেগে উঠি’। তাহলে ‘ঘুমিয়ে উঠি’ গাওয়া কেন? ব্যাপার হল, আগের ‘ঘুমিয়ে’ একক অসমাপিকা ক্রিয়া, অথচ তার সঙ্গে ভুল করে পরের পদ বা শব্দকে সংশ্লিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আর তার ফলে বাক্যটা হয়ে পড়েছে অর্থহীন। গদ্যবাক্য করলে এরকম দাঁড়াচ্ছে— ‘আমরা তার পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি, আমরা পাখির ডাকে জেগে’। ‘ঘুমিয়ে ওঠা’ (যদি এমন কিছু ধরি) আর ‘জাগা’ তো একই ব্যাপার, তাহলে একই কথা বোঝাতে দুবার ‘পাখীর ডাকে’ লেখার কী দরকার ছিল? তার চেয়েও বড় ঝামেলা, এবার তাহলে ‘জেগে’ শব্দটা কোথায় যাবে? ‘জেগে’ বলতে এখানে ‘জেগে আছি’ বা ‘জেগে থাকি’ তো বোঝানো হচ্ছে না, ‘জাগি’ বা ‘জেগে উঠি’ বলতে চাওয়া হচ্ছে। একক অসমাপিকা ক্রিয়া হিসেবে ‘জেগে’ তো এই বাক্যে বেওয়ারিশ হয়ে গেল। যাঁরা গাইবার সময়ে ‘পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, পাখির ডাকে জেগে’ বলেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও এই সমস্যাটাই বিচ্ছিরিভাবে থেকে যাচ্ছে...

কথাটি আসলে হল, পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ার পর আমরা পাখির ডাকেই জাগি, অতএব ‘জেগে উঠি’ হল এই বাক্যের যুগল ক্রিয়া, যা ‘উঠি জেগে’- এই বিন্যাসে প্রযুক্ত। কিন্তু ওই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যতিচিহ্ন না থাকায় বা ভুল থাকায় তা এমনি পড়ার সময়েই বোঝানো দুষ্কর, গাইবার সময়ে তো আরোই। এই সমস্যা মেটাতে সমাধানের পথ একটাই। গানটা গীতছন্দে উচ্চারণের সময়ে ‘ঘুমিয়ে’ উচ্চারণের পর এক মাত্রা ছেড়ে ‘উঠি’-কে ধরা দস্তুর। ‘ঘুমিয়ে/উঠি-’ না বলে বলতে হবে ‘ঘুমিয়ে/-উঠি’। স্বরলিপি করলে- ‘ঘু মি য়ে I উ ঠি ০ I’ না লিখে লিখতে হবে ‘ঘু মি য়ে I ০ উ ঠি I’। এমন উচ্চারণ করলে তবেই বাক্যের মানে স্পষ্ট হয়। বোঝা যায়, প্রদোষ আর প্রভাতের বিহঙ্গসঙ্গীত কেমন করে একইসঙ্গে নিদ্রা আনে, আনে জাগরণও।...

আমার সৌভাগ্য, ছোটবেলা থেকে গানটা এমন করে আশেপাশে গাইতে শুনেছি, সেই শুনেই প্রথম শেখা। আরও সৌভাগ্য, আমার সঙ্গীতগুরু, আচার্য দিলীপকুমার রায় (যিনি দ্বিজেন্দ্রপুত্রের সমনামী হলেও এই গান দেখেছেন স্বতন্ত্র চোখে) আর শ্রীমতী অর্চনা ভৌমিক গানের মর্মে ঢোকার এই দরজাটা দর্শে দিয়েছেন। গানটা অবশ্য আরও নানাভাবে শোনা যায়। দ্বিজুবাবু কি ভেবেছিলেন, তাঁর স্বদেশসঙ্গীত কখনো জমিবাড়ি বেচতে প্রোমোটারের কাজে লাগবে? তাও আবার অদ্ভুতুড়ে এক পরিবর্তিত বাণীতে, যা এমনকি প্যারডিও নয়? ‘জলকাদামাখা নোংরা’ শহরের বহুতলবিলাসী যেমন করে এ গানের বিচিত্র সংস্করণ শোনায়, তার সঙ্গে বাঙালির এত বছরের ‘স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ গানের কতটুকুই বা সম্পর্ক বলুন? রিয়েল এস্টেট যদি সত্যিই এই বসুন্ধরাকে চিনত, তবে তো হয়েই যেত!

Powered by Froala Editor