তুড়ি মারলেই জন্মাবে না কোভিডের ভ্যাক্সিন; ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায়ই বা কী!

সম্প্রতি শুনলাম, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। কী কারণে এই আত্মবিশ্বাস? এই ভেবে যে, ২০২০-র শেষের আগেই কোভিড-১৯ সংক্রমণ রুখে দেওয়া যাবে। আর সে-জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন আমাদের হাতে তুলে দিতে পারবেন তিনি।

আমরা যারা গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে জড়িত আছি, তারা, এবং বিশেষ করে বায়োটেকনোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বায়োকেমিস্টরা হাড়ে হাড়ে জানেন একটা কথা। ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের কথা বলা বেশ সহজ হলেও, হাতে কলমে কাজটা করে দেখানো, প্রায়‌ গন্ধমাদন কাঁধে তুলে লাফ মারার সমার্থক। সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে যখন এই মুহুর্তের সব থেকে বড়ো প্রশ্ন, ঠিক কবে করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন বা টিকা পাড়ার মোরের অষুধের দোকানে বিক্রি হবে; এমত সময়ে ট্রাম্প সাহেবের এহেন বিবৃতি আমাদের সকলকে খানিকটা মানসিক স্বস্তি দিলেও, বৈজ্ঞানিক সত্যের কাছ থেকে বেশ অনেকখানি দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু পরিষেবা প্রদান করে না।

প্রথমেই, একটি নতুন ভ্যাক্সিনের পক্ষে এ্যাকাডেমিক গবেষণাগারের চৌকাঠ পার করে ঠিক কী কী পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে কত সময়ের পর মানুষের হাতে এসে পৌছানো সম্ভব, সেটা খুব স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়া দরকার। প্রত্যেকটি দেশের ক্ষেত্রেই, ‘ল্যাবোরেটরি গবেষণা’ থেকে ‘ফার্মাসিউটিকা্ল মার্কেট’ অবধি যে কোনো নতুন ওষুধের বিবর্তন, এক বা একাধিক প্রশাসনিক সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং অল্প কিছু ব্যাতিক্রম থাকলেও মোটামুটি ভাবে নিয়মগুলি সমস্থ দেশের ক্ষেত্রেই প্রায় এক। আমরা পৃথিবীর এক অন্যতম প্রভাবশালী সংস্থা, যুক্তরাস্ট্রের এফ ডি এ(ফুড অ্যান্ড ড্রাগ এ্যাডমিনিস্ট্রেশান)-কে উদাহরণ ধরে ব্যাখ্যায় যাব। 

গবেষণার প্রথম ধাপে রাষ্ট্র বা যে কোনো ফার্মাসিউটিকাল কম্পানির আর্থিক সাহায্যের হাত ধরে একটি গবেষণাগারে একটি রোগের জন্য দায়ী জৈবিক ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাসের কাজ করার পদ্ধতি বা ‘ডিজিজ প্রোপাগেশান প্রসেস’ বোঝার চেষ্টা করা হয়। এই, পদ্ধতিগত রিসার্চের মাধ্যমেই খোঁজার চেষ্টা হয় লুকিয়ে থাকা একটি প্রোটিন স্ট্র্যান্ড বা একটি জিনের গঠন যার সাথে নতুন ভ্যাক্সিন বা ওষুধটির বোঝাপড়া হবে। এরপর খোঁজ শুরু হয় এমন কোনো মলিকিউলের (সাধারণত সামুদ্রিক গাছপালা, অন্যান্য উদ্ভিদের থেকে সংগৃহীত, বা অনান্য কৃত্রিম যৌগিক) যা কিনা ওষুধ বা টীকার আকারে শরীরের হয়ে বোঝাপড়াটি করবে। প্রায় ১০০০০-২০০০০ এর বেশি কম্পাউন্ডের পরিস্রাবণ বা ফিল্টারিং এর পরে ১০-২০টি কম্পাউন্ডকে তাত্ত্বিক ভাবে উপযুক্ত হিসেবে নির্বাচন করা হয়। এর পরবর্তী অধ্যায়ে এক্সপেরিমেন্টাল বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রায় ৫০-৬০% কম্পাউন্ড বাদ পড়ে। এই পদ্ধতিগত পর্যায়টির নাম প্রি ক্লিনিকাল ট্র্যায়াল স্টেজ। রইল বাকি ৫ কি ৭? এই একগাছি কম্পাউন্ড নিয়েই কম্পানিগুলির ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ্যাপ্লিকেশান (সি টি এ) পদ্ধতিতে প্রবেশ (বেশ সময়সাপেক্ষ একটি প্রবেশিকা রিভিউ-এর পর), যার সর্বসাকুল্যে মোট তিনটি পর্যায়। প্রথম পর্যায়ে, এই কম্পাউণ্ডগুলির ক্ষতিকারক দিকগুলি (সাইড-এফেক্ট) নিয়ে কাজ চলে ২০-১০০ জন মানুষের উপর। এই ফেজেই বাদ যায় আরো অন্তত বেশ কিছু ড্রাগ। দ্বিতীয় পর্যায়ে, ক্ষতিকারক দিকগুলি পরিমার্জিত হওয়ার ফলে আরো একটু বৃহৎ আকারে চলে (২০০-৫০০ জন সংক্রামিত মানুষের উপর) ‘কন্ট্রোলড’ পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সুফল, কুফল, ওষুধ নেওয়ার পদ্ধতির (ইন্ট্রাভেনাস ইঞ্জেকশান, খাওয়ার ওষুধ ইত্যাদি) নিরিখে বাদ পড়ে আরো বেশ কটি কম্পাউন্ড। এরপর ফেজ ৩। বাকি ২ বা ৩টি ড্রাগের ‘রিগোরাস’ বা অব্যাহতিহীন মাস টেস্টিং করা হয়, ১০০০-৫০০০ মানুষের উপর। পাঠক শুনলে অবাক হবেন, এই পর্যায় অবধি লড়াই করেও প্রায় ১০% ড্রাগের ‘র‍্যাটরেস’-এ বিদায় নেওয়া সম্ভব। 

আরও পড়ুন
গত তিন মাসে দিল্লিতে করোনা-আক্রান্ত ১২০০০ স্বাস্থ্যকর্মী, চাঞ্চল্যকর তথ্য

এ তো গেল বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা। এর পরের পর্যায় রাষ্ট্রের ‘ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড মার্কেটিং অথারিটি’র (মার্কিনদের ক্ষেত্রে এফ ডি এ, ইউরোপে ই এম এ ইত্যাদি) রিভিউ। এই সংস্থার কাজ বিগত গবেষণার সমস্ত তথ্য খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা, যা কিনা, বলাই বাহুল্য বেশ সময় সাপেক্ষ এবং কঠিন। অবশেষে মার্কেটিং রিভিউ-এর বেড়া পার করলে তবেই আসে লাইসেন্স বা ওষুধ/কম্পাউন্ডটি(গুলি) বাজারের জন্য উৎপাদনের ছাড়পত্র। 

আরও পড়ুন
করোনায় আক্রান্ত বাংলাদেশের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক মাশরাফি, চিন্তিত ভক্তরা

উপরোক্ত আলোচনা থেকে উদাহরণ স্বরূপ মোটামুটি এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, ২৫০০০ যৌগিক থেকে যে গবেষণার সূত্রপাত, তার মধ্যে ২৫টি মানুষের উপর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও বাজারে আসে তার থেকে মাত্র ৫টি ড্রাগ। তার পরেও কম্পানিগুলির এই বিপুল বিনিয়োগের আর্থিক সাফল্য আসে সাকুল্যে একটিই ওষুধ থেকে। তাত্ত্বিক গবেষণা শুরুর প্রথম দিন থেকে, আমার আপনার পাড়ার মোড়ের ওষুধের দোকানে সেই ড্রাগ হাতে পাওয়ার দিন পর্যন্ত সাধারণত, কমপক্ষে দেড় থেকে ২ বছর অপেক্ষা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন
নৌকাই হয়ে গেছে চেম্বার, করোনা আর আমফান মোকাবিলায় সুন্দরবনে ডাঃ অজয় মিস্ত্রি

এবারে আসা যাক কোভিড-১৯ সংক্রমণকারী ভাইরাসের ভ্যাক্সিন গবেষণার আলোচনায়। ৯ জুন ২০২০, Coalition for Epidemic Preparedness Innovations (CEPI)র তথ্য এবং WHO(World Health Organization) নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী,  সারা পৃথিবীব্যাপী কোভিড ভ্যাক্সিন গবেষণার বর্তমান পরিস্থিতি খানিকটা এরকমঃ

আরও পড়ুন
স্বপ্ন ডাক্তার হওয়ার, অর্থাভাবে করোনায় মৃতদের সৎকারে ব্যস্ত উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া

১। ১০টি মাত্র কম্পাউন্ড বা ভ্যাক্সিনের যৌগিক ক্লিনিকাল ট্রায়ালের ফেজ ১, ২ কিংবা বড়জোর ফেজ ৩ অবধি অগ্রসর হয়েছে। প্রায় প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ড্রাগের রসায়ন ঐতিহাসিক সার্স, মার্স, জিকা, বা ইবোলা ভ্যাক্সিন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ট্রায়াল পর্যায়ের পরিস্থিতি অনুসারে পর পর যৌথ উদ্যোগগুলি হলঃ

আরও পড়ুন
মোঘল সম্রাটের পর করোনা; এবারের মতো স্থগিত পুরীর রথযাত্রা, নির্দেশ কোর্টের

Ø    ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ড/এ্যাস্ট্রাজেঙ্কা (ইউনাইটেড কিংডম্ - ইংল্যান্ড)

আরও পড়ুন
জায়গা নেই গোরস্থানে, পুরনো সমাধি খুঁড়েই শায়িত করা হচ্ছে করোনায় মৃতদের!

Ø    ক্যান্সিনো বায়োলজিকাল কর্পোরেশান/বেইজিং ইনস্টিটিউট অফ বায়োটেকনোলজি (চিন)

আরও পড়ুন
সমুদ্রতটে একের পর এক কবর, সরকারের করোনা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ব্রাজিলে

Ø    মডের্না/এন-আই-এ-আই-ডি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)

আরও পড়ুন
করোনা ভ্যাকসিনের পরীক্ষায় ৩০টি মহিলা বাঁদর, উঠছে প্রশ্ন

Ø    উহান ইনস্টিটিউট অফ বায়োলজিকাল প্রোডাক্ট/সিনোফার্ম (চিন)

আরও পড়ুন
কোভিড-১৯ এর প্রথম ভ্যাকসিন প্রস্তুত, দাবি ইতালির সংস্থার

Ø    বেইজিং ইনস্টিটিউট অফ বায়োলজিকাল প্রোডাক্টস/সিনোফার্ম (চিন)

আরও পড়ুন
করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করলেন অক্সফোর্ডের গবেষকরা, ট্রায়াল শুরু ইংল্যান্ডে

Ø    সিনোভাক (চিন)

Ø    নোভাভ্যাক্স (মার্কিন যুক্ত্রাস্ট্র)

Ø    BioNTech/Fosun Pharma/Pfizer (জার্মানি)

Ø    ইনস্টিটিউট অফ মেডিকাল বায়োলজি, চাইনিজ এ্যকাডেমি অফ মেডিকাল সায়েন্সেস (চিন)

Ø    ইনোভিও ফার্মাসিউটিকালস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)

1.    এছাড়া আর ১২৬টি ভ্যাক্সিন প্রিক্লিনিকাল ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমাদের দেশীয়

Ø    ভারত বায়োটেক/থমাস জেফার্সন ইউনিভার্সিটি 

Ø    ইন্ডিয়ান ইমিউনোলজিকাল লিমিটেড/গ্রিফীথ ইউনিভার্সিটি

     এই দুটি যৌথ প্রয়াস।

এ কথা অবশ্যই সত্যি যে, সমস্থ মহামারী বা অতিমারীর মতোই, এবারেও সমগ্র বিজ্ঞানীমহল কোভিড ভ্যাক্সিন গবেষণায় অত্যন্ত দ্রুততার পরিচয় দিয়েছেন। প্রাণপাত পরিশ্রম ফলও দিয়েছে যথেষ্ট। ১১ জানুয়ারি, উহান ওয়েট মার্কেট থেকে ছড়ানো নভেল-করোনা সংক্রমণের তথ্য হু প্রকাশ করার পর শুরু হওয়া ভ্যাক্সিন গবেষণা বেশ কয়েকটি কম্পানি ১৬ই মার্চের মধ্যেই যে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের চৌকাঠ পার করাতে পেরেছেন, সেই তথ্য একাই পর্যাপ্ত সাধুবাদ এবং সহযোগিতা দাবি করতে পারে, যদিও প্রায় সমস্থ গবেষণার ভিত্তিই ইবোলা, সার্স, মার্স টীকার প্রতিষ্ঠিত রসায়ন। তার কারন, এই ভাইরাসের প্রোটিন স্ট্র্যান্ড, ১০০ বছর আগে শুরু হওয়া স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা, বা তুলনামূলক ভাবে আধুনিক সময়ের সার্স, মার্স ইত্যাদি সংক্রমণের জন্য দায়ী এইচ-এন স্ট্র্যান্ড পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই অনান্য রোগের তুলনায় আমরা নভেল-কোভিডের ক্ষেত্রে খানিকটা ত্বরান্বিত ফল আশা করতে পারি।

তবুও পাঠক, এ কথা আমাদের বুঝতেই হবে, অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মতই কোভিড ড্রাগের আবিষ্কারের পদ্ধতিও তার নিজস্ব ধারাতেই বইবে। যে কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল গবেষণার ভিত্তি একাধারে যেমন তার প্রয়োজনীয়তা, তেমনই অন্যদিকে তাকে চালনা করে বাজার এবং কম্পানিগুলির ব্যাবসায়িক স্বার্থ। সে কারণেই, ঐতিহাসিক ভাবে আইনস্টাইনের দূরদর্শিক জেনারাল রিলেটিভিটি বা ফোটোইলেকট্রিক এফেক্টের তাত্ত্বিক গবেষণাকেও তার উপযুক্ত গ্রহণযোগ্যতার জন্য একরাশ অবমাননার মধ্যে দিনযাপন করতে হয়, অথবা এক প্রাণপাত করা পোস্টডক্টরাল বিজ্ঞানীকে মাসের শেষে বাজারে যেতে হয় পকেট মেপে। 

সমস্ত রোগের মতোই কভিডের ক্ষেত্রেও উপশম আসবে, আমার-আপনার পাড়ার দোকানেই সহজলভ্য হবে, তবে তার একটি নিজস্ব কার্যপ্রণালী রয়েছে। এফ ডি এ, ই এম এ, বা মার্কেটিং এথিক্স কমিটি এই পরিস্থিতিতে কোভিড গবেষণাকেই সর্বোচ্য প্রাধান্য দেবেন, তাও সত্যি। তার মাঝে বিজ্ঞানীমহল আমাদের থেকে অল্পই আশা করেন।

তথ্যসূত্র - 

1.    “The race for coronavirus vaccines: a graphical guide; Eight ways in which scientists hope to provide immunity to SARS-CoV-2”, Ewen Callaway, www.nature.com

2.    COVID-19 vaccines: breaking record times to first-in-human trials,Young Chan Kim, Barbara Dema & Arturo Reyes-Sandoval, Nature npj Vaccines volume 5, Article number: 34 (2020).

3.    DRAFT landscape of COVID-19 candidate vaccines – 9 June 2020, World Health Organization (WHO).

Powered by Froala Editor

More From Author See More