দেবতাজ্ঞানে ফিলিপ-পুজো, ইয়াহোনানেন জনজাতির মধ্যে আজও প্রচলিত যে রীতি

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ছোট্ট দ্বীপ তান্না। সেখানে ভানুয়াতু গ্রামে বসবাসকারী আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে প্রচলিত আছে এক অদ্ভুত লোককথা। তাকে ধর্ম বললেও ভুল হয় না অবশ্যি। ইয়াহোনানেন জনগোষ্ঠীর মানুষদের বিশ্বাস, অদৃশ্য থেকেই তাঁদের গোটা সমাজকে চালনা করেন ‘পাহাড়ের ঈশ্বর’। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ হলেও, তাঁর পুত্র জন ফ্রাম একজন শ্বেতাঙ্গ। আর গ্রামের মানুষদের রক্ষাকর্তা হিসাবেই ঈশ্বর প্রেরণ করেছিলেন তাঁর সন্তানকে। আজও কোট পরিহিত সেই শ্বেতাঙ্গ দেবতার ছবিই পুজো করেন ইয়াহোনানেনরা।

তবে এক ঝলক এই ছবি দেখলেই চমকে উঠবেন। এই দেবতা আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং এডিনবার্গের ডিউক। প্রিন্স ফিলিপ। অঙ্কটা হিসেব করেও মেলাতে পারছেন না, নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, এ এক জটিল ধাঁধাঁই বটে। জীবনে বহু সম্মাননা, উপাধি অর্জন করেছেন প্রিন্স ফিলিপ। তবে এহেন মর্যাদা দ্বিতীয় কোথাও থেকে পাননি তিনি। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে তিনি দেবতা হয়ে উঠলেন এই প্রাচীন জনজাতির? সেই উত্তর খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বের ভানুয়াতু গ্রামে।

১৯৩০ দশকের শুরু থেকেই আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ানদের আনাগোনা লেগে ছিল এই দ্বীপে। তখন অবশ্য ‘তান্না’ বলে পরিচিত হয়নি দ্বীপটি। তার নাম নিউ হিব্রাইড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আনাগোনা বাড়ে আরও। সে সময়ে মার্কিন সেনাবাহিনী কার্গো সংরক্ষণ করত এই দ্বীপে। আর অর্থ উপার্জন ও উপহারের লোভে তাঁদের হয়ে বেগার খাটত ইয়াহোনানেন উপজাতির মানুষেরা।

উপার্জন যে মন্দ হত, তেমন না। তবে সমস্যা দেখা দিল অন্য এক জায়গায়। তা হল, ক্রমশ যেন পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রাস করছে তাঁদের। ক্রমশ ঐতিহ্যবাহী প্রথাগুলি হারিয়ে যেতে বসল তাঁদের সমাজ থেকে। সম্প্রদায়ের মানুষদের ইতিহাসের মূল স্রোতে ফেরাতেই এমন একটি লোককথার প্রচলন করেছিলেন এই জনগোষ্ঠীর নেতা। যদিও এই তত্ত্ব নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েই গেছে।

আরও পড়ুন
ফিলিপ-এলিজাবেথের বিবাহ, সদ্য-স্বাধীন ভারত থেকে ‘জয় হিন্দ’ বার্তা মহাত্মার

সে যাই হোক, প্রাচীন এই লোককথা অনুযায়ী সেই দেবশিশু বহুকাল আগেই ছেড়েছেন তান্না দ্বীপ। পরে ভিনরাজ্যের এক মহিলাকে বিবাহ করে, আবার ফিরে আসবেন তিনি— এমনটাই বলে সেখানকার লোককথা। বলে, সেই দেবশিশু ফিরে এলে শান্তি ফিরবে তাঁদের সমাজে, ফিরবে আইন-শৃঙ্খলাও। তবে শর্ত একটাই— ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির মূলস্রোতে পুনরায় ফিরতে হবে তাঁদের। একমাত্র তারপরেই সম্ভব দেবতার প্রত্যাবর্তন।

আরও পড়ুন
শতবর্ষের দোরগোড়ায় প্রয়াত ‘একুশ শতকের রাজতন্ত্রের প্রতিভূ’ প্রিন্স ফিলিপ

আশ্চর্যজনকভাবে বিশ্বযুদ্ধের শেষলগ্ন থেকে ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে বর্জন করে দেন ইয়াহোনানেনরা। শুরু হয় অহিংস এক আন্দোলন। খালি হয়ে যেতে থাকে একের পর এক খ্রিস্টান মিশনারি, মার্কিন শক্তিচালিত কর্মক্ষেত্রগুলি। পঞ্চাশের দশক থেকে প্রায়ই সেখানে এই সম্প্রদায়ের মানুষরা এক অভিনব শোভাযাত্রা করে থাকতেন গোটা দ্বীপজুড়ে। হাতে রঙিন কাপড়ে মোড়া বল্লম নিয়ে চলত প্যারেড। ইষ্ট দেবতার আহ্বান-পর্ব।

এর দু’দশক পর ১৯৭৪ সালে এলিজাবেথের সঙ্গেই ভানুয়াতু দ্বীপে নির্জনে সময় কাটাতে যান প্রিন্স ফিলিপ। গ্রামের অধিবাসীদের খুশি করতে কিছু উপহারেরও ব্যবস্থা করেন তিনি। তবে ব্রিটেনের ডিউকের আসল পরিচয় জানতেন না ইয়াহোনানেনরা। ফলত কোর্ট পরিহিত ফিলিপকে দেখে সেই কল্প-ঈশ্বর বলেই মনে হয় তাঁদের।

তবে সেই সফরে ফিলিপের কাছাকাছি আসার সেভাবে সুযোগ পাননি তাঁরা। থেকে যায়, ঈশ্বরকে পেয়েও না পাওয়ার আক্ষেপ। আর সেই কারণে, ফিলিপের ব্রিটেনে ফেরার পর নিয়ম করেই নিত্যদিন আবেদন আসতে শুরু করে ভানুয়াতুর ব্রিটিশ আবাসনে। অনুরোধ, তাঁদের ঈশ্বরের অন্তত একটি ছবি যেন কমিশনার আনিয়ে দেন ‘স্বর্গরাজ্য’ থেকে। 

শেষমেশ একটা গোটা সম্প্রদায়কে শান্ত করতে, তেমনটা করতেই বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ কমিশনার। ফিলিপের অনুমতি নিয়েই পাঠানো হয় একটি অফিশিয়াল ফটোগ্রাফ। যা আজও পূজিত হয় তান্না দ্বীপে। তবে এখানেই শেষ নয়, ‘ঈশ্বর’ ফিলিপকে নিজেদের সংস্কৃতির একটি মুগুরও পাঠিয়েছিলেন ইয়াহোনানেনরা। যা আসলে ব্যবহৃত হয় শূকর মারার কাজে। সেই মুগুর হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফিলিপের ছবিও বেশ জনপ্রিয় তান্নার এই গ্রামে।

২০০৭ সালে একটি ব্রিটেনের অনুষ্ঠানে এই সম্প্রদায়ের পাঁচ সদস্যকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রিন্স। তাঁদের সঙ্গে একান্তে দেখাও করেন তিনি। সেসময় ব্রিটেনের টিভি রিয়্যালিটি শো-তেও দেখা গিয়েছিল সেই পাঁচ ইয়াহোনানেনকে। তবে শুধু ফিলিপই নন, গোটা ব্রিটিশ রাজপরিবারই তাঁদের কাছে দেবতুল্য। ২০১৮ সালে, হ্যারি-মেগানের বিবাহের সময়ও তান্না দ্বীপজুড়ে পালিত হয়েছিল আনন্দ উৎসব। সম্প্রদায়ের অনেকে নিমন্ত্রিতও হয়েছিলেন বাকিংহাম প্যালেসে। সব মিলিয়ে হাজার হাজার মাইল দূরের এই দুই অঞ্চলের মধ্যে যেন অদ্ভুত এক রূপকথার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল প্রিন্স ফিলিপকে কেন্দ্র করে। ফিলিপের মৃত্যুতে সেই রূপকথাতেই রেশ পড়ল এবার। শোকের ছায়া ভানুয়াতু জুড়ে। ঈশ্বরেরও যে মৃত্যু হয়— এখনও তা বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না তাঁরা…

Powered by Froala Editor

Latest News See More