ফিলিপ-এলিজাবেথের বিবাহ, সদ্য-স্বাধীন ভারত থেকে ‘জয় হিন্দ’ বার্তা মহাত্মার

১৯৩৭ সাল। জার্মানির ডার্মস্ট্যাড শহর। সেখানের রাজপথ দিয়ে হেঁটে চলেছে নতমুখ এক বছর ষোলোর কিশোর। হাত কয়েক আগেই কিছু লোক কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছে একটি কফিন। তার ভেতরেই শায়িত আছে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার দিদির মৃতদেহ। রাস্তার দু’পাশ থেকে আকাশের দিকে হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠছেন শহরবাসীরা, ‘হেইল হিটলার’। একদিকে যেমন সবথেকে কাছে মানুষটিকে হারানোর যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে ভিতর থেকে, অন্যদিকে মনের ভেতর চলছে আরেকটা হিসেব-নিকেশের অন্য এক অঙ্ক। বাবা ফ্রান্সে, মা অসুস্থ। একরকম যেন ভেঙে পড়ছে গোটা পরিবারটাই। তার ওপরে এই নাৎসি দলকে সমর্থন করা দিদিকে শেষ বিদায় দেওয়া — তাকে মেনে নেবে ব্রিটেন?

সেদিন জার্মানির রাজপথ দিয়ে হাঁটা সেই ছোট্ট কিশোরটিই ছিলেন প্রিন্স ফিলিপ। তখন কে-ই বা জানত, একদিন যে এডিনবার্গের ডিউক হয়ে উঠবেন তিনি? জীবন তখন ক্রমশ পরীক্ষা নিয়ে চলেছে তাঁকে। অবশ্য জন্মের পর থেকেই তো তাঁকে দিতে হয়েছে এই অগ্নিপরীক্ষা। বয়স মাত্র ১৮ মাস, নিজের দেশ গ্রিস ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল ব্রিটেনে। সেটা ১৯২২ সাল। তার বছর তিন আগে থেকেই চলছে তুর্কির সঙ্গে সংঘর্ষ। যার শেষটা হল অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। কোনোক্রমে রাজ পরিবারকে উদ্ধার করে একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ। অল্পের জন্য প্রাণরক্ষা। ফলের বাক্সে করেই সেই জাহাজে চেপে ইতালিতে হাজির হয়েছিলেন ছোট্ট প্রিন্স। তারপর ব্রিটেন।

শৈশব থেকে সেখানেই বড়ো হয়ে ওঠা। দিদি সিসিলের বিয়ে হয়ে যায় জার্মানিতে। তাঁর স্বামী ছিলেন নাৎসি দলের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। তবে এত দ্রুত যে বদলে যাবে সময়, তা ঠাহর করতে পারেননি কেউ-ই। ১৯৩৭ সালে একটি বিমান দুর্ঘটনায় সপরিবারে মারা যান সিসিল। পাশাপাশি তখন সারা বিশ্ব উত্তপ্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে। ছড়িয়ে পড়ছে মহাযুদ্ধের পূর্ববর্তী হিংস্রতা, বিষাক্ত সাম্প্রদায়িকতা। সেই আঁচ কাটিয়েই ব্রিটেনে ফিরলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই দেশে ফেরার পর নানান ক্ষেত্রেই তীর্যক কথা ধেয়ে আসত তাঁর দিকে। 

তবে যখন এমন টালমাটাল সময়ের মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করছেন ফিলিপ, তখন সমান্তরাল ভাবে তাঁকে নাড়িয়ে যাচ্ছে প্রেম। হ্যাঁ, খোদ রাজকুমারী এলিজাবেথের প্রতি এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। ক্রমশ বেড়ে চলেছে চিঠি চালাচালির পরিমাণ। তবে রাজকুমারীর স্পর্শ পাওয়া কি এতটাই সোজা? তাও তাঁর মতো এমন ‘উদ্বাস্তু’-র কাছে! উপায় একটাই, দেশের এই সংকটকালীন মুহূর্তে যোদ্ধা হিসাবে সামিল হতে হবে তাঁকে। সেই লক্ষ্য নিয়েই ডার্টমাউথের রয়্যাল নেভি কলেজে ভর্তি হলেন ফিলিপ। অক্লান্ত পরিশ্রম শেষ অবধি এনে দিল ‘সেরা ক্যাডেট’-এর সম্মাননাও। 

১৯৪০ সাল। কলেজের পাঠ যখন শেষ হল, তখন ডঙ্কা বেজে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। এতএব সরাসরি তাঁর জায়গা হল রয়্যাল নেভিতে। ব্রিটেন-মুলুক ছেড়ে জাহাজে পাড়ি দিলেন মুসোলিনির ইতালির উদ্দেশ্যে। একেবারে যুদ্ধক্ষেত্র। তবে ভাগ্য সঙ্গ দিয়েছিল ফিলিপের। ১৯৪১ সালের মার্চে ইতালির নৌবাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে বড়ো সাফল্য পেল রয়্যাল নেভি। কেপ মাটাপানে উড়ল ব্রিটেনের পতাকা। তবে এই জয়ের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল তরুণ নেভি অফিসার ফিলিপের সিদ্ধান্ত। 

বছর দুয়েকের মধ্যে তৎকালীন ব্রিটেনের তরুণতম রয়্যাল নেভি লেফটেন্যান্টের মেডেল জুড়ল তাঁর কাঁধে। সেই অভিপ্রেত সম্মান, নিজেকে প্রমাণ করা— লক্ষ্য সম্পূর্ণ হল যেন। সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না ফিলিপ। সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের প্রস্তাব নিয়ে পৌঁছালেন তিনি। জানালেন প্রিন্সেস এলিজাবেথকে বিবাহ করতে চান। তবে যতটা সহজ হবে ভেবেছিলেন সেই পথ, হল না তেমনটা। প্রথমেই আপত্তি উঠল তাঁর পিতৃপরিচয় নিয়ে। গ্রিক সম্রাটের পুত্র তিনি। এলিজাবেথের বিবাহযোগ্য হতে গেলে, উপাধি পাল্টাতে হবে তাঁকে। তাই মেনে নিলেন ফিলিপ। নামের পাশে বসল মাউন্টব্যাটেন। বদলাতে হল নাগরিকত্বও। তারপরেও বিবাহ নিয়ে কোনো সহমত জানালেন না সম্রাট।

তারপর আবার ফিরে যাওয়া যুদ্ধক্ষেত্রে। এবার ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। প্রতিপক্ষ জাপান। বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত জাপানের বিরুদ্ধে সামনে থেকে ব্রিটিশ নৌসেনাদের অধিনায়কত্ব করেছিলেন ফিলিপ। এমনকি জাপানের আত্মসমর্পণের সময় মাত্র ২০০ গজ দূরত্ব থেকে সেই সংবাদ প্রথম রয়্যাল প্যালেসে পৌঁছে দেন তিনি।

‘সম্রাজ্ঞী’-কে পেয়েছিলেন আরও দু’বছর পর। তখন সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে ভারত। ব্রিটেনেও মোনার্কি’র দিন ফুরিয়ে মাথাচাড়া দিচ্ছে গণতন্ত্র। এমনই এক প্রেক্ষাপটে পরিণতি পেয়েছিল রূপকথার সম্পর্ক। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ফিলিপ-এলিজাবেথ। অনেক উপহারের ভিড়ে ভারত থেকেও সেদিন পৌঁছেছিল শুভেচ্ছাবার্তা। চরকায় বোনা সুতো দিয়ে তৈরি উত্তরীয়তে ‘জয় হিন্দ’ লিখে পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং গান্ধীজি।

তবে নিজেকে প্রমাণ করার এই লড়াইটা শেষ হয়ে যায়নি সেদিনও। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরের পর থেকে ডিউকের সিংহাসনে বসলেও এলিজাবেথের ছায়াতেই থাকতে হয়েছে তাঁকে। রাজা বা সম্রাট হয়ে ওঠা হয়নি কখনোই। তবে ৯৯ বছরের জীবনেই ধরে রেখেছিলেন অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্বকে। এক ছক-ভাঙা বৈপরীত্যকেও। রানির মুকুট এলিজাবেথের মাথাতে থাকলেও শক্ত হাতে রাজপরিবারকে চালিয়ে গেছেন ফিলিপ। দেশের প্রথম মোনার্ক হিসাবে টেলিভিশন সাক্ষাৎকার থেকে শুরু করে, ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে তাঁদের দাবি শোনা, নিজস্ব এক স্টাইল-স্টেটমেন্ট— সব ক্ষেত্রেই যেন অচলায়তনের নিয়মকে মুছে দিয়েছিলেন তিনি। নিজেকে করে তুলেছিলেন ব্রিটেনের চিরাচরিত শাসকদের থেকে একেবারে ভিন্ন। বিতর্ক, সমালোচনা যে নেই তাঁকে নিয়ে, এমনটা একেবারেই নয়। তবে তাঁর কাছে এই একুশ শতকের ব্রিটেনের ঋণ রয়ে গেছে অনেকটাই। নীরবে আড়ালের থাকা সেই মানুষটা কৃতিত্বকে অস্বীকার করা যায় কীভাবে?

Powered by Froala Editor

More From Author See More