ভোট আসতে যাবতীয় দুশ্চিন্তা ঘুচে গেল অনিলদার

(ভোট চলছে বঙ্গে। কিছুকাল আগে পর্যন্ত এঁদের সরব উপস্থিতি ব্যতিরেকে বঙ্গে ভোট-রঙ্গের কথা ভাবাই যেত না। তাঁরা নেই, আবার আছেনও, আমার স্মৃতি ও সত্তায়। তেমনই কয়েকজন বঙ্গ-রাজনীতির মহারথীদের নিয়ে আমার এই সিরিজ। প্রথমে অনিল বিশ্বাস।)

২০০১ সালের বিধানসভা ভোটের ছয় মাস আগে পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বদল ছিল সিপিএমের মাস্টার স্ট্রোক৷ অন্তরালে এমন একটি সুচতুর পরিকল্পনা অবশ্যই ছিল খর্বকায়, ক্ষীণতনু চাণক্যের মস্তিষ্কপ্রসূত৷ মানে কমরেড অনিল বিশ্বাস৷

সেই ভোটের ফলাফল দেখে ভোট-পূর্ববর্তী চ্যালেঞ্জের সঠিক ধারণা করা সম্ভব নয়, যদিও সত্যটা হল বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছরের জমানায় ২০১১-র বিধানসভা ভোটের আগে একমাত্র তার দশ বছর আগের ভোটেই সিপিএম অনেকটা ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল৷ রাজ্যজুড়ে উঠেছিল পরিবর্তন আনার জিগির, রাজ্যের মিডিয়া সেই সম্ভাবনাকে কুলোর বাতাস দিয়ে আরও জোরদার করে তুলেছিল৷ ভোটের প্রাক্কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্য কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধার পরে বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ কাগজে-কলমে অন্তত নতুন ব্যঞ্জনা পেয়ে গিয়েছিল৷ ঠিক সেই সময় মুখ্যমন্ত্রীর মুখটি বদলে দিয়ে সিপিএম যে অঘোষিত বার্তাটি পৌঁছতে চেয়েছিল তা হল ভোটের আগেই যখন আসল জায়গাটিতে পরিবর্তন সাধন করা হয়ে গিয়েছে তখন আর সরকারের পরিবর্তনের প্রয়োজনটি কোথায়? বসুর জায়গায় বুদ্ধদেব এসেছেন, পরিবর্তন তো হয়েই গেল!

জ্যোতি বসুর অনুপস্থিতি, দলের অভ্যন্তরে ধূমায়িত বিক্ষোভ, বাইরে প্রধান প্রতিপক্ষদ্বয়ের অপ্রত্যাশিত জোট-বন্ধন বেজায় চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদককে৷ চাপা স্বভাবের মানুষ, স্বল্পবাক অনিলদাকে দেখে বোঝা যেত না ভিতরের উদ্বেগের গভীরতা৷ তিনি বিড়ি-সিগারেট খেতেন না, নস্যি নিতেন৷ টেনশনে পড়লে নস্যি নেওয়ার ফ্রিকোয়েন্সি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যেত৷ সেই নির্বাচনে মালিকের আদেশে দুই কংগ্রেসকে কাছাকাছি আনার কাজে আমারও যে একটা ভূমিকা ছিল, অনিলদা তা জানতেন৷ কিন্তু এ নিয়ে তখন বা তারপরে তিনি মুখ ফুটে আমাকে কিছু বলেননি৷ তবে ঠারেঠোরে সে সময় তাঁর বিবিধ মন্তব্য শুনে বেশ বুঝতে পারতাম তিনি যারপরনাই বিরক্ত৷ ভোটের ফলাফলে যাবতীয় দুশ্চিন্তা মুছে যাওয়ার পরে একদিন হাসতে হাসতে টেলিফোনে অনিলদা ব্যঙ্গ করেছিলেন, ‘তোমরা সবাই মিলে এত চেষ্টা করলে তবু পারলে না তো?’ লজ্জায় প্রত্যুত্তরে কোনো কথাই বলতে পারিনি সে যাত্রায়৷ 

সুভাষ চক্রবর্তীকে আটকে দিয়ে দলে বড়সড় ভাঙন রুখে দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু৷ তার আট বছর পরে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে জ্যোতিবাবুর যে রকম নীরব সমর্থন ছিল, সুভাষ চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল উল্টোটা৷ ইন্দিরা ভবনে ডেকে পাঠিয়ে সুভাষবাবুকে তিনি যে শুধু ভর্ৎসনা করেছিলেন তাই নয়, টেলিভিশন সিরিয়ালের ভাষায় যাকে বলে ‘ইমোশোনাল অত্যাচারের’ মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন৷ দলের ভীষ্ম পিতামহ, নিজের আরাধ্যের সেই অনুরোধ সুভাষবাবু ফেলতে পারেননি৷ অন্য বিক্ষুব্ধদের গাছে তুলে দিয়ে তিনি যে তলা থেকে মইটা সরিয়ে নিচ্ছেন সেই অপরাধবোধও হার মেনেছিল সুভাষের জ্যোতি-অনুরাগের কাছে৷ তাতে ভোটের মুখে সিপিএমের বিপন্নতাবোধ অনেকাংশে কমে গিয়েছিল, সমপরিমাণে অনাথ বোধ করেছিলেন সইফুদ্দিন-সমীর জুটি৷ তাঁদের কাছে সুভাষ চক্রবর্তীর পাল্টি খাওয়াকে মনে হয়েছিল একেবারেই মীরজাফরি৷

আরও পড়ুন
যাব যাব করেও সুভাষ থেকে গেলেন

পরে সইফুদ্দিন চৌধুরীর মুখে শুনেছি, তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সমীর পুততুন্ডর বাড়িতে বিক্ষোভের বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন সুভাষ চক্রবর্তীই৷ তিন কমরেডের সেই প্রথম গোপন বৈঠকেই ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে বিশদে আলোচনা হয়েছিল, দলের কোন কোন বিধায়ক বা কমরেডকে সঙ্গে পাওয়া যেতে পারে তার তালিকা প্রস্তুত হয়েছিল, এমনকি কীভাবে নতুন দলের তহবিল সংগ্রহ হবে সুভাষবাবু তারও একটা ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন৷ উল্লসিত সফি-সমীরের তখন মনে হয়েছিল সুভাষবাবু তাঁদের সঙ্গে থাকলে একটা অর্থবহ চ্যালেঞ্জ অবশ্যই খাড়া করা যাবে৷ তারপরেও বেশ কিছুদিন পূর্ণ উদ্যমে নতুন দল গড়ার কাজে সময় ব্যয় করেছিলেন সুভাষবাবু৷ সমমনোভাবাপন্ন অনেক কমরেডের সঙ্গে গোপন আলোচনাও শুরু হয়ে গিয়েছিল৷ সিপিএমের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা কমিটির বেশ কিছু সদস্যের সক্রিয় সমর্থনের আশ্বাসও পেয়েছিলেন তাঁরা৷

সুভাষ চক্রবর্তী যে তাঁদের চাগিয়ে দিয়ে নিজে গোপনে দলের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছেন সমীর পুততুন্ডই প্রথমে সে কথা জানতে পারেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে গিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলার সময়৷ সেই আলোচনার মাঝখানেই বুদ্ধবাবু বলেন, ‘জ্যোতিবাবু জানিয়ে দিয়েছেন, সুভাষ তাঁকে দল ছাড়বে না বলে কথা দিয়েছে৷ সেক্ষেত্রে তুমি কী করবে?’ হতভম্ব সমীর কোনো জবাব দেননি, সুভাষবাবুর বদলে সফির সঙ্গে থাকাটাই শেষ পর্যন্ত মনস্থ করেছিলেন৷ যদিও সুভাষবাবুর আকস্মিক ভোলবদল তাঁদের যাবতীয় হিসেবনিকেশ ওলটপালট করে দিয়েছিল, অনেক কমরেডই হতোদ্যম বোধ করে এক পা এগিয়েও শেষ পর্যন্ত দু’পা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ পিডিএস নামে যে নতুন দলটি সিপিএম ভেঙে তৈরি হয়েছিল রাজ্যের রাজনীতিতে তা কখনওই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি৷ সইফুদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পরে সে দলে কোনোমতে শিবরাত্রির সলতেটুকু জ্বালিয়ে রেখে চলেছেন পুততুন্ড দম্পতি৷

আরও পড়ুন
অনিল বিশ্বাস : বঙ্গ রাজনীতির চাণক্য

২০০১-এর বিধানসভা ভোটের আগে দলে বড়সড় ভাঙন হতে দেননি জ্যোতি বসু৷ আর দুই কংগ্রেসের ঐক্য ব্যালটবাক্সে বাস্তবায়িত হতে পারেনি জোট নিয়ে কংগ্রেসের একটা বড় অংশের সক্রিয় বিরোধিতার কারণে৷ সেই বিক্ষোভের নাটের গুরু ছিলেন সোমেন মিত্র৷ সেদিক থেকে দেখতে গেলে জ্যোতি বসুর শূন্যস্থানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নাটকীয়ভাবে নিয়ে আসাটা যদি অনিল বিশ্বাসের মোক্ষম চাল হয়ে থাকে তাহলে অন্য ফ্রন্টগুলিতে সঙ্কটের নিরসনে তাঁর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা ছিল না৷ ফলে দলে ভাঙন রোধ অথবা ভোটে অপ্রত্যাশিত সাফল্য, দুটোর কোনোটারই কারিগর তিনি নন, ইতিহাস তাঁকে সেই কৃতিত্ব দেবেও না৷

১৯৯৮ সালে সীতারাম কেশরীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ছেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নিজের দল গড়েন, সনিয়া গান্ধী তখনও সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেননি৷ সোমেন-মমতার তৎকালীন বিরোধে সনিয়া সেভাবে হস্তক্ষেপ করেননি, যদিও প্রয়াত স্বামী রাজীবের মতো বাংলার এই নেত্রীর প্রতি তাঁরও বিশেষ দুর্বলতা ছিল৷ মমতা কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে যান সনিয়া সেটা চাননি এবং সেই কারণেই ২০০১-এর রাজ্য বিধানসভা ভোটের সময় যখন তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জোটের প্রস্তাব এল ততদিনে কংগ্রেস সভানেত্রী হয়ে যাওয়া রাজীব-পত্নী যে কোনো মূল্যে তার সদ্ব্যবহার করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন৷ মমতাও তার ফায়দা তুলেছিলেন পুরোদস্তুর৷

আরও পড়ুন
জোট-ঘোঁট-ভোট (২)

তৎকালীন রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে, তাঁদের মতামতের তোয়াক্কা না করে একটা জোট উপর থেকে চাপিয়ে দিয়েছিলেন৷ জোটের প্রস্তাব নিয়ে মমতার সঙ্গে আলোচনা করতে গোপনে কলকাতায় এসেছিলেন কমলনাথ, তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে দর-কষাকষিতে তিনি এঁটে উঠতেই পারেননি৷ ফলে কংগ্রেসের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে, এমনকি বেশ কয়েকজন নির্বাচিত বিধায়কের আসন তৃণমূলকে ছেড়ে দিয়ে তিনি সমঝোতা করেছিলেন মমতার সঙ্গে৷ রাজ্য কংগ্রেসের স্বার্থের চেয়ে কমলনাথের কাছে তখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সনিয়া গান্ধীর ম্যান্ডেট - আই ওয়ান্ট অ্যালায়েন্স উইথ মমতা এট এনি কস্ট৷

মমতার সঙ্গে আলোচনা করতে কমলনাথ প্রথমবার কলকাতায় এসেছিলেন সম্পূর্ণ গোপনে, রাজ্য নেতাদের কেউ সে খবরটুকু পর্যন্ত জানতেন না৷ প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি কিংবা সোমেন মিত্র দূরস্থান, বরকত সাহেব বা প্রণববাবুকেও রাখা হয়েছিল অন্ধকারে৷ তাঁদের পাশ কাটিয়ে দিল্লি মমতার সঙ্গে কথা বলতে লোক পাঠিয়েছে, এই খবরটি অবশ্যই রাজ্য নেতারা প্রসন্ন মনে মেনে নিতে পারেননি৷ কিন্তু হাইকমান্ড নামক জুজুর ভয়ে তাঁরা সবাই স্পিকটি নট হয়েই বসেছিলেন৷ বিশেষ করে তখন সনিয়া গান্ধীর জমানা কংগ্রেসে সবে শুরু হয়েছে, তাঁর চিন্তা-ভাবনা, কর্মপদ্ধতি, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কারুরই তেমন স্বচ্ছ ধারণা নেই৷ ফলে সে সময় ভয়টা ছিল আরও বেশি৷

আরও পড়ুন
জোট-ঘোঁট-ভোট (১)

অনেক দরকষাকষি করেও কমলনাথ শেষ পর্যন্ত অনমনীয় মমতার কাছে নতি-স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ বাস্তবে তাতে হিতে বিপরীতই হয়েছিল, দুই দলের জোট কার্যত রাজ্যের কোথাও তৃণমূল স্তরে সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি৷ হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে অখুশি অনেক কংগ্রেসি নেতাই যে যাঁর মতো করে গোঁজ প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়ে জোটের বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিয়েছিলেন৷ সোমেন মিত্রর বেশ কয়েকজন অনুগামী হঠাৎ শারদ পাওয়ারের দলে নাম লিখিয়ে সেই দলের প্রতীক নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন৷ অতএব কাগজে কলমে জোট-সঙ্গী হলেও ভোটের সময় দুই কংগ্রেসকে মনে হচ্ছিল ডিভোর্সের মামলা রুজু করে দেওয়া দম্পতি৷ সিপিএমকে হারানোর বদলে পরস্পরকে হারানেটাই হয়ে উঠেছিল মূল লক্ষ্য৷

দিল্লিতে বসে সনিয়া গান্ধী সেটা টের পাননি৷ কিন্তু আলিমুদ্দিনে বসে পরিস্থিতির ওপরে সতর্ক নজর রাখা অনিল বিশ্বাস অবশ্যই পেয়েছিলেন৷ ফলে ভোটের মাস খানেক আগেও তাঁর কপালে ফুটে ওঠা দুশ্চিন্তার বলিরেখাগুলো মিলিয়ে যেতে দেখেছিলাম ভোট শুরু হয়ে যাওয়ার পরেই৷ প্রত্যাশিতভাবেই বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ষষ্ঠবারের জন্য বামফ্রন্ট মহাকরণে ফেরার পরে এক রাতে দেখা করতে গিয়েছিলাম অনিল বিশ্বাসের ফ্ল্যাটে৷ সে রাতে তিনি আমাকে চাইনিজ খাওয়ার নেমন্তন্ন জানিয়ে ছিলেন৷ কথায় কথায় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা অনিলদা আপনি সনিয়া গান্ধীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন?’

হো হো করে হেসে উঠলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক৷ তারপর পাল্টা রসিকতা করে বললেন, ‘তোমার একটু ভুল হয়ে গেল৷ আমার উচিত সোমেন মিত্রকে ধন্যবাদ দেওয়া৷’
বিধানসভা ভোটের ফলই প্রমাণ করে দিয়েছিল, রাখে সোমেন সিপিএমকে মারে কে?

Powered by Froala Editor