‘ঘোড়া ট্রেন’ এবং স্যার গঙ্গারাম, ইতিহাসের অতলে এক আশ্চর্য যাত্রা

বড়ো রাস্তার পাশে সরু একটা রেললাইন। ওপাশে জলাজমিতে ঘাসের জঙ্গল। লাইন ধরে সোজা তাকালে দেখা মিলবে একটা লাল রংয়ের স্টেশনেরও। ওই এবার ধুলো উড়িয়ে আসছে ট্রেন। যাত্রীগণকে অনুগ্রহ করে কেউ লাইনের পাশ থেকে সরে দাঁড়াতে না বললেও সাবধানের মার নেই। কিন্তু, একি! কু-ঝিকঝিক শব্দ নেই, হাজারো লোকের ভিড় নেই। বরং একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ি আসছে লাইন ধরে। সাকুল্যে ১৫-২০ জন যাত্রী, সঙ্গে কিছু মালপত্র। আজ্ঞে হ্যাঁ, এটিই পাকিস্তানের (Pakistan) বিখ্যাত ‘ঘোড়া ট্রেন’ (Ghoda Train)। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত সে দেশের ফয়সলাবাদের গঙ্গাপুর (Gangapur) গ্রামে নিয়মিত দেখা মিলত এই ট্রেনের।

কলকাতায় একসময়ে ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। আর পাকিস্তানের বুচিয়ানা-গঙ্গাপুরের মধ্যে একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে চালু ছিল ‘ঘোড়া ট্রেন’। অবশ্য একসময়ে ইউরোপে ঘোড়ায় টানা ট্রেন ব্যাপারটি একেবারে অচেনা ছিল না, কিন্তু পাকিস্তানের এই অঞ্চলের বিষয়টি ছিল আলাদা। নেপথ্যে রায়বাহাদুর স্যার গঙ্গারাম আগরওয়ালের (Sir Gangaram Agarwal) কারিগরি দক্ষতা এবং সদিচ্ছা। কে তিনি? আর আজকের পাকিস্তানের ঘোড়া ট্রেনের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্রই বা কি? তার জন্য ফিরে যেতে হবে অবিভক্ত ভারতের ইতিহাসে। ১৮৫১ সালে পাঞ্জাবের মাংতানওয়ালা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতার কর্মসূত্রে পরে চলে আসেন অমৃতসরে। রুরকির কলেজ থেকে বৃত্তিসহ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষে নিযুক্ত হন ব্রিটিশ সরকারের পূর্তবিভাগে। উদ্ভাবনী দক্ষতা আর কর্মক্ষমতার জন্য দ্রুত উন্নতি হতে থাকে কর্মক্ষেত্রে। লাহোর শহরের একাধিক স্থাপত্য, কলেজ, হাসপাতাল ও সরকারি দপ্তর নির্মাণের পিছনে রয়েছে তাঁর কারিগরি বুদ্ধি। এমনকি রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের ভারত আগমনের সময় দিল্লির রাজদরবার দেখভালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁর উপরে। ১৯০৩ সালে ‘রায়বাহাদুর’ সম্মানে ভূষিত হন তিনি এবং সে বছরই স্বেচ্ছায় অবসর নেন কাজ থেকে। 

তাঁর হাতে তখন অঢেল সময়। একটা ইচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই চাপা ছিল মনের মধ্যে। গ্রামে ফিরে সর্বস্ব ঢেলে দেবেন চাষবাসের কাজে। মনের মতো করে সাজিয়ে তুলবেন রুক্ষ অঞ্চলটিকে। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের সূত্রে পেয়ে গেলেন ৫০০০০ একর জমি। মাত্র তিন বছর, তার মধ্যেই আমূল বদলে গেল জায়গাটি। বালিতে ঢাকা অঞ্চলে মাথা দুলিয়ে দিল সবুজ ফসল। জল তোলার জন্য বসানো হল পাম্প, মাইলের পর মাইল খাল কেটে জল আনার ব্যবস্থা করলেন নিজের খরচে। সেই সময় ব্রিটিশ সরকার থেকে অনুদান দেওয়া হল আরো ৫০০ একর জমি। সেখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন গঙ্গাপুর গ্রাম। আধুনিক কৃষিবিদ্যার সমস্ত সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ফার্ম বলা যায় তাকে। কিন্তু এই সব ভারী মালপত্র নিয়ে আসা কিংবা ফসল পাঠানোর জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা চাই। আবার তাঁর মাথায় খেলে গেল সেই বিখ্যাত কারিগরি বুদ্ধি। গঙ্গাপুর থেকে বুচিয়ানা পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রাস্তায় বিছিয়ে দিলেন রেললাইন। ইঞ্জিনের প্রয়োজন নেই, ঘোড়া দিয়েই টানা হবে সেই ‘ট্রেন’। 

গঙ্গারাম মারা যান ১৯২৭ সালে। তারপর স্বাধীনতা এসেছে, দেশভাগ হয়ে ফয়সলাবাদ চলে গেছে পাকিস্তানে। তারপরেও প্রায় আটের দশক পর্যন্ত সচল ছিল ‘ঘোড়া ট্রেন’। অযত্ন, অবহেলা, সরকারের সদিচ্ছার অভাব এসব তো ছিলই, মাঝে একসময় চুরি হয়ে যায় রেললাইনের বেশ কিছু অংশ। বন্ধ হয়ে যায় রেল পরিষেবা। ২০১০ সালে গ্রামবাসীদের উদ্যোগে ও সরকারি পরিচালনায় পুনরায় চালু করা হয় ট্রেনটি। যদিও তখন পাকা রাস্তা দখল করে নিয়েছে তার কার্যভার। ফলে বছর তিনেকের মধ্যে ফের বন্ধ হয়ে যায় ‘ঘোড়া ট্রেন’। লাল রঙের স্টেশনটি আজও সাক্ষ্য দিচ্ছে গঙ্গারামের উদ্ভাবনী শক্তির। কাছের স্টেশনে ভাঙা কাঠামোটা দাঁড়িয়ে আছে মমির মতো। ‘স্যার’ গঙ্গারামের সাধের ট্রেনযাত্রা উপমহাদেশের আর পাঁচটা ঐতিহাসিক নিদর্শনের মতো ধুলো মেখে গুনছে শেষ দিনগুলি।

আরও পড়ুন
ঘোড়ার পিঠে চেপে ৬০ ফুট উঁচু মঞ্চ থেকে ঝাঁপ, যে আশ্চর্য স্টান্ট দেখতে ভিড় জমাত মানুষ

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
পর পর সাজানো একের পর এক ঘোড়ার কঙ্কাল, কোথায় রয়েছে এই সমাধি?