বিপ্লব অসমাপ্ত রেখে, রেসের মাঠেই ঘুমিয়ে পড়েছে বুনো ঘোড়া

সেইসব পাড়া টারা – ৮

আগের পর্বে

কলকাতার যে সময়ের কথা হচ্ছে তখনও বিয়েবাড়ি চেনেনি ক্যাটারিং, ভাড়াবাড়িকেও। পরিবেশনের দায়িত্ব সামলাত পাড়ার ছেলেরাই। এই কাজে রীতিমত নাম ডাক ছিল গড়পারের পিকলুকাকুর। পাড়ার শৈলেশজ্যাঠার মেয়ের বিয়েতেও ডাক পড়ল তার। কিন্তু পাড়া-বেপাড়ার সখ্যতা মেটাতেই বালতির পর বালতি মাংস হাওয়া করতে লাগল পিকলুকাকু। এই হাহাকারে সাধনকাকার টনক নড়লে। তাকেও পিকলুকাকু বোঝালো অনামন্ত্রিতদের জন্যই এই সমস্যা। তারপরেই ঘটে গেল এক বিপত্তি। উত্তর কলকাতার এই গল্পের পর আজ থেকে সরে আসা উত্তরের শহরতলির গল্পে...

সারি সারি ছ্যাঁচাবেড়ার ক্ষুদ্র সব কুঁড়েঘর। শীতসন্ধ্যার ঠিক প্রাক্কালে প্রতিটি গৃহের মাথায় হরিৎবর্ণ অলাবুলতা শোভিত টালির চালের ছিদ্র দিয়া বাহির হইয়া আসা ঘন ধূম্রজাল আকাশে উঠিবার মত শক্তি সঞ্চয় করিতে না পারিয়া গৃহের মাথাতেই জমাটবদ্ধভাবে অবস্থান করিতেছে। গৃহসমূহের পাশেই ড্রেন থুড়ি পঙ্কপূর্ণ কাঁচা নর্দমা হইতে উঠিয়া আসা বিকট গন্ধ। যাহা অনভ্যস্ত নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করিলে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠিয়া আসাটাই অতি স্বাভাবিক। এই পল্লীতে কোথাও বিদ্যুৎ নাই। ফলে ছ্যাঁচাবেড়ার ফাঁক দিয়া পিছলাইয়া বাহির হওয়া কুপি অথবা লন্ঠনের ক্ষীণ আলো। জলের ব্যবস্থা বলিতে গোটাচারেক সরকারি টিউবওয়েল এবং একটি এজমালি পুষ্করিণী। সেই পুষ্করিণী হইতে এই শীতসন্ধ্যার মুখে নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতেছে পল্লীর কোন কোন গৃহস্থের হংসকূল। তাহাদের অনুসরণকারী গৃহিণীরা। দক্ষিণহস্তে সদ্য ধৌত দুইচারিটি বাসনপত্র। নিজদিগের মধ্যে সংসার সংক্রান্ত এবং আরো নানাবিধ বিষয়ে আলোচনা করিতে করিতে চলিয়াছেন তাহারা। যাহার মধ্যে কিঞ্চিৎ পি এন পি সি অর্থাৎ পরনিন্দা পরচর্চাও রহিয়াছে। কোন কোন গৃহ হইতে ভাসিয়া আসা ‘হরি হরায় নম বিষ্ণু’ - যৌথ কীর্তনের সুর অথবা সিঙ্গল রিড হারমোনিয়াম সহযোগে বিবাহযোগ্যা যুবতীকণ্ঠে রবিঠাকুর - ‘তোমরা যে বল দিবসরজনী ভালোবাসা ভালোবাসা…’। উপরোক্ত এইসমস্ত দৃশ্যপটের সমন্বয় মানেই - শহরতলির বেজায় দরিদ্র এবং একইসঙ্গে বাঁচিয়া থাকার লড়াইয়ে সদাসর্বদা প্রস্তুত সব কলোনিপাড়া।

ষাটের দশকের একদম শেষভাগে আমি যখন প্রথম দমদমে যাই, ওখানকার অবস্থা তখন হুবহু ওইরকম। আজো স্পষ্ট মনে আছে প্ল্যাটফর্মের গায়ে বিশাল কলোনি এলাকাটা যেখানে শেষ হচ্ছে তার গোটাদুয়েক বাড়ি পরেই আমাদের নতুন ভাড়াবাড়ি। বাড়ির নাম বসু ভবন। ওপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল হয়ে এসেও যে সামান্য কিছু পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি সেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি এই বোস পরিবার তাদের মধ্যে অন্যতম। বাড়িওয়ালা সত্য বোসের যৌথ পরিবার। ছয় ছেলে, পেশাগত জীবনে প্রায় সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। মতাদর্শগত ভাবে প্রত্যেকে বামপন্থী। নরম থেকে চরম কট্টরপন্থী, সবাই আছে সেই দলে। এদের মধ্যে একমাত্র বেকার ছোট ভাই মলয় বসু। ডাক নাম স্ট্যালিন। আরো সংক্ষেপে টালু, বাঙালপাড়ার উচ্চারণে ‘টাউল্যা’। রাজনীতির সুবাদে আমার পিতৃদেবের সঙ্গে পরিচিতি অনেক আগে থেকেই। এহেন টালুদাকে যখন প্রথম দেখি তখন টালুদা সদ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েছে কলকাতার নামী একটা কলেজ থেকে। ছিপছিপে একহারা চেহারা। পরনে সদাসর্বদা কনুই অবধি হাতাগোটানো চেককাটা টুইল অথবা সুতির ফুলশার্ট। খাড়া নাকের নীচে স্ট্যালিনের মতই একজোড়া পাকানো মোটা মোচ। একটা জাঁদরেল ৫৫০ সি সি-র রয়াল এনফিল্ড মোটরবাইক নিয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে গোটা এলাকা। এলাকার যত কংগ্রেসি আর ফরোয়ার্ড ব্লকের বাঘা বাঘা সব মস্তান, খতরনাক সব ওয়াগন ব্রেকার, তারকাটা গ্যাং থেকে নিয়ে ট্রেনের ছিঁচকে ছিনতাইবাজ, সবার রক্ত ঠান্ডা হয়ে যেত টালুদার নাম শুনলে। টালুদা, মুখে সর্বদা লেগে থাকা ভারি মিঠে আর নিশ্চিন্ত একটা হাসি। সো-কলড কেরিয়ার টেরিয়ার নিয়ে তেমন একটা ভাবিত নয়, ওই হাসিতেই বোঝা যেত সেটা। প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা এলাকা জুড়ে। বিশেষত কলোনিগুলোয়। কলোনির ডাকাবুকো সব জুনিয়ার ছেলেরা, মিত্যুনদা, দীপুদা, দিলীপদা, বেচাদা, শ্যামদা - ডাই হার্ড ফ্যান টালুদার। অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছোড়দা শ্যামল চৌধুরী, কমলদা (গোগনা), বাপিদা, অমলদা, সন্তাদা, বুলুদা, বিকাশদা, শঙ্করদা, গৌড়াদা,এরকম আরো অনেকে। এরা প্রত্যেকেই সেই খাদ্য আন্দোলনের সময় মজুতদারদের গুদামে হানা দিয়ে জমিয়ে রাখা চাল-গম-তেল বের করে এনে বিলিয়ে দিয়েছিল কলোনির গরিব মানুষজনের মধ্যে (যা আজও দমদম দাওয়াই নামে পরিচিত)। মাড়োয়ারিবাগান, শেঠবাগান, পেয়ারাবাগান কলোনি, আটাপাড়া, রঙকল, সাউথ সিঁথি, কালীচরণ ঘোষ রোড, সেভেন ট্যাঙ্কস লেন, এম সি গার্ডেন রোডের ছেলেপুলে সব।  

এরকম বিশাল একটা দল। এদের ফিউচার প্ল্যান কি, মানে ভবিষ্যতে কি করতে-টরতে চায় আর কি, এসব নিয়ে সেই বয়সেই কিরকম একটা ধোঁয়াশাপানা ছিল মনের মধ্যে। সেটা প্রথম একটু কাটলো চার নং প্ল্যাটফর্মের বিশাল উঁচু লাল ইঁটের পাঁচিলটার গায়ে টালুদাদের একটা পোস্টার মারতে দেখে। খবরের কাগজের ওপর গাঢ় লাল (সম্ভবত আলতা) লেটারহেডে লেখা -

রঙকল ও প্রাচ্য বাণীমন্দিরের মাঠে পরপর তিনদিন!
বিশেষ নাটক ও যাত্রানুষ্ঠান।
তীর - পি এল টি
রাইফেল - ঐ
লেনিন - তরুণ অপেরা
তাং - … হইতে ...

আরও পড়ুন
খাওয়ার মাঝখানে বরের মামাকে কান ধরে টেনে তুললেন সাধনকাকা, তেড়ে এল বরযাত্রীরা

পোস্টারটা পড়ে খুব একটা যে কিছু বুঝেছিলাম, তেমনটা নয়। তবে কেন জানি না কোথাও ওই নামগুলো বেজায়  টানছিলো আমাকে, চুম্বক যেভাবে লোহাকে টানে। বারবার মনে হচ্ছিল সেই একঘেয়ে ছকে বাঁধা কোন ব্যাপারস্যাপার নয়, নতুন কিছু একটা করতে চাইছে ওরা। ফলে মিত্যুনদা দীপুদাদের হাত ধরেই আমার প্রথম ওইসব কলোনিপাড়াগুলোয় ঢুকে পড়া। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। একটা সম্পূর্ণ অন্যধরনের যাপনচিত্র। উত্তর কলকাতার পুরনো পাড়ার সঙ্গে যার প্রায় কিছুই মেলে না। জীবনে প্রথম দেখা এজমালি টাইমকলে জলের জন্য কোয়ার্টার মাইল লম্বা লাইন। লাইনে সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে বেধে যাওয়া ধুন্ধুমার চুলোচুলি মারামারি। আবার পরমুহূর্তেই একে অন্যের বিপদে এককাট্টা সব্বাই। ছোটো ছোটো ঝুপড়ি চায়ের দোকানে চা-বিস্কুট-বিড়ি সহযোগে বেকার বেমতলব সব গরিবগুর্বো নিম্নবিত্ত মানুষজনের আড্ডা। ক্ষোভ, সুখদুঃখের আদানপ্রদান, সহমর্মিতা, পাশাপাশি একইসঙ্গে গায়ে গায়ে লেগে থাকা অসূয়া, পরশ্রীকাতরতা, যা কখনো কখনো চুড়ান্ত রসবোধসম্পন্নও বটে। সেসবের দুয়েকটি নমুনা পেশ করি এখানে। 

মাড়োয়ারিবাগান কলোনির সুবলকাকা। চাকরি করেন স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনে। কন্ডাক্টার। সুবলকাকার ছেলে বাসুদা। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিল ফার্স্ট ডিভিশনে, দু সাবজেক্টে লেটার পেয়ে। কলোনির ইতিহাসে প্রথম এবং তখনকার দিনে বিশাল ব্যাপার। পুত্রের এহেন সাফল্যে চরম উচ্ছসিত সুবলকাকা একটা এইচ এম টি সুজাতা ঘড়ি কিনে দিয়েছিলেন বাসুদাকে। তখনকার বাজারে যদ্দূর মনে পড়ে দাম সম্ভবত সত্তর কি পঁচাত্তর টাকা। পরদিন সন্ধেবেলা শিবুর চায়ের দোকানের আড্ডায় এ নিয়ে ধরা হল সুবলকাকাকে। আড্ডায় সবচেয়ে প্রবীণ জীবনজ্যাঠা বিড়িতে চোঁ করে একটা মোক্ষম টান মেরে ঘুরে তাকালেন সুবলকাকার দিকে - “সুবল, পোলারে হুনলাম (শুনলাম) ঘড়ি কিইন্যা দিছ?’ “হ, পোলাডা-য় চাইল, তাই...।” একটু বাধোবাধো গলায় উত্তর দিলেন সুবলকাকা। জবাবে ত্যারচাটে একটা হাসি জীবনকাকার বিড়িধরা ঠোঁটের কোণে। “পোলায় চাইলেই দিতে হইবো? হ্যারপর (এরপর) পুলায় যদি কয় - ‘আমার হ্যালেন(হেলেন) চাই, ম্যাইনট্যাইন(মেইন্টেইন) করতে পারবা তো?” 

আরও পড়ুন
কে সি দাসের দোকানে নিয়ে গিয়ে রসগোল্লা খাওয়াল ‘কিং কং’

এরপরের ঘটনাটিও কিছু কম চিত্তাকর্ষক নয়। প্রত্যেক পাড়াতেই এমন কিছু অভিভাবক থাকেন যারা কখনোই তাদের নিজের ছেলেমেয়েদের দোষ দেখেন না, শত অন্যায় করলেও। দমদমও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এরকমই এক কলোনির বাসিন্দা শ্রীদাম সাহা। নিজের ছেলে রুনুর দোষ দেখতে পেতেন না কিছুতেই। আগেভাগেই ছেলের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে এসে বলতেন - “তুই হালায় নিশ্চয়ই আগে কিছু করছিলি। আমার পোলায় কুন দোষ করতেই পারে না।” এই শুনতে শুনতে একদিন কলোনির ভজা। রুনুরই বয়েসি, বেজায় ক্ষেপে গেল দুলালবাবুর ওপর। “দ্যাহেন কাকা!” বলে ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে নিয়েছিল রাস্তায় পড়ে থাকা একটা ছেঁড়া কাগজের টুকরো। তারপর ফের চেঁচিয়ে উঠেছিল হেঁড়েগলায় - “যদি বেশি পকড়পকড় করবেন তা হইলে এই আপনের পোলারে ধরলাম আর এই ছিইড়্যা ফ্যালাইলাম।” কথা শেষ করেই পড়পড় করে ছিঁড়ে ফেলেছিল কাগজটাকে।

এই কলোনি স্মৃতির কত ছোট ছোট টুকরো এই এতদিন বাদেও কোন গভীর থেকে যেন টুকটাক ভেসে ওঠে আজও। কোন কোন বাড়ির সেইসব যুবতীরা, সেজেগুজে রোজ সন্ধে ছটা-দশ বা ছটা-কুড়ির আপ শেয়ালদা লোকাল ধরতেন যারা। ওদের সবারই নাকি নার্সিং হোম বা হাসপাতালে শুধু নাইট ডিউটিই থাকত। ওরই পাশাপাশি দেখা, দু-তিনটে টিউশনি আর ঘরগেরস্থালির ঝক্কি সামলে বি এ পার্ট-টুর প্রস্তুতি নিচ্ছে কোনো অপরাজিতা বীরাঙ্গনা। অভাবের তাড়নায় কিভাবে চোলাইবিক্রেতা বনে যাওয়া একদা কুমিল্লায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অঙ্কশিক্ষক অনাথবাবু, আর কোনভাবেই টিকে থাকার আর কোন রাস্তা না পেয়ে কলোনির ডাকাবুকো ছেলে লঙ্কার কুখ্যাত ওয়াগন ব্রেকার হয়ে ওঠা... আজো স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে - কলোনির সরু সরু অলিতে-গলিতে সেইসব সস্তা লোকাল ট্রেন লজেন্স আর উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধওয়ালা মশার ধূপের কারখানা। ঘরে ঘরে মা-বোনেদের ঠোঙা বানানোর কুটির-শিল্প। কখনোই হাল না ছাড়া ছিন্নমূল মানুষের দুর্দমনীয় বাঁচার চেষ্টা। এদিকে ক্রমশ ঘোরালো ওঠা সময়। প্রতিনিয়ত পাল্টে পাল্টে যাওয়া গোগনাদা, টালুদা, শ্যামলদাদের মুখগুলো। শোক, ক্রোধ, ঘৃণা, ভালোবাসা, প্রতিহিংসা আর পালটে দেয়ার স্বপ্ন, সবকিছু মিলেমিশে একাকার যেখানে। তারপর তো একটা আগুনে নদীর মত বহে চলা দ্রোহকাল। কলোনির খিলানওয়ালা দরজার পিছনে তিন-চারহাত গর্ত করে বাঁশের মাচা পেতে সাবধানে শুইয়ে রাখা ছিটকিনি-লক পাইপগান, ছ-ঘড়ার রিভলবার, মুঙ্গেরি নকল নাইন এম এম, পেটো, সকেট, শেল আর মলোটভ ককটেলের বোতল। বিরোধী দল আর পুলিশের সঙ্গে অ্যাকশন, এনকাউন্টার, অ্যামবুশ নিত্যরোজ। ভারী বুটের শব্দ তুলে ইনস্যাস অটোম্যাটিক রাইফেল হাতে কলোনির রাস্তায় সি আর পি- মিলিটারির রুটমার্চ। ওদিকে পুরোন পাড়া গড়পারের অবস্থাও তথৈবচ। ভর দিনেরবেলায় ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব স্কুলের দেয়ালে লেখা হচ্ছে শহরের  সবচেয়ে বড় লেটারহেডের দেয়াললিখন - ‘চেয়ারম্যানের চীন আক্রান্ত হতে পারে। বিপ্লবের কাজ তরান্বিত করুন!’ 

আরও পড়ুন
তিনতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ সুবীরের, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল সবাই

পাশেই পাতলা টিনের স্টেনসিল সেঁটে আঁকা হচ্ছে চেয়ারম্যান মাওয়ের মুখ। দেয়াল লিখিয়েদের কভার দিয়ে কোমরে আগ্নেয়াস্ত্র গুঁজে দাঁড়িয়ে রয়েছে অপাদা, সজলদা, বাপিদা, পাপা, চীনেবাঘা। মোড়ের মাথায় পাহারায় রয়েছে একদল। দূরে সি আর পি, আর্মির ট্রাক বা পুলিশে ভ্যানের চিনহটুকু দেখামাত্র শিস দিয়ে অ্যালার্ট করে দেবে। এদিকে সারা শহর আর শহরতলি জুড়ে উত্তাপ বাড়ছে সেই বিধ্বংসী আগুনের। হননাগ্নির আঁচে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে শ্যামলদা, গোগনাদা, দিলীপদা, আরও কতশত সব দুচোখে স্বপ্নপোষা ছেলের দল। সেই ভয়ঙ্কর তপ্ত হলকা ছিটকে এসে লাগছে এই প্রতিবেদকের পরিবারের গায়েও। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া পরিবার। ছটকে যাওয়া এদিকওদিক, একাধিক ঠিকানায়। দীর্ঘসময় পেরিয়ে ফের এসে জোড়া লাগা একসঙ্গে, দমদমের বাসা ছেড়ে ভাসতে ভাসতে এসে ওঠা পার্ক সার্কাসের ঘাটে। মূলত সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকা, কিন্তু এসবের পাশাপাশি বাঙালি হিন্দু এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়েরও উপস্থিতি বেশ উল্লেখযোগ্য সেসময়। আক্ষরিক অর্থেই সেসময় ‘কসমোপলিটান’ মধ্য কলকাতার এই মহল্লা। সেসব কাহিনি শোনাব তবে তার আগে টালুদা আর দিলীপদার কথা বলে এই পরিচ্ছেদটা শেষ করি। 

দিলীপদা। দিলীপ সাহা। দমদম শেঠবাগান কলোনির ছেলে। বাবার কাপড়ের দোকান ছিল হাওড়ার মঙ্গলা হাটে। তুলনামূলকভাবে অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান দিলীপদা ব্যক্তিগত সুখসাচ্ছন্দের তোয়াক্কা না করে ঝাঁপ দিয়েছিল সত্তরের আগুনে। পরবর্তীতে প্রবল রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের মুখে পড়ে দমদমের সংগঠন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে শেল্টার নিয়েছিল খড়দহের এক কলোনিতে। এক গভীর রাতে কলোনি ঘিরে ফেলে সি আর পি-পুলিশের বিশাল যৌথবাহিনী। কমরেডদের প্রত্যেকের সেফ প্যাসেজ করে দিতে ওই বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে একা একটা মেশিন কারবাইন হাতে প্রায় আধঘণ্টা লড়ে গেছিল দিলীপদা। বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা লাশ হয়ে লুটিয়ে পড়ার আগেই নিরাপদে এলাকা ছেড়ে সরে যেতে পেরেছিল সঙ্গীসাথীরা। দমদমে থাকাকালীন আমাদের বাড়িই ছিল ওর প্রায় প্রতিরাতের আস্তানা। দমদম ছেড়ে যাবার আগে তাড়াহুড়োয় টেরিকটের একটা প্যান্ট ফেলে রেখে গেছিল আমাদের বাড়িতে। সেই প্যান্ট আজো সযত্নে ভাঁজ করে রাখা রয়েছে আলমারিতে। 

আরও পড়ুন
নিয়মিত মদ্যপান করায় জুটেছিল ‘মাতাল’ পদবি, পরোপকারে নোবেল পেতে পারতেন তাঁরাই

টালুদা মানে দমদমের বসু ভবনের মলয় বোস ওরফে স্ট্যালিন বোসের সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল বছর-তিরিশ বাদে, বইমেলায়। বাংলার মুখ নামে একটা লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত। ততদিনে বুড়ো হয়েছে বুনো ঘোড়া। বয়স তার দাঁত ফুটিয়েছে শরীরে। উধাও সেই বিখ্যাত স্ট্যালিনমার্কা পাকানো মোচ।  তবু চিনে ফেলেছিলাম একটা অ্যাকশনের সময় বোমায় ঝলসে যাওয়া বুকের পোড়া দাগটা দেখে। কথা হয়েছিল অনেক। সত্তরের শেষভাগে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বিয়ে করেছিল শেঠবাগান কলোনির হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে একদা কমরেড ইন আর্মস ঝুনুদিকে। সামজিক ও পারিবারিক ব্যবধানের দুস্তর বাধাটাকে উপেক্ষা করেই। ফলে পড়তে হয়েছিল অসম্ভব আর্থিক কষ্টে। তবু স্বপ্ন দেখাটা থামেনি। লেখালেখির মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠত সেটা। বিশেষত সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে। সেসময় অশক্ত শরীর নিয়েও যে কতবার ওইসব অঞ্চলে ছুটে ছুটে গিয়েছিল মানুষটা তার ইয়ত্তা নেই। তবু হতাশা তো কোথাও একটা ছিলই। সেটা পরিণতি পেয়েছিল প্যাকেট প্যাকেট বিড়ি আর সস্তা মদের বোতলে। সমবয়েসি বন্ধুরা মাঝেমাঝে পরিহাস করে বলতেন মলয় বসু = বিড়ি, বাংলা আর হতাশ বিপ্লবের স্বপ্ন। জবাবে শুধু পুরনো সেই মিঠে হাসিটা হাসত টালুদা। তবে এসবের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পরবর্তী প্রজন্ম। দুই ছেলেমেয়ে। দুজনেই পেশাদারী জীবনে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। ছেলে কোলকাতার নামী এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে ক্যালিফোর্নিয়া না ম্যানহাটান কোথায় যেন একটা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার উচ্চপদস্থ আধিকারিক। বছরতিনেক আগে ওর কাছেই একদিন পেয়েছিলাম খবরটা। মাসখানেকের ছুটি নিয়ে কোলকাতায় এসছে। কারণ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বাইপাসের ধারে এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি টালুদা। খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলাম। বেডে শোয়া অজ্ঞান টালুদা। নাকেমুখে মাস্ক আর অক্সিজেনের নল। চামড়ার গায়ে হাড় কখানা লেগে রয়েছে শুধু। হাঁ-মুখ হাপরের মত নিশ্বাস টানার প্রায় ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে অতি কষ্টে। পাশে বসা ঝুনুদি। পাথর চোখের দৃষ্টি ! কেন জানিনা বহু পুরোন একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল হঠাত। সেই সত্তরের দশক। জাঁদরেল ফাইভ ফিফটি সি সি-র রয়াল এনফিল্ড মোটরবাইকটা নিয়ে পাড়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘দমদম দাওয়াই’ খ্যাত স্ট্যালিন বোস। ভয়ে এলাকা ছেড়ে সটকান দিচ্ছে তাবড় তাবড় দাদাভাইয়া আর গুন্ডামস্তানরা। সেই মানুষটা এইমুহূর্তে জীবন্ত একটা লাশ হয়ে শুয়ে আছে আমার সামনে। সহ্য করতে পারিনি দৃশ্যটা। দ্রুত বেরিয়ে এসেছিলাম কেবিন থেকে। 

সেই রাতেই ফোন এসছিল টালুদার ছেলের। বিপ্লব নামক প্রায় অসম্ভব এক স্বপ্নের দৌড় অসমাপ্ত রেখে রেসের মাঠেই ঘুমিয়ে পড়েছে বুনো ঘোড়া। সত্যি লিখলাম কি কথাটা? নাকি আরো লম্বা কোনো রেসের মাঠে দৌড়নোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সে? ধোঁয়াশাটা কিন্তু রয়েই গেল।

আরও পড়ুন
ইস্টবেঙ্গল লিগ জেতায়, দুঃখে ‘দেশান্তরী’ হয়ে গিয়েছিলেন মোহনবাগানী লালাকাকু

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor

More From Author See More