খাওয়ার মাঝখানে বরের মামাকে কান ধরে টেনে তুললেন সাধনকাকা, তেড়ে এল বরযাত্রীরা

সেইসব পাড়া টারা – ৭

আগের পর্বে

সেসময় চক্কোত্তিদের বাড়ি ছিল ‘রেল চাকুরে’ বাড়ি। বংশপরম্পরায় চলত রেলে চাকরি করার কাজ। এই গর্ববোধেই সারা পাড়া মাতিয়ে রাখতেন চক্কোত্তিগিন্নি। যার পরোক্ষ শিকার হতেন পাড়ার বেকার যুবকেরা। সে বাড়ির ছেলে বিজে’র সোনাগাছিতে যাওয়ার কথা পাড়ায় পোস্টার সেঁটে, টকাই-বগাইরা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সেই দম্ভ। ওদের মতো ছোটবেলার বন্ধু সুবীর একবার শায়েস্তা করেছিল এক হকারকে। খানিক বেয়াদপি করেই যে অনৈতিকভাবে টাকা কেড়ে নিয়েছিল। সুবীরের পুলিশ মামা সেই উদ্ধারকার্যেই পাঠিয়েছিলেন ‘কিংকং’-কে। বাজেয়াপ্ত হল জুসওয়ালার বাক্সের সমস্ত টাকা। সেই টাকা দিয়েই কেসি দাসের মিষ্টি খাইয়েছিলেন কিংকং। নগদ ১০ টাকা দিয়েছিলেন সিনেমা দেখার জন্যেও।

অতঃপর আবার গড়পার। যেসময়কার কথা বলছি, তখন ভাড়ার বিয়েবাড়ি নামক বস্তুটির সঙ্গে পরিচয়ই ঘটেনি আম শহরবাসীর। ক্যাটারিং সার্ভিস ভিনগ্রহের কোনো ইউ এফ ও। ফলে পাড়ার সব বিয়েবাড়ির প্যান্ডেলই পড়ত আপার সার্কুলার রোডের গায়ে চওড়া ফুটপাতে। ডেকরেটরের বাঁধা প্যান্ডেলের একদিকে বর-কনের বসা আর বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা। অন্য বিভাগে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। সার সার কাঠের লম্বা টেবিল। জল ছিটিয়ে বিছিয়ে দেয়া পেপার রোল। মাটির গেলাসে কর্পূরের গন্ধওয়ালা জল, কলাপাতায় নুন-লেবু, পোস্তদানা ছেটানো লম্বা লম্বা বেগুনভাজা। মাছের কালিয়া, মুড়ো দিয়ে মুগডাল, কচি পাঁঠার ঝোল, স্পঞ্জ রসগোল্লা, দইয়ের হাঁড়ি মাংসের বালতি নিয়ে কোমরে লাল গামছা বেঁধে পরিবেশনকারীদের ছোটাছুটি, হাঁকডাক, চ্যাঁচামেচি। 

এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। সেসময় ক্যাটারিং সার্ভিসের অস্তিত্ব না থাকার ফলে বাঙালি বিয়েবাড়িতে পাড়ার ছেলে নামক এইসব পরিবেশনকারীদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পরিবর্তে দক্ষিণাস্বরূপ পাওয়া যেত ব্র্যান্ড নিউ একটি লাল গামছা। সঙ্গে আলাদাভাবে একদিন চর্ব্যচোষ্য লেহ্যপেয় খ্যাঁটনের ব্যবস্থা। আমাদের পাড়ায় এই পরিবেশনকারীদের দলের ন্যাচারাল লিডার ছিল পিকলুকাকু। পাড়ার ডাকাবুকো ছেলে। খুব স্বাভাবিকভাবেই পাড়ায় শৈলেশজ্যাঠার মেয়ের বিয়েতে ডাক পড়েছিল পিকলুকাকুর। “ওসব নিয়ে আপনি অ্যাদ্দম ভাব্বেন না দাদা। এই পিল্লু শর্মা থাকতে কোন চিন্তা নেই আপনার।” অভয় দিয়ে এসছিল পিকলুদা। এদিকে পাড়া ছাড়িয়ে পিকলুদার পরিচিতি গোটা এলাকায় বিস্তৃত। ফলে বিবাহানুষ্ঠানের রাতে দূরদূরান্তের সব ক্লাব থেকে মাংসের কোর্মা পাঠানোর অনুরোধ আসতে লাগলো অবিরত। সে অনুরোধ রাখতেই প্যান্ডেলের ফাঁক দিয়ে গোপনে গলে যেতে লাগল বালতির পর বালতি মাংস। যার অবশ্যম্ভাবী ফল বিয়েবাড়িতে মাংসের তীব্র হাহাকার! প্রচণ্ড উদ্বিগ্নমুখে এগিয়ে এসছিলেন সাধনকাকা। শৈলেশজ্যাঠার ছোটভাই। “বলি, ব্যাপারটা কী পিল্লু? মাংস অ্যাতো শর্ট পড়ে যাচ্চে ক্যানো?” “আর বলবেন না সাধনদা। রাস্তার ওপর প্যান্ডেল। দুনিয়ার যত বিনডাকু (বিনা নিমন্ত্রণে আসা লোকজন) এসে খেয়ে যাচ্চে।” ব্যাজার মুখে জবাব দিল পিকলুকাকু। 

শোনামাত্র সাধনকাকার মুখটা আগাথা ক্রিস্টির সেই ঝানু গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারোর মত হয়ে গেল হুবহু। “আই সি   ব্যাপারটা তো তাহলে দেকতে হচ্চে অ্যাকবার।” বলতে বলতে সামনে এগিয়ে গেলেন সাধনকাকা। থার্ড না ফোর্থ ব্যাচ চলছে তখন। তীক্ষ্ণ চোখে প্রত্যেককে জরিপ করতে করতে হঠাতই “এই তো পেয়েচি বিনডাকু” বলে শুভ্র ধুতিপাঞ্জাবী পরিহিত এক মধ্যবয়রসী ভদ্রলোকের কান ধরে টেনে তুললেন সাধনকাকা। ব্যাস! সঙ্গে সঙ্গে মার মার রবে তেড়ে এল বরযাত্রীরা। কারণ ওই ভদ্রলোক নাকি সম্পর্কে বরের মামা এবং ওনার হাতে তখনো আধখাওয়া লেডিকেনিটা রয়ে গেছে। এরপরের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সে এক চূড়ান্ত অরাজক ব্যাপারস্যাপার! বরপক্ষের বারবার গিয়ে গাড়িতে বসা এবং কন্যাপক্ষের প্রতিবারই তাদের হাতেপায়ে ধরে ফিরিয়ে আনা - এই দুরন্ত নাটক চলেছিল রাত প্রায় দুটো আড়াইটে অবধি। অবশেষে সাধনকাকা বরের মামার কাছে প্রায় গলবস্ত্র হয়ে ক্ষমা চাইলে মোটের ওপর ব্যাপারটার একটা সমাধান ঘটে। 

প্রিয় পাঠক, এরপরও উত্তর কোলকাতা নিয়ে আরো অনেকটাই লেখা যেত হয়তো। তবে কী জানেন, শুধু একা একটা নর্থকে নিয়ে লিখতে গেলেই গোটা পঞ্চাশেক ন্যাশনাল লাইব্রেরির র্যা ক উপচে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা। ফলে কলমের খাপ আটকে চলুন হাঁটা লাগানো যাক উত্তর শহরতলির দিকে। কৈশোরের শেষভাগে প্রায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই প্রতিবেদককে চলে যেতে হয়েছিল যেখানে। সম্পূর্ণ আলাদা সংস্কৃতি আর ভিন্নধর্মী মানসিকতাসম্পন্ন একটি অঞ্চলে। সেইসব অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা নামক সঞ্চয়ের ঝুলি কিছুটা হলেও ঊপুড় করব পরবর্তী পর্বে।

আরও পড়ুন
কে সি দাসের দোকানে নিয়ে গিয়ে রসগোল্লা খাওয়াল ‘কিং কং’

অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
তিনতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ সুবীরের, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল সবাই

More From Author See More