১৪ কোটি ২০ লক্ষ! ক্রমশ বাড়ছে হারিয়ে যাওয়া শিশুকন্যার সংখ্যা

‘নিরুদ্দেশ সন্ধানে ঘোষণা’র ট্যাগ লাগিয়ে দিলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না তাদের আর। দেওয়াই যাবে না শারীরিক বর্ণনা, কারণ কেউ তো কখনো দেখেইনি তাদের। তাদের আসতেই দেওয়া হয়নি এই পৃথিবীর আলো-ছায়ায়।

সারা বিশ্বে ‘নিখোঁজ’ প্রায় ১৪ কোটি ২০ লক্ষ শিশুকন্যা। কারণ, সেই এক ও অদ্বিতীয়, কন্যাভ্রূণ হত্যা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের জনসংখ্যা বিষয়ক দফতর (ইউএনএফপিএ)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী আশঙ্কাজনক ভারতের পরিস্থিতিও। ইউএনএফপিএ যে তথ্য সামনে এনেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ভারতে এই সংখ্যাটা প্রায় ৫ লক্ষ ছুঁইছুঁই। ভারতে হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, দিল্লি, গুজরাট, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব এবং বিহারের মতো ৯টি রাজ্যে এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে শোচনীয় বলে প্রকাশ পেয়েছে রিপোর্টে।

সামাজিক বঞ্চনা ও অসাম্যের ইতিহাস কখনোই মহিলাদের পক্ষে ছিল না সেভাবে। কিন্তু ক্রমাগত বাড়তে থাকা এই কন্যাভ্রূণ হত্যার ফলে সমাজে মেয়েরা যে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, সে কথা সহজবোধ্য। সংখ্যালঘু লিঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করার ফলে এই চোরাগলি থেকে বেরিয়ে আসার পথগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ তাদের কাছে। রিপোর্টে বলছে, ভারতে প্রতি ৩ জনের মধ্যে ২ জন কন্যা সন্তান হারিয়ে যায় জন্মের পূর্বে ভ্রূণ নির্ধারণের ফলে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরেও প্রতি ৩ জন কন্যা সন্তানের মধ্যে মারা যায় ১ জন। শুধু ভারতই নয়, পরিস্থিতিটা ভয়াবহ চিনের মতো অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষমতাবান দেশেও। ভারতে যেখানে সংখ্যাটা ৪০ শতাংশ, সেখানে লিঙ্গভিত্তিক ভেদাভেদের জন্য চিনে জন্মের পর ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যায় ৫০ শতাংশ কন্যা সন্তান। সারা বিশ্বের হিসেবে প্রতি বছরে এই সংখ্যাটা অন্তত ১২ কোটি!

এই বিষয় নিয়ে ইউএনএফপিএ’র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. নাতালিয়া কানেমের বক্তব্যেও তাই ধরা পড়েছে অসহায় উদ্বেগ। এই সামাজিক মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইতে বিগত কয়েক বছরে বেশ কিছু অগ্রগতি হলেও সেই কাজেও ধাক্কা লেগেছে করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে। করোনা পরিস্থিতির প্রভাবে এযাবৎ যেটুকু এগোনো গিয়েছিল, তা অকেজো হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। সুতরাং শুরু করতে হবে আবার প্রথম থেকে। তার ফাঁকেই আরও কত ভ্রূণ হারিয়ে যাবে, সেই চিন্তাও স্বাভাবিকভাবেই আঁতকে ওঠার মতোই।

ভারতে ২০১৮ সালের সরকারি হিসেব অনুযায়ী, প্রতি ১,০০০ জন পুত্র সন্তান পিছু কন্যা সন্তানের জন্মের হার ৮৯৯ জন। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, দেশে প্রতি ১০০০ জন পুরুষের অনুপাতে মহিলাদের সংখ্যা ৯৪০ জন। কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি? কারণে হিসেবে উঠে এসেছে সেই চিরাচরিত ও বহুলচর্চিত বিষয়গুলিই: বাল্য বিবাহ, পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষা, দারিদ্র, অশিক্ষা এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। এর সঙ্গেই রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্টে আলোকপাত করা হয়েছে মহিলাদের যৌন অঙ্গচ্ছেদের মতো ভয়াবহতার উপরেও।

করোনা পরিস্থিতিতে কতটা খারাপ হয়েছে ছবিটা। ডক্টর কানেম জানাচ্ছেন, আর যদি আগামী ছয় মাসেও কাজ শুরু করা না যায়, তবে বাল্যবিবাহের শিকার হবে ১ কোটি ৩০ লক্ষ বালিকা; ২০৩০ সালের মধ্যে যৌন অঙ্গচ্ছেদের মতো ভয়াবহতার শিকার হতে পারেন ২০ লক্ষ মহিলা।

আরও পড়ুন
আদালতের সমালোচনা বাকস্বাধীনতারই অঙ্গ, গণতন্ত্রের সে-কথাই মনে করিয়ে দিলেন প্রশান্তভূষণ?

যদি শুধু ভারতের দিকেই তাকানো যায়, তবে দেখা যাবে এই সমস্যা ঠেকাতে আইন আনা হয়েছিল বহু আগেই। ১৯৭৪ সালে প্রথম দিল্লিতে গর্ভাবস্থায় ভ্রুণ নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তার পর থেকেই পরীক্ষাগারে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ণয় করে কন্যাভ্রুণ হত্যা করার ঘটনা সামনে আসতে থাকে আকছার। পরবর্তীকালে এই প্রবণতা ঠেকাতে আনা হয় পিএনডিটি (প্রি ন্যাটাল ডায়াগোনস্টিক টেকনিক) আইন। কিন্তু পরিকাঠামো এবং সদিচ্ছা না থাকলে আইনের প্রয়োগটা হবে কী করে? ১৯৯৮ সালে দু’টি সেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সিহ্যাট’ ও ‘মাসুম’-এর তরফে কন্যাভ্রুণ হত্যার বিরুদ্ধে একটি আবেদন করা হয় সুপ্রিম কোর্টে। সেই সময় শীর্ষ আদালত প্রত্যেক রাজ্যের কাছে পিএনডিটি আইন প্রয়োগের শিথিলতার কারণ জানতে চাইলে কোনও সন্তোষজনক উত্তর না পাওয়ায় এই আইন সংশোধন করে ২০০৩ সালে আনা হয় পিসিপিএনডিটি আইন (দ্যা প্রি-কনসেপশন অ্যান্ড প্রি-ন্যাটাল ডায়াগোনস্টিক টেকনিকস্ অ্যাক্ট)। বিশেষ কিছু ব্যাপারে ছাড়া কখনই গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করা ও শিশুর লিঙ্গ প্রকাশ করা যাবে না, বলা হয় এই আইনে। পরবর্তীতে কেন্দ্রের তরফে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ বা তারও আগে পশ্চিমবঙ্গের সরকার নিয়ে এসেছে ‘কন্যাশ্রী’র মতো প্রকল্প। তাতে কিছু ক্ষেত্রে সদর্থক ফল পাওয়া গেলেও, আখেরে ছবিটা খুব একটা বদলেছে কি?

২০১৬ সালে ভারতের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী মানেকা গান্ধী জানান, ভারতে কন্যাভ্রূণ হত্যা রোধ করার জন্য ‘অন্যরকম’ মডেল আনতে চাইছে সরকার। লিঙ্গ নির্ণয়ের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আছে, তা তুলে নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কথা বলা হয়েছিল এই সমস্যাকে। মানেকা গান্ধীর কথায়, কোনও নারী গর্ভবতী হওয়ার পরেই তার গর্ভস্থ সন্তানের বাধ্যতামূলকভাবে লিঙ্গ নির্ণয় করার প্রস্তাব গৃহীত হলে সরকার দেশের প্রতিটি জন্ম ‘মনিটর’ করতে পারবে এবং তার ফলে ঠেকানো সম্ভব হয়ে কন্যাভ্রূণের হত্যা। কিন্তু এই প্রস্তাবের খামতিগুলোও সামনে আসতে দেরি হয়নি। ভারতে নারী আন্দোলনের পুরোধা ও মানবাধিকার কর্মী কবিতা কৃষ্ণন এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, নতুন এই প্রস্তাব আসলে সরকারের ব্যর্থতারই স্বীকারোক্তি। আগের আইনটাই যেখানে ঠিক মতো প্রয়োগ করা হল না, তারপর ‘ব্যর্থ’ তকমা বলে ফেলে দিয়ে আরও একটা নতুন আনার কথা বলা হল— ফলত আসলেই সমস্যাগুলোকে সমাধান করার সত্যিই কতটা সদিচ্ছা আছে সরকারের, সেই দিকেই নিশানা করেছিলেন তিনি।

কিন্তু এই তরজার মধ্যেই বয়ে গেছে সময়। অজস্র স্বপ্নের মাঝেই কন্যাভ্রূণ হারিয়ে গেছে আরও কত। এখনই সাবধান না হলে কী হতে পারে? সিঁদুরে মেঘের ছবিটা দেখিয়েই রেখেছেন গবেষকেরা। এই মুহূর্তে এই প্রবণতায় রাশ না টানা গেলে পরবর্তী দশকে ভারতে প্রতিদিন গড়ে হারিয়ে যেতে পারে ১,২০০-এরও বেশি ভ্রূণ। এবং, এই তথ্য মন্ত্রী, আমলা বা পলিসি নির্ধারকদেরও যে জানা নেই, সেটা তো হতে পারে না! কিন্তু একে আটকানোর সেই উদ্যোগটা সেভাবে দেখা যাচ্ছে কই?

আরও পড়ুন
অন্য অসুখ; লকডাউনের মধ্যেই বাল্যবিবাহের ব্যাপক বৃদ্ধি দেশজুড়ে

Powered by Froala Editor

More From Author See More