পেরিয়ে আসা ৬ মাস, মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইতে কি আদৌ এগোচ্ছি আমরা?

বেশি দিন নয়, ৬-৭ মাস আগের পৃথিবীর দিকে তাকালেই মনে হয় একটা যুগ বয়ে গেছে মাঝখানে। তারপরে ভাইরাসের আক্রমণ ঘটেছে। নতুন এই ভাইরাসের আগমনকে সারা পৃথিবীর ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা বলে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে নতুন এই ভাইরাসের কবলে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার জন, মারা যান ২০০ জনেরও বেশি। তবে এই মৃত্যুর কোনোটিই চিনের বাইরে ছিল না। ছবিটা বদলাতে থাকে তার পর থেকেই।

ইতিমধ্যেই সারাবিশ্বে কুড়ি কোটিরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে করোনা ভাইরাসে। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে সাত লক্ষের গণ্ডি। সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে দেখতে গেলে, যে গতিতে এই ভাইরাসের আক্রমণ ঘটেছে তা মারাত্মক। প্রথম আক্রান্তের খবর পাওয়ার পর সেই সংখ্যাটা এক লক্ষে পৌঁছতে লেগে গিয়েছিল ৬৭ দিন। লক্ষের গণ্ডি যদি মাইলফলক ধরা হয়, তবে এখন প্রতিদিন সেই মাইলফলক পার করে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা। দেশ জাতি ধর্ম শ্রেণী কোনও বিভেদ না মেনেই ডালপালা মেলেছে এই ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে ডক্টর মার্গারেট হ্যারিসের কথায়, সমস্ত বিশ্ববাসী এখনও একটি তীব্রতর এবং মারাত্মক মহামারীর মধ্যে আছে; বিশ্বের কোনও সম্প্রদায়ই যার হাত থেকে রেহাই পায়নি।

বিশ্বজুড়ে স্থান এবং অঞ্চলভেদে কোভিড-১৯এর প্রভাব আলাদা হলেও চোখে পড়ার মতো বাস্তবতা হল আমাজন রেইন ফরেস্টের আদিবাসীরা অথবা সিঙ্গাপুরের আকাশ ছোঁয়া বহুতলের শিল্পপতি— কেউই বাদ যায়নি এর ছোবল থেকে। ফলে আচমকাই মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে একটা প্রশ্নের মুখে। কারণ, এই ভাইরাস সবথেকে দ্রুত তখনই ছড়িয়ে পড়ে, যখন মানুষেরা একে অন্যের অত্যন্ত কাছাকাছি থাকে।

অর্থাৎ একটা বদলে যাওয়া ভবিষ্যতের দিকেই যেন ক্রমশ এগিয়ে চলেছি আমরা। যখন লাতিন আমেরিকা মহামারীর বর্তমান কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে এবং ভারতের মতো উন্নয়নশীল এবং বড় দেশে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা, তখন আমাদের ফিরে তাকাতেই হচ্ছে অন্যসব দেশের দিকে যারা কিছুটা হলেও সামাল দিতে পেরেছে এই ভাইরাসের আক্রমণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিই যেন ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীতে ভাবতে বাধ্য করেছে একেকটি রাষ্ট্রকে। হংকং এখনও মানুষদেরকে কোয়ারান্টিনে থাকতে বলছে, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ পর্যবেক্ষণ করছে দেশবাসীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং ফোনে এবং ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়া ধীরে ধীরে লকডাউন উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার ভারসাম্য বজায় রাখতে চেষ্টা করছে। অগত্যা আমাদেরও খুঁজতে হচ্ছে ‘নিও নরমাল’-এর মত অচেনা এক বাস্তবের ছবি।

তবে এই করোনা ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যে সকল ক্ষেত্রে মানবিক ভাবে দেশের সরকার ঝাঁপিয়ে পড়েছে, স্বীকার করেছে ভাইরাসের ভয়াবহতা এবং সেই বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তারাই কিন্তু বর্তমানে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বেশ খানিকটা। নিউজিল্যান্ড বা মঙ্গোলিয়ার মতো দেশের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করাই যায়। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব এবং পাবলিক হেলথ পলিসিতে ফাঁকফোঁকর থাকায় মহামারী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল বা ভারতের মতো দেশগুলিতে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জাইর বোলসোনারো তো সময় সময় এই ভাইরাসকে ‘সামান্য ফ্লু’ হিসেবেও বর্ণনা করেছিলেন। এমনকি ভাইরাসের অস্তিত্বও অস্বীকার করে জানিয়েছিলেন যে, মার্চ মাসের পর থেকে আর করোনা ভাইরাসের টিকিটিও দেখা যায়নি! ফলে যা হবার হয়েছে সেটাই। শুধুমাত্র ব্রাজিলেই ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছে এক লক্ষেরও বেশি মানুষ।

উল্টো দিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়ে করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম বা জার্মানির মতো দেশগুলি। যদিও করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইতে উল্লেখযোগ্য একটি অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকা। সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আফ্রিকাতে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে আফ্রিকার গড় বয়স মাত্র ১৯। এছাড়াও ধনী দেশগুলির মধ্যে যে ধরনের স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাগুলি খুবই সাধারণ যেমন স্থূলতা অথবা টাইপ টু ডায়াবেটিস, যেগুলি কোভিডের ঝুঁকি অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়, সেগুলি খুবই কম দেখা যায় আফ্রিকাতে।

আরও পড়ুন
করোনা-জয়ের পরেও আবার আঘাত; ১৪ জন নতুন করে আক্রান্ত নিউজিল্যান্ডে

তবে উন্নয়নশীল এবং তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেই যখন এখনও পরিষ্কার জলের অভাব সুতীব্র এবং দারিদ্র্যও প্রবল, তখন বারবার হাত ধোয়ার মতো প্রসঙ্গ কতটা যুক্তিযুক্ত তাদের কাছে, সে নিয়ে একটা প্রশ্ন চিহ্ন থেকেই যায়। তাই বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যকর্তাদের মতে, সকলেই এখন হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে আছে ভ্যাকসিনের দিকে। সারা পৃথিবী জুড়েই অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে চলছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজ। তবে বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, এটা কোনও হলিউডের থ্রিলার ফিল্ম নয় যে দু’ ঘন্টার শেষে একজন বিজ্ঞানী আচমকাই একটি সফল ফর্মুলা আবিষ্কার করে ফেলবেন! তাই ধৈর্য ধরা সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক থাকতে হবে সকলকে। মনে রাখতে হবে কোভিডের বিরুদ্ধে এই লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে মানবজাতির।

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More