কর দেন মাত্র ১ শতাংশ ভারতীয়, কর আদায়ে কেন্দ্রের হাতিয়ার তাই দেশপ্রেম?

‘ট্রান্সপারেন্ট ট্যাক্সেশন - অনারিং দ্য অনেস্ট’। সহজ কথায় বলতে গেলে স্বচ্ছ কর ব্যবস্থা এবং তাতে যারা সামিল, তাদের সততার সম্মান। স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগেই কর ব্যবস্থায় বড়সড় পরিবর্তন এনে এই শব্দবন্ধের কথাই শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে। অর্থমন্ত্রকের দাবি অনুযায়ী, আয়কর এবং কর্পোরেট করের ক্ষেত্রে যে বিপুল সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল, এই সংস্কারের মাধ্যমে তার দিকেই আরও এক কদম পা বাড়ানো হল।

গত আর্থিক বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন জানিয়েছিলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই করদাতাদের সনদ বা ট্যাক্স পেয়ার্স চার্টার গঠন করা হবে। নাগরিকদের থেকে কর আদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আয়কর দফতরের তরফে নাগরিকদের পরিষেবা প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয় এই সনদে। সেই কথা মতোই কর দেওয়ার নিয়মকানুন আরও সরলীকরণ করার পথে হাঁটল মোদী সরকার। এর অন্যতম হাতিয়ার হতে চলেছে ‘ফেসলেস আপিল’ এবং ‘ফেসলেস অ্যাসেসমেন্ট’। অর্থাৎ কোনও ক্ষেত্রে করদাতা যদি অনিচ্ছাকৃত ভাবে আয়কর প্রদানে কোনও ভুল করে ফেলেন, আয়কর না দিতে পারেন অথবা করদাতার আয়কর গৃহীত না হয় সে ক্ষেত্রে তাদের জটিলতার মধ্যে না ফেলে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠাই এখন লক্ষ্য সরকারের। অর্থাৎ অনিচ্ছাকৃত কর ফাঁকির ঘটনায় নিয়মিত করদাতাদের হয়রানি যাতে আটকানো যায়, সেটাকেই পাখির চোখ করতে চলছে অর্থ মন্ত্রক।

করোনা ভাইরাস পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে আরও। এমনিতেই তার আগে থেকেই সার্বিক ভাবে আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়ার জন্য আঙুল উঠছিল কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে। অতিমারী পরিস্থিতিতে আরও শোচনীয় হয়েছিল সেই অবস্থা। অচিন্তনীয় এই বিপর্যয় কীভাবে আটকানো যাবে তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্তম্ভের সংস্কারের দাবি করা হয়ে আসছিল। এই প্রেক্ষাপটেই কর ব্যবস্থার এই সরলীকরণ দেশের অর্থনীতিকে নতুন গতি দেওয়ারই একটি উদ্যোগ বলে মনে করছেন আর্থিক বিশেষজ্ঞরা।

বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ‘ডাইরেক্ট ট্যাক্স’ অর্থাৎ ‘প্রত্যক্ষ কর’ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত বিভাগগুলির সঙ্গে দফায় দফায় একাধিক বৈঠক সেরেছিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। তার ভিত্তিতেই কর সংক্রান্ত এই নয়া সংস্কারের ঘোষণা করা হল। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, সাধারণত আয় বা সম্পত্তির উপর যে কর বসানো হয় তাকেই প্রত্যক্ষ কর বলা যেতে পারে। আয়কর ছাড়াও কর্পোরেশন কর, সম্পত্তি কর, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির উপর কর ইত্যাদি এই প্রত্যক্ষ করের আওতায় আসে।

আরও পড়ুন
লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব আর বেসরকারিকরণ; অর্থনীতি কি দিশাহীন হয়ে পড়ছে ক্রমশই?

তবে আয়করের ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ এই সরকারের প্রথম নয়। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কর্পোরেট কর কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মোদী সরকার। দাবি করা হয়েছিল, এর ফলে নতুন লগ্নি যেমন আসবে তেমনই পুরনো সংস্থাও উজ্জীবিত হবে নতুনভাবে লগ্নি করতে। ফলে কলকারখানা তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরির সুযোগ বাড়বে আরও। কিন্তু গত জুন মাসেই অর্থ মন্ত্রকের বিবৃতিতে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল যে, কর্পোরেট কর আদায় করার কাঠামো বদল করেও বিনিয়োগ তো বাড়েইনি, বরং কর আদায় এক ধাক্কায় কমে গিয়েছিল অনেকটাই! এমনকি অর্থ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ীই, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে আদায় করা প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ ছিল ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় কম। এমন ঘটনা দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে বিগত দুই দশকের মধ্যে কখনও ঘটেনি। যদিও তখন অর্থ মন্ত্রকের তরফে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে, এত তাড়াতাড়ি কোনোরকম আর্থিক সংস্কারের সুফল মেলা সম্ভব নয়; কখনও কখনও কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে এর ভালো দিকগুলি সামনে আসতে।

কিন্তু আর্থিকভাবে জর্জরিত দেশে মানুষেরা এখন আগামীদিনের বদলে বাঁচতে চাইছেন বর্তমানে। তাই যত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতির উন্নতি হয়, ততোই মঙ্গল দেশবাসীর। নতুন কর ব্যবস্থা আলো ফেলবে দেশের মেঘাচ্ছন্ন অর্থনীতির আকাশে, সেই আশাই এখন সমস্ত ভারতীয়দের মনে।

আরও পড়ুন
পেনশন ও বেতন দেওয়ার মতো অর্থ নেই ভাঁড়ারে, অর্থমন্ত্রকের দ্বারস্থ রেল

সদ্য প্রকাশিত এই সনদে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে আয়কর দফতর ও আয়কর দাতাদের ভূমিকা ও দায়িত্ব। দেশের শিল্পমহলের তরফে স্বাগত জানানো হয়েছে এই পদক্ষেপকে। সংশোধিত ব্যবস্থায় নজরদারি বাড়বে হোটেল বিল, ইলেকট্রিক বিল অথবা জীবন বীমার প্রিমিয়ামের মতো লেনদেনেও। বহুমূল্য সম্পত্তি কেনাবেচা করা অথবা বিদেশ ভ্রমণও আওতায় আসবে নতুন নজরদারি ব্যবস্থায়। এর ফলে বড় অঙ্কের কর ফাঁকি, বেনামী সম্পত্তি অথবা কালো টাকার মতো বিষয়কে মোকাবিলা করা যাবে বলেই সরকারের আশা। উপরন্তু নজর দেওয়া হয়েছে করদাতাদের হেনস্থা কমিয়ে আয়কর দফতরের উপর মানুষের আস্থা বৃদ্ধি করতে।

কিন্তু খটকা খানিকটা থেকেই যায়। যেভাবে স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগে নাগরিকদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, ১৩০ কোটির দেশে মাত্র দেড় কোটি মানুষ আয়কর প্রদান করেন এবং দেশবাসীকে আয়কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে স্বাধীনতার সংগ্রামে শহীদদের আবেগের উপর ভরসা করতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে, তাতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আভ্যন্তরীণ ও গঠনগত পরিস্থিতি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কেন এখনও আয়কর দফতরের তরফে কর ফাঁকি দেওয়া মানুষদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না, সেই প্রশ্ন উঠতে তো বাধ্য! তাই আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রেও এবার দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের উপর ভরসা রেখে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা আদতে কতটা সুফল দেয়, সেদিকেই নজর থাকবে সবার। সত্যিই তো, সঠিক দেশপ্রেম দেখাতে গেলে কর দেওয়ার মাধ্যমে কিছু ‘করে দেখানোই’ বাঞ্ছনীয়, এমনটাই তো চাইছেন দেশের সরকারও!

আরও পড়ুন
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য একগুচ্ছ আর্থিক প্যাকেজ, ঘোষণা অর্থমন্ত্রীর

এর আগে এই সরকারেরই আর্থিক সংস্কারের লক্ষ্যে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ভবিষ্যতে বুমেরাং হয়ে ফেরত এসেছে। আচমকা নোট বাতিল অথবা জিএসটি প্রক্রিয়া চালু করে দেওয়া নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়েছে দেশের সমস্ত মহলে। বিশেষ করে নোট বাতিলের ধাক্কা দেশ এখনও সামলে উঠতে পারেনি বলেই অভিযোগ উঠেছে বারবার। তাই এই নয়া আর্থিক সংস্কারের লাভ আদৌ কতটা মধ্যবিত্ত হেঁসেলে প্রভাব ফেলবে, সেদিকেই তাকিয়ে এখন দেশের অর্থনীতির পণ্ডিত থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More