এগিয়ে এলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতার পর ‘সরকারিকরণ’ হল দেশের সমস্ত বিমান সংস্থার

দেখতে দেখতে স্বাধীন হল ভারত। লালকেল্লার উপরে উঠল ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকা। অন্তর্বর্তীকালিন সরকারও গড়ে উঠল। তবে এই সরকার যে কোন পথে চলবে, তা সহজে বুঝে উঠতে পারেননি অনেকে। কোন পথে মানে রাশিয়ার দলে ভিড়বে, নাকি আমেরিকার খোঁয়াড়ে? দুটো রাস্তাই খোলা ছিল সামনে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেহেরু তার কোনোদিকেই না গিয়ে বললেন ভারতবর্ষ দুই জোট থেকেই নিরপেক্ষ অবস্থান নেবে। আর তার রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও দুই দেশেরই নানা ভালো দিক মিলিয়ে মিশিয়ে নেওয়া হবে। ঠিক যেমন রাশিয়ার মতো করে দেশের বিভিন্ন পরিষেবা ক্ষেত্রগুলি অধিগ্রহণ করল সরকার। আর এর মধ্যেই ছিল বিমান পরিবহন ব্যবস্থাও।

স্বাধীনতার আগে যে কেউ টাকার জোরেই বিমান কিনে ফেলতে পারতেন। তাতে চড়ে ঘুরে বেড়াতে পারতেন যত্রতত্র। না ছিল কোনো নির্দিষ্ট পরিবহন পথ, আর না ছিল তেমন লাইসেন্সের কড়াকড়ি। ১৯২৪ সাল থেকেই এই বিমান চলাচল নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল রীতিমতো প্রতিযোগিতা। তখনও দমদম বিমানবন্দর পরিপূর্ণ চেহারা নিয়ে গড়ে ওঠেনি। এমনকি ইংল্যান্ডের ইম্পেরিয়াল এয়ারওয়েজও ঠিকভাবে পরিষেবা শুরু করেনি। আর এর মধ্যেই কলকাতায় গড়ে উঠল বেঙ্গল এয়ার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি (২১ মে, ১৯২৯)। বাঙালির নাকি ব্যবসা আসে না! সেবার কিন্তু সাহেবদের শুধু না, সঙ্গে ডাচ, ফরাসি এমনকি অস্ট্রেলিয়ার বিনিয়োগকারীদেরও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল বাঙালি।

তবে বেঙ্গল এয়ার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি ব্যবসা চালিয়েছিল ঠিক ১ সপ্তাহ। এর পরেই কোম্পানির নাম বদলে যায়। সড়ক পরিবহন এবং বিমান পরিবহন উদ্যোক্তারা একসঙ্গে তৈরি করলেন বেঙ্গল ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি। এই ব্যবসা কিন্তু স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত বহাল ছিল। শুধু তাই নয়। দেখাদেখি আরও বেশ কিছু কোম্পানি গড়ে উঠতে শুরু করল সারা দেশজুড়ে। সবাই তখন বুঝে গিয়েছেন, বিমানের ব্যবসায় লোকসান নেই। একে একে গড়ে উঠল ইন্ডিয়ান এয়ারওয়েজ, এয়ারওয়েজ (ইন্ডিয়া), অম্বিকা এয়ারওয়েজ, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ এয়ারলাইনস, হিমালয়ান এয়ারওয়েজ, কলিঙ্গ এয়ারলাইন্স… আর কত নাম বলা যায়?

এরপর দীর্ঘকাল কাটল যুদ্ধে, স্বাধীনতার লড়াইতে। যুদ্ধের বাজারে দু-চারটে সিপাহি-বিমান পরিবহন করতে বা কয়েকটা বোমা ফেলে আসার দায়িত্ব নিতেও ছাড়েননি এদেশের ব্যবসায়ীরা। ঠিক আর তারপর এলো স্বাধীনতা। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বসে ভাবতে শুরু করলেন, এবার তো ব্রিটিশের নিন্দা করলেই হবে না। নিজের হাতে দেশের দায়িত্ব নিতে হবে। এর মধ্যে রেল কোম্পানির দায়িত্ব ভারত সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অনেক কোম্পানিই যদিও ব্রিটেন থেকেই কাজ করে যাচ্ছে। তবে পরিবহন ক্ষেত্রে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বিমান বাহিনীর কাগজ হাতে নিয়েই তিনি চমকে উঠলেন। সব মিলিয়ে সারা দেশে ১৫টির বেশি বিমান কোম্পানি! তাদের আবার পরিবহন পথ নিয়েও কোনো বোঝাপড়া নেই। প্রতিটা কোম্পানির পরিবহন পথ ম্যাপের উপর আঁকলে আকাশ বলে আর কিছু দেখাই যায় না। নেহেরু ঠিক করলেন; না, এভাবে চলতে পারে না।

আরও পড়ুন
খোঁজ মেলেনি কোনোদিন, আকাশেই হারিয়ে যাওয়া প্রথম পাঁচটি বিমানের হদিশ

পরিস্থিতির জটিলতা দেখে পণ্ডিত নেহেরু ডেকে পাঠালেন সর্দার আবদার রব নিস্তারকে। আর তাঁর উপরেই দায়িত্ব দেওয়া হল দেশের বিমান পরিবহনের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেওয়ার। তবে সর্দার রব নিস্তার বিমান কোম্পানির মালিকদের নিয়েই পুরো পরিকল্পনা করতে শুরু করলেন। মূল কমিটিতে নেওয়া হল সেই সময়ে সবথেকে বড় বিমান কোম্পানি টাটা এয়ারলাইনসের কর্ণধার জেআরডি টাটা, বেঙ্গল ফ্লাইং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বীরেন রায় এবং কংগ্রেস দলের দেওয়ান চমনলালকে। তবে এই কমিটি নিয়েও অভিযোগ কম ওঠেনি। কলিঙ্গ এয়ারওয়েজ কোম্পানির তরফ থেকে বলা হয়েছিল, ছোট কোম্পানিগুলিকে বড় কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়ার জন্যই এই কমিটি তৈরি হয়েছে। তবে নানা টালবাহানার পর প্রায় ৪ বছরের শেষে সমস্ত সংশ্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে আলোচনা শেষ করল রব নিস্তার কমিটি। অবশেষে ১৯৫৩ সালে জমা পড়ল কমিটির রিপোর্ট।

ইতিমধ্যে অবশ্য স্তালিনের পরামর্শে জওহরলাল নেহেরু ঠিক করে ফেলেছেন, পরিষেবা সংক্রান্ত সমস্ত ক্ষেত্র সরকার নিজের হাতেই রাখবে। কারণ ব্যক্তিগত মালিকানার মধ্যে থাকলে মুনাফার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়, আর তাতে আখেরে মানুষেরই দুর্দশা বাড়ে। রব নিস্তার কমিটির রিপোর্টও একই সুপারিশ জানাল। আর সেই রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৫৪ সালে ভারতের পার্লামেন্টে একটি আইন পাশ করা হল, যার ফলে সমস্ত ছোটবড় বিমান কোম্পানিগুলিকে এক ছাতার তলায় এনে তৈরি হল সরকারি সংস্থা। দেশীয় পরিবহনের জন্য তৈরি হল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস। এবং আন্তর্দেশীয় পরিবহনের জন্য তৈরি হল এয়ার ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশানাল। তবে মালিকানা সরকারের হাতে থাকলেও দুই প্রতিষ্ঠানের দেখাশোনার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হল এতদিনের অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদেরই। আর প্রাথমিকভাবে ম্যানেজার নিযুক্ত করা হল একসময়ের সবচেয়ে বড়ো বিমান পরিবহন সংস্থা টাটা এয়ারলাইনসের কর্ণধার জেআরডি টাটা-কে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনিই দায়িত্ব সামলেছেন।

আরও পড়ুন
১৯১০-এ প্রথম বিমান ওড়ে কলকাতায়, দমদমে প্লেনের নিলাম করেছিলেন তিন বৈমানিক

অনেকে মনে করেন, টাটা এয়ারলাইনস থেকেই ভারতের বিমান সংস্থার জন্ম। এই ধারণা কিন্তু ঠিক নয়। ১৯৩২ সালে টাটা কোম্পানি ব্যবসা শুরু করার আগেই কলকাতার বুকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল ৩টি কোম্পানি। বহু আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও টিকে থেকেছে তারা। যদিও লগ্নির পরিমাণ হিসাবে টাটার ব্যবসাই ছিল বৃহত্তম। ২০০০ সাল থেকে অবশ্য এই সরকারি সংস্থার মধ্যেও ক্রমশ বেসরকারি লগ্নি ঢোকানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। পূর্বতন এবং বর্তমান উভয় সরকারই আবার বেসরকারি হাতে ব্যবসা তুলে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু একদিন সমস্ত বেসরকারি সংস্থা মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ব্যবসায় দেশের সরকারের হাত মজবুত করতে হবে। সেই সময়ের সেই স্বাধীনতার আবেগ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে বলেই কি আবার বেসরকারিকরণের পথে হাঁটছে ভারত?
তথ্যসূত্রঃ কলিকাতা দর্পণ, রাধারমণ মিত্র

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বিমান দুর্ঘটনায় মৃত নেতাজি, বিশ্বাস করেনি ব্রিটিশ-মার্কিন সংবাদমাধ্যমও

More From Author See More