নবাবি কলমে রাধাকৃষ্ণের কিস্‌সা, নর্তকীর বেশে হোলি উদযাপন ওয়াজেদ আলি শাহের

সময়টা উনিশ শতক। ব্রিটিশ শাসন পুরোপুরি কায়েম হয়ে গেলেও কিছু কিছু দেশীয় রাজ্য তখনও স্বমহিমায় বিরাজ করছে। তেমনই এক রাজ্য অওধ। এর মধ্যেই বসন্ত এসেছে। রঙ লেগেছে নবাবের মনেও। কবে যে আবির মেখে উদযাপন করবেন! কিন্তু হঠাৎ নবাবের কানে এল, হিন্দুরা নাকি এবছর হোলি খেলবে না। কিন্তু কেন? রাজদরবারে ডাক পড়ল কয়েকজন ব্রাহ্মণের। তাঁরা নবাবকে জানালেন, যেহেতু একই দিনে মহরম এবং হোলির দিন পড়েছে, তাই সেবছরের জন্য রং মাখার অনুষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ইসলাম ধর্মে রংকে হারাম মনে করা হয়। শরীরের কোথাও রঙ লেগে থাকলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মসজিদে প্রবেশ করেন না। কিন্তু হোলির দিনে তো গোটা শহর রঙে ভরে উঠবেই। অওধে হিন্দুদের এই কথা শুনে মৌলভিদেরও ডেকে পাঠালেন নবাব। আর জানিয়ে দিলেন, দুই ধর্মের অনুষ্ঠানই একইরকম মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হবে। নিজে মুসলমান পরিবারে জন্মালেও প্রজাদের ধর্মই যে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের ধর্ম। সেখানে হিন্দু মুসলমান ভেদ নেই।

এই ওয়াজেদ আলি শাহের সঙ্গেই পরে জড়িয়ে যাবে কলকাতার ইতিহাসও। তবে তখনও তিনি লখনৌ শহরেই রাজত্ব করছেন। সেবারের হোলির অনুষ্ঠানে যথারীতি রং মেখে হাজির হয়েছিলেন নবাব নিজেও। শুধুই যে সর্বধর্মসমন্বয়ের বার্তা, তাই নয়। রঙের উৎসবের মধ্যেই কোথায় যেন আত্মীয়তা খুঁজে পেত নবাবের রঙিন মনও। প্রতি বছর তাই হোলি খেলা চাই। তাঁর লেখা বহু গানের কথাতেও ঘুরেফিরে এসেছে হোলির বৃত্তান্ত। কখনও লিখেছেন, “মোরা কানহা জো আয়ে পলটকে / আবকে হোলি ম্যায় খেলুঙ্গি…”, আবার কখনও “আও সাথী বাহার ফির আয়ে হোলি মে”।

ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ এক কিংবদন্তি মানুষ। ১৮৫৫ সালে প্রবল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যেও অযোধ্যার হনুমান গঢ়ী মন্দির রক্ষা করেছিলেন তিনি। তবে ব্রিটিশ সরকারকে চিনেছিলেন শত্রু বলেই। কম বাধার মধ্যে দিয়ে তো এগোতে হয়নি তাঁকে। মহাবিদ্রোহের সময় যুদ্ধের সম্ভাবনা আর ঠেকিয়ে রাখা গেল না। উত্তর ভারতের অনেক রাজ্যের মতোই সিপাহীদের সঙ্গে যোগ দিল অয়ূধ। মহাবিদ্রোহের পরাজয় দিয়েই লক্ষ্ণৌ শহরে নবাবি শাসনের ইতি ঘটল। ব্রিটিশদের হাতে বন্দি ওয়াজেদ আলি শাহ চলে এলেন কলকাতা। আশ্রয় নিলেন মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে।

আরও পড়ুন
কৃষ্ণের হোলি খেলা নিয়ে গান লিখলেন নজরুল, রেকর্ডে কণ্ঠ মহম্মদ রফির

শহরের প্রথম চিড়িয়াখানা থেকে ঘুড়ি ওড়ানোর রীতি, কলকাতা শহরকে অনেককিছুই দিয়েছেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। আর এই প্রবাসে এসেও মেতে উঠেছেন সেই একই রঙের উৎসবে। বাঙালিদের মধ্যে অবশ্য দোলপূর্ণিমার উদযাপন নতুন নয়। আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও বাংলার ঐতিহ্য। তাই ভাগীরথী তীরের এই শহরেই যেন নিজের প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন নবাব। লক্ষ্ণৌতে থাকতেই হিন্দুস্তান থিয়েটারের জন্য তিনি লিখেছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম অপেরা ‘রাধা-কানহাইয়া কা কিসসা’। শুধু তাই নয়, সেই অপেরা মঞ্চস্থ হওয়ার সময় নবাব নিজেই কৃষ্ণ সেজে অবতীর্ণ হয়েছেন। দোরদণ্ডপ্রতাপ নবাবের নাচগানের প্রতি এই আসক্তি পছন্দ হয়নি ব্রিটিশদের। তবে কলকাতা এসেও সেই মেজাজে কোথাও ছেদ পড়েনি।

মেটিয়াবুরুজে নবাবের বাসগৃহ রীতিমতো সঙ্গীতশিল্পীদের আড্ডায় পরিণত হয়েছিল। পাথুরিয়াঘাটার রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর থেকে শুরু করে যদুভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তী প্রত্যেকেই যেতেন সেখানে। প্রত্যেকেই নবাবের দরবারি ঠুমরির রীতিমতো ভক্ত ছিলেন। আর হ্যাঁ, অবশ্যই এই শহরেও রঙের উৎসবে মেতে উঠেছেন নবাব। বাংলার নিজস্ব দোলপূর্ণিমার ধারার সঙ্গে মিলিয়েছেন লক্ষ্ণৌয়ের হোলির প্রথাও। এখানেই এক হোলির অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠে নর্তকীর বেশে নৃত্যপরিবেশন করেছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। মঞ্চ থেকেই গেয়ে শুনিয়েছিলেন ঠুমরি। সাম্প্রদায়িকতার ঠুনকো বেড়া ভেঙে এই উৎসব যে দেশের আবহমান সংস্কৃতির অংশ।

আরও পড়ুন
জগন্নাথ-খুনের বদলা নিয়ে তবেই হোলি খেলবেন, প্রতিজ্ঞা মালখান সিং-এর

তথ্যসূত্রঃ
১. বিরিয়ানি থেকে সরোদ শিখিয়েছিলেন কলকাতাকে, ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী, আনন্দবাজার পত্রিকা
২. বিভাজন নয়, ভালবেসে ‘শাসন’ করতেন ওয়াজিদ, কুন্তক চট্টোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
হোলির দিনেই ভারতজয়, আইলিগে ফের বাজিমাত মোহনবাগানের

More From Author See More