কলকাতার বিখ্যাত নাখোদা মসজিদ। তার ঠিক পিছনেই চলে গেছে একটা রাস্তা। আর সেই রাস্তার দুধারে ব্যস্ত বাজার। বাবরি মার্কেট। অজস্র লোকের আনাগোনা। দোকানিরা সাজিয়ে বসেছেন বিভিন্ন পসরা। দোল খেলার উপকরণেরও অভাব নেই। রয়েছে রঙ, পিচকারি, আবির। আর, এই উপকরণের বিক্রেতাদের মধ্যে রয়েছেন মুসলমানরাও। কী, চমকে উঠলেন? রঙের উৎসবে ধর্মের ভেদ নেই তাঁদের কাছে। আর সে-কারণেই অনায়াসে পসরা সাজিয়ে বসেছেন তাঁরা, খোদ কলকাতায়।
অদ্ভুত দম বন্ধ করা একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। আমাদের ঘিরে রেখেছে হিংসা, হানাহানি। আর এরই মধ্যে শহরে বসন্ত এসেছে। প্রকৃতির এই উৎসবে মেতে উঠেছে মানুষও। যেন প্রকৃতির রঙে রাঙিয়ে নিচ্ছে নিজেদের। এই উৎসব তো 'আমাদের' বা 'ওদের' নয়। অথচ আজকাল বসন্ত উৎসব যেন রং হারিয়ে হয়ে উঠছে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক উৎসব। তবে এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। আর এসবের মধ্যেই ফল্গু ধারার মতো এখনও বয়ে চলেছে আমাদের আবহমান সংস্কৃতি। জুড়ে জুড়ে থাকার আহ্বান।
আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প
সাইফুদ্দিন মোল্লা। হ্যাঁ, ধর্মে তিনি মুসলমান। আর আমরা তো এটা শুনেই অভ্যস্ত যে, মুসলমানদের কাছে রং মানেই 'হারাম'। অথচ রং-এর উৎসবের সঙ্গে কেমন অবলীলায় জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। তিনি একা নন। এই বাজারে এমন আরও তিনচারজন রং বিক্রেতা আছেন, যাঁরা ধর্মে মুসলমান। সইফ ভাইয়ের সঙ্গে এইসব নিয়েই আরও কিছু কথা বলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ব্যস্ত বাজারের মধ্যে তাঁর সময় কোথায়? বললেন রাস্তার উল্টোদিকে বসে থাকা রাকেশের সঙ্গে কথা বলে নিতে।
রাকেশ ভাইও নানারকমের আবিরের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। তিনি অবশ্য ধর্মে মুসলমান নন। ঝাড়খণ্ডের দলিত পরিবারে তাঁর জন্ম। ডান হাতে উল্কি এঁকে লেখা 'মা'। পথে, আলাপ আরেক স্থানীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে। মাথায় ফেজ টুপি, পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। চলেছেন মসজিদে নামাজ পড়তে। রাকেশ ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথোপকথনে খানিক থমকে দাঁড়ালেন। তারপর এগিয়ে এসে বললেন, "মুসলমান খুঁজছেন? রাকেশের মতো সালাম করতে পারে এমন মুসলমান আর ক'টা খুঁজে পাবেন?" নিমেষে যেন সমস্ত শরীরের উপর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এমন একটা পৃথিবীতে দাঙ্গা বাঁধাতে পারে নাকি কেউ?
আরও পড়ুন
পঞ্চানন মিলেমিশে যান বুদ্ধের সঙ্গে, তারকেশ্বরে সম্প্রীতির গল্প শোনায় বৌদ্ধ মন্দির
রাকেশ ভাই নিজে অবশ্য কথা বলতে বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তিনিই নিয়ে গেলেন খানিক দূরে নাসিম ভাইয়ের দোকানে। নাসিম আহমেদ। মেছুয়া অঞ্চলেই জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা। এখানকার আর সব হিন্দু-মুসলমান মানুষের মতোই তাঁর নির্দিষ্ট কোনো জীবিকা নেই। কখনও ফলের ব্যবসা, কখনও জামাকাপড়ের ব্যবসা -- এভাবেই চলে। আর সেইসঙ্গে বিভিন্ন উৎসবের সময় সিজনাল জিনিসের দোকান সাজিয়ে বসেন। ঈদের জামাকাপড় হোক বা কালীপুজোর পটকা অথবা দোলের সময় রং। রংএর ব্যবসায় আছেন প্রায় দশ বছর। বললেন, "আমাদের ধর্মে রং মাখা হারাম। রং বিক্রি তো নয়।" তাই এভাবেই রং-এর উৎসবে মেতে ওঠেন প্রত্যেকে। কেউ রং মেখে, আর কেউ তাদের হাতে সেই রং তুলে দিয়ে। এই সম্পর্ক তো নিছক ব্যবসার সম্পর্ক হতে পারে না।
তবে প্রত্যেকের কথাতেই একটা কথা উঠে এল, আজকের প্রজন্মের কাছে আর এই উৎসবের চাহিদা তেমন নেই। এই খারাপ লাগার অনুভূতি কি শুধুই ব্যবসার লাভ-লোকসানের হিসাব থেকে উঠে আসছে? না, ব্যাপারটা আদৌ তেমন নয়। এভাবেই তো হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলে আমাদের সংস্কৃতি। এভাবেই বসন্তের রং আমাদের অন্তরটা রাঙিয়ে দিয়ে যায়। কবির কথায় তাই, "সবার রঙে রঙ মিলাতে হবে"। শহরের বুকে এভাবেই প্রতি বছর বসন্ত নেমে আসুক। বসন্তের রঙে আমরা আরও বেশি করে রঙিন হয়ে উঠি…